একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাঙালি অসীম সাহসে মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে। ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। বীরত্বপূর্ণ সেসব সম্মুখযুদ্ধ উজ্জ্বল হয়ে আছে স্বাধীনতার স্বপ্নে, আত্মত্যাগের মহিমায়। মুক্তিযুদ্ধের বহুল আলোচিত কয়েকটি যুদ্ধ নিয়ে প্রথম আলোর এ আয়োজন।
রাঙামাটি জেলার নান্নেরচর থানায় বুড়িঘাট এলাকার অবস্থান। রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কটি এই বুড়িঘাট হয়ে চট্টগ্রামে পৌঁছেছে। অদূরেই কাপ্তাই লেক। পার্বত্য অঞ্চলে রাঙামাটির মহালছড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। এই জলপথ মুক্তিবাহিনীর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছিল। প্রতিরোধযুদ্ধে কালুরঘাট ব্রিজের পতন হলে ওই এলাকায় অবস্থানরত বিদ্রোহী বাঙালি সেনাদের কাপ্তাই-রাঙামাটি-মহালছড়ি-খাগড়াছড়ি-জালিয়াপাড়া সড়ক ধরে রামগড়ে (মুক্তিবাহিনীর প্রাথমিক হেডকোয়ার্টার) পৌঁছানোর আর কোনো বিকল্প পথ ছিল না।
এই জলপথকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং এই জলপথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চলাচল প্রতিরোধ করার জন্য ৮ বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন (পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) খালেকুজ্জামান চৌধুরী মাত্র এক কোম্পানি সেনা সঙ্গে নিয়ে মেজর (পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল, রাষ্ট্রদূত ও মন্ত্রী) মীর শওকত আলীর নির্দেশে চেংগী খালের দুই পাড়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে।
ওদিকে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও বিদ্রোহী বাঙালি সেনাদের রামগড়ের উদ্দেশে সম্ভাব্য পশ্চাদপসরণের এই পথটি নিজেদের দখলে রাখার জন্য খুবই তৎপর হয়ে ওঠে।
১৭ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ২০ জন সেন্য একটি লঞ্চযোগে রেকি করতে বেরিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরই তারা বুঝতে পারল যে তারা মুক্তিবাহিনীর রক্ষাব্যূহের কাছাকাছি এসে পড়েছে। শত্রু পাকিস্তানি সেনারা ওই স্থানে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের অবস্থানের ওপর গুলি ছোড়ে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি ছোড়েন।
এতে পাকিস্তানি বাহিনী প্রায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দুজন মুক্তিসেনা শহীদ হন।
পরদিন ১৮ এপ্রিল (১৯৭১)। প্রায় দুপুর। বুড়িঘাটে ৮ বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী ইউনিট ২ কমান্ডো ব্যাটালিয়নের আনুমানিক ২ কোম্পানি সৈন্য ৭টি স্পিডবোট এবং ২টি লঞ্চে করে এসে ব্যাপক হামলা চালায়।
পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশ্য, রাঙামাটি-মহলছড়ির জলপথ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎখাত করে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করা। সর্বসম্মুখভাগে তীব্র গতিতে এগিয়ে আসছে দুটি লঞ্চ ও দুটি স্পিডবোট। এগুলোর মধ্যে বসানো রয়েছে ৬টি ৩ ইঞ্চি মর্টার আর অনেকগুলো মেশিনগান ও রাইফেল, সেগুলো থেকে গুলি ছুটে আসতে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে।
মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি ও লোকবল খুবই কম। অস্ত্রশস্ত্র নেই বললেই চলে। কিন্তু আছে অসীম মনোবল ও দৃপ্ত প্রত্যয়। একেবারে কাছে এসে শত্রুর মর্টার চিহ্নিত করে ফেলে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান। তাদের অবস্থানে বারবার ছুটে আসতে থাকে মেশিনগানের গুলি, আর ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলা। তীব্র গোলাগুলিতে মুক্তিযোদ্ধা প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। কিছুটা ছাত্রভঙ্গ হয়ে যান মুক্তিযোদ্ধারা।
এই অবস্থার সুযোগে পাকিস্তানি সেনারা তীরে নেমে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ১০০ জনের সমন্বয়ে গড়া একটি কোম্পানি নিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ান। বৃষ্টির মতো গোলাগুলির মধ্যে মুক্তিবাহিনী নড়াচড়ার সুযোগ পাচ্ছিল না।
ইপিআরের ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ দেখলেন, এভাবে থাকলে সবাই মারা পড়বে। তিনি তাঁর স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান নিয়ে সামনে অগ্রসর হলেন এবং নিজ পরিখায় দাঁড়িয়ে গেলেন। এরপর শত্রু সেনাদের ওপর চালাতে থাকেন তাঁর মেশিনগানের গুলি। একপর্যায়ে খালেকুজ্জামানকে তিনি বললেন, ‘স্যার, আমি গুলি চালিয়ে যাচ্ছি, আপনি বাকি সৈন্যদের নিয়ে পিছু হটে যান।’
মুন্সী আবদুর রউফ শত্রু সেনাদের বিরুদ্ধে একাই লড়াই করতে লাগলেন। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ও বাকি সেনারা নিরাপদে পিছু হটতে সক্ষম হলেন। মুন্সী আবদুর রউফের দুর্দান্ত গুলিবর্ষণে শত্রুর সাতটি স্পিডবোট ডুবে যায় এবং সব আরোহী পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। কিন্তু লঞ্চ ২টি মেশিনগানের আওতার বাইরে চলে যায়।
আকস্মিক ক্ষতিতে শত্রুপক্ষের মনোবল দুর্বল হয়ে যায়। নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিয়ে শত্রু লঞ্চ দুটি থেকে আবারও মর্টারের গোলাবর্ষণ চালাতে থাকে। হঠাৎ শত্রুর মর্টারের একটি গোলা সরাসরি ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফের দেহে আঘাত হানে এবং তাঁর দেহ ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। এই যুদ্ধে মুন্সী আবদুর রউফ বীরদর্পে যুদ্ধ করে শহীদ হন। তাঁকে চেংগী খালসংলগ্ন একটি টিলার ওপর সহযোদ্ধারা সমাধিস্থ করেন।
এ যুদ্ধে মুন্সী আবদুর রউফ যে নিপুণতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তার স্বীকৃতি হিসেবে পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ (সামরিক সর্বোচ্চ সম্মান) উপাধিতে ভূষিত করে। মুন্সী আবদুর রউফের মৃত্যুতে বুড়িঘাটে মুক্তিবাহিনীর সেনারা অত্যন্ত নীরব হয়ে গেলেন। পরবর্তী সময়ে মিরসরাইয়ের দিকে মুক্তিসেনারা পিছিয়ে আসেন।
বুড়িঘাট যুদ্ধে ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফের বীরত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় এবং শঙ্কিত ও হতাশ হয়ে পড়ে। তারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ় দেশপ্রেম ও সাহসিকতা সম্বন্ধে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। অপরদিকে, এই যুদ্ধে অতি অল্পসংখ্যক যোদ্ধা ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুক্তিবাহিনী প্রতিরোধ করলেও মুন্সী আবদুর রউফের বীরত্বে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানসহ অন্য আরও ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। (ডিসপ্লে বোর্ড, ‘বিজয় নিকেতন’ জাদুঘর, ঢাকা সেনানিবাস থেকে সংগৃহীত)। [ঈষৎ পরিমার্জিত]
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। পৃষ্ঠা ১১৯-১২০