ফরাসি যুবকের মুক্তিযুদ্ধ: ফিরে দেখা ও ফিরে আসা

নতুন রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর বুকে জন্ম নিচ্ছে বাংলাদেশ, ঐতিহাসিক রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী) ময়দানে মিত্রবাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক হাইকমান্ডের প্রধান আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর আত্মসমর্পণ, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ছবি: সংগৃহীত
নতুন রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর বুকে জন্ম নিচ্ছে বাংলাদেশ, ঐতিহাসিক রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী) ময়দানে মিত্রবাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক হাইকমান্ডের প্রধান আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর আত্মসমর্পণ, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধ ফিরে দেখা অনেকের ক্ষেত্রে ঘটে, বিশেষভাবে ১৯৭১ সালের প্রজন্মের জীবিত সদস্যদের জন্য এই ফিরে দেখা চলে অনেকভাবে, তবে মুক্তিযুদ্ধে ফিরে আসা সবার ক্ষেত্রে হয় না, হওয়া সম্ভবও নয়। এমন এক অসম্ভবকে সম্ভব করতে উদ্যোগী হয়েছেন একাত্তরের জেদি বিপ্লবী ক্রুদ্ধ তরুণ, বর্তমানে ফ্রান্সের অগ্রণী ও বিতর্কিত দার্শনিক ইতিহাসবিদ ও চিন্তক বের্নার–অঁরি লেভি, বিএইচএল নামেই মূলত যিনি সম্বোধিত হন। একাত্তরে তিনি যে ঝাঁপ দিয়েছিলেন বাংলার যুদ্ধে, সীমান্ত পার হয়ে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের দলে, যুদ্ধ শেষে আবার ফিরে গেলেন স্বদেশে, তাঁর নিজের জীবনবিকাশ ও সংগ্রামে, সেখানেই তো ঘটনার ইতি। তারপরও যে পিছুটান পুনরায় হয়ে উঠল প্রবল, পরিণত বয়সের খ্যাতকীর্তি সফল এই বুদ্ধিজীবী তাঁর যৌবনের উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতি নতুনভাবে অনুভব করলেন এবং ফিরতে চাইলেন কাদামাটির সবুজ–শ্যামল বাংলায়, যেখানে একদা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কেটেছিল তাঁর দিন ও রাত্রি, কাছে থেকে দেখেছেন যুদ্ধ, ধ্বংস ও বধ্যভূমি। এসেছিলেন সদ্য মুক্ত দেশের রাজধানী শহর ঢাকায়, অনেক মানুষের জন্য যেমন অবারিত ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভবনের দ্বার, তেমনি তিনিও এক স্মরণীয় সাক্ষাতে মিলিত হয়েছিলেন বাঙালির নেতার সঙ্গে, ধূসর কিন্তু প্রোজ্জ্বল সেই সব স্মৃতির তাড়নায় তিনি আবার ফিরে আসতে চাইছেন বাংলাদেশে।

বিএইচএলের যৌবনের দিনগুলোতে তিনি ছিলেন আরেক জীবন ও আরেক সময়ের প্রতিনিধি, ষাটের দশকের শেষাশেষি নতুন সমাজ নির্মাণের স্বপ্নে বিশ্বজুড়ে তরুণেরা তখন বিভোর। ১৯৬৮ সালে ইউরোপ কেঁপে উঠেছিল ছাত্রবিদ্রোহে, প্যারিসও এর বাইরে ছিল না, সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এর কেন্দ্র এবং বিপ্লবী ছাত্রদের অংশী হিসেবে বিএইচএল-ও এর সঙ্গী। তিনি জড়িয়ে পড়েন বিপ্লবীদের মুখপত্র কমব্যাট-এর সঙ্গে, লেখালেখি করেন পত্রিকায়, যে পত্রিকা বুর্জোয়া সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বিপ্লবী সমাজ গঠনের পথ খুঁজছে, আর তাই কোনো স্টলে বিক্রি হয় না কমব্যাট, লেখক-পাঠকেরা নিজেরাই ফেরি করে বেড়ান রাস্তায় এবং মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে পত্রিকা সংগ্রহে। এই সব তরুণ মাও সে–তুংয়ের অনুগামী, তাদের অনেকের হাতেই ঘোরে চেয়ারম্যান মাওয়ের উদ্ধৃতি-সংবলিত লাল বই।

বের্নার–অঁরি লেভি, ১৯৬৯

১৯৬৯ সালে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে অন্য এক তারুণ্যের বিদ্রোহে পূর্ব বাংলা উত্তাল হয়ে উঠেছিল, গণজাগরণ কারাগার থেকে মুক্ত করেছিল শেখ মুজিবকে, পতন হয়েছিল এশিয়ার লৌহমানব জেনারেল আইয়ুব খানের। পাশের দেশ ভারতে, বিশেষভাবে পশ্চিম বাংলায়, তরুণেরা সফল জীবনের মোহ ত্যাগ করে যোগ দিচ্ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্নবহ নকশাল আন্দোলনে। সশস্ত্র বিপ্লবের বাণীবহ এসব আন্দোলন যত তীব্রই হোক, তাতে গভীরতা ছিল কম, ততোধিক কম ছিল জনসম্পৃক্ততা। অন্যদিকে পূর্ব বাংলায় জনতার শক্তিতে ঘটছিল আরেক জাগরণ, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালির মুক্তির পক্ষে ঘোষিত হলো গণরায়। এ গণরায় বানচালে পাকিস্তানি সামরিক সরকারের সশস্ত্র আঘাত তাৎক্ষণিকভাবে জন্ম দিল জনপ্রতিরোধ ও জনযুদ্ধ, যার আবেদন ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর দেশে দেশে। একাত্তরের সেপ্টেম্বরে মার্কিন তরুণ বিট কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ এসেছিলেন যশোর সীমান্তে। প্রায় একই সময়ে প্রবীণ ফরাসি বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে মালরো ডাক দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক বাহিনী গঠনের, স্পেনে ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিস্ট উত্থানের বিরুদ্ধে একদা যে বাহিনীর অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। তাঁর আহ্বান সাড়া জাগিয়েছিল অনেক, তবে বাস্তব হয়ে উঠতে পারেনি বিশেষ। উদ্যোগ এসেছিল কেবল এক তরুণের দিক থেকে, তিনি বের্নার–অঁরি লেভি, যিনি একাই চলে এসেছিলেন দিল্লি, সেখান থেকে কলকাতায়, তারপর সীমান্ত এলাকায় খোঁজখবর ও যোগাযোগ করে ঢুকে পড়েন সাতক্ষীরা অঞ্চলে, একদল মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। 

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ঢাকায় এসে অঁরি লেভি কীভাবে যেন বঙ্গবন্ধুর কাছে উপস্থিত হন। তরুণের বিপ্লব-বাসনার কথা শুনে বঙ্গবন্ধু তাঁকে দেশের বৈপ্লবিক পুনর্গঠনে কাজ করতে বলেন। অঁরি লেভির স্থান হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে এবং ফরাসি যুবক সেখানে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন পরিকল্পনাকারী দলে কাজ শুরু করেন। এরই মধ্যে মাওবাদী বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা তিনি অব্যাহত রাখেন এবং মোহাম্মদ তোয়াহার সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র গড়ে ওঠে। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালে তাঁকে জুন ১৯৭২ নাগাদ দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

এরপর বুড়িগঙ্গা ও সিন নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। অঁরি লেভি পরিণত হয়েছেন ফ্রান্সের নব্য দার্শনিক গোষ্ঠীর সুপরিচিত ব্যক্তিত্বে। তিনি বাস্তব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কঠোর সমালোচক হয়ে ওঠেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ অনেক আগেই সমাজতন্ত্রের সংকট এবং পতনের আভাস দিয়েছিল। তাঁর পরিচালিত তথ্যচিত্র বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছে। তাঁর গ্রন্থসমূহ তাঁকে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। বের্নার–অঁরি লেভির একটি বিখ্যাত বই লেফট ইন ডার্ক টাইমস প্রকাশ পেয়েছিল ২০০৮ সালে। গ্রন্থে তিনি বামপন্থা ও সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সমালোচনা করে উদারবাদের নব-উত্থান কামনা করেন। বিশ্বমানবের মুক্তির স্বপ্ন তিনি পরিত্যাগ করেননি, তবে প্রত্যাশা করেছেন বিশ্বব্যাপী উদার চিন্তার অভ্যুদয়, সে জন্য উদারবাদের উন্নততর স্তরে অধিষ্ঠান তাঁর কাম্য হয়েছে। ‘নব্য দার্শনিক দল’ নামে ফ্রান্সে যে গোষ্ঠী গড়ে ওঠে, তিনি হলেন তাদের মূল প্রবক্তা। তবে একনায়কত্বের বিপরীতে উদারবাদের পক্ষে এই অবস্থানের পথও সরল ছিল না। এই অভিযাত্রায় অঁরি লেভি নিজেও সমালোচিত হয়েছেন, বিশেষভাবে সাবেক ফরাসি প্রধানমন্ত্রী নিকোলা সারকোজির সঙ্গে তাঁর সখ্যের কারণে, লিবিয়ায় পশ্চিমা অভিযানে সারকোজির দায় অনেকে অঁরি লেভির ঘাড়েও চাপায়।

বহু বছর পর স্বল্প সময়ের জন্য ২০১৭ সালের এপ্রিলে অঁরি লেভি আবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আঁদ্রে মালরোর নামে পার্ক তিনি উদ্বোধন করেন। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ ঢাকা এবং লিবারেল আর্টস বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও দেখা করেন এবং টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনকের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনে যান।

১৯৭১ সালে সাতক্ষীরা-যশোর অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে ছিলেন অঁরি লেভি। দলের নেতা অসীম মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কোনো নাম তিনি স্মরণ করতে পারেন না। অঁরির মনে পড়ে তাঁবুতে হারিকেনের আলোয় তাঁদের মধ্যে তর্কাতর্কির কথা, তাঁর দেখা বধ্যভূমি, মানুষের হাড়ের স্তূপ ইত্যাদি। ৪ ডিসেম্বর যশোর এলাকায় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর দ্বারা পাকিস্তানি আক্রমণ ঠেকিয়ে দেওয়া তিনি প্রত্যক্ষ করেন।

অঁরি লেভি ছিলেন ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে মনে পড়ে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি মার্শেল কাচিন সম্পর্কে মার্কিন কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের উক্তি। হেমিংওয়ে তখন আমেরিকান সংবাদপত্রের ইউরোপীয় প্রতিনিধি, ‘বাইলাইন’ শিরোনামে তাঁর প্রেরিত বার্তার সংকলনে হেমিংওয়ে লিখেছিলেন, ‘কমিউনিস্ট হওয়াটা মার্শেল কাচিনের সাজে, কেননা তিনি যথেষ্ট ধনী।’ একই কথা অঁরি লেভি সম্পর্কে প্রযোজ্য, বিপ্লবী হওয়াটা তাঁর সাজে, কেননা তিনি ধনবান ব্যক্তি। প্যারিসে এলিজি প্রাসাদসংলগ্ন তাঁর আবাস, বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাখোঁ তাঁর বিশেষ বন্ধু।

অঁরি লেভি আবার আসতে চাইছেন বাংলাদেশে, যাবেন সাতক্ষীরায়, খুঁজে দেখবেন তাঁকে কেউ মনে রেখেছে কি না। ফিরে যেতে চাইছেন মুক্তিযুদ্ধে, তাঁর যৌবনের লড়াইক্ষেত্রে। লক্ষ্য তাঁর নিজ যৌবন ও আজকের বাংলাদেশ নিয়ে নির্মাণ করবেন তথ্যচিত্র বিস্মৃত যুদ্ধ: বিস্মৃত দেশ।

বাংলাদেশ নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে অঁরি লেভি প্রেসিডেন্ট মাখোঁর সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। বের্নার–অঁরি লেভির পরিকল্পনা, ২০২০ সালের মার্চে তিনি সরেজমিনে পরিস্থিতি যাচাই করতে আসবেন বাংলাদেশে, সাতক্ষীরা ও ঢাকায় খোঁজখবর করে অতীতের মানুষদের দেখা যদি পান, লাভ করেন পর্যাপ্ত তথ্য, তবে জুন-জুলাই নাগাদ ফিল্ম ইউনিটসহ এসে চিত্রধারণের কাজ করবেন। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২১ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবি মুক্তিদানের ইচ্ছা তিনি পোষণ করেন। তবে সেটা বড়ভাবে নির্ভর করছে বাংলাদেশের যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর ফিরে আসা সবাই মিলে অর্থবহ করে তুলতে পারে কি না, তার ওপর। বলা বাহুল্য, এই তথ্যচিত্র অতীতে নিবদ্ধ থাকবে না, উদার অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান ও বিকাশ হবে তথ্যচিত্র ফরগটেন ওয়ার: ফরগটেন কান্ট্রির উপজীব্য। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ ঢাকার বোর্ড সভাপতি আবদুল মাজিদ চৌধুরী এবং সদস্য হিসেবে মফিদুল হক অঁরি লেভির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন।

এখন প্রয়োজন তথ্যানুসন্ধান, সাতক্ষীরা অঞ্চলের কেউ কি একাত্তরে ঝাঁকড়া চুলের এই ফরাসি তরুণকে দেখেছিল, অথবা ঢাকায় অর্থ মন্ত্রণালয় কিংবা পরিকল্পনা দপ্তরে কর্মরত কেউ কি স্মরণ করতে পারেন বিপ্লব-কামনায় অধীর ফরাসি যুবকের কথা? গুলশানে যে বাঙালি পরিবারের সঙ্গে তিনি ছিলেন, তাঁরা কেউ কি বলতে পারেন তাঁর প্রসঙ্গে। বের্নার–অঁরি লেভি ফিরতে চাইছেন একাত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে, আমরা কি তাঁর সহায়ক হতে পারি না। সবার সুবিধার জন্য তিনি একাত্তরে তাঁর যুবা বয়সের ছবি পাঠিয়েছেন, যে ছবি এই লেখার সঙ্গে পত্রস্থ হলো।

স্বাগত, বের্নার–অঁরি লেভি। সার্থক হোক একাত্তরের রণাঙ্গনে প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশা।

মফিদুল হক: লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য