একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাঙালি অসীম সাহসে মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে। ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। বীরত্বপূর্ণ সেসব সম্মুখযুদ্ধ উজ্জ্বল হয়ে আছে স্বাধীনতার স্বপ্নে, আত্মত্যাগের মহিমায়। মুক্তিযুদ্ধের বহুল আলোচিত কয়েকটি যুদ্ধ নিয়ে প্রথম আলোর এ আয়োজন।
২৫ মার্চ [১৯৭১] তারিখে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা শহরের বিভিন্ন জনপদে, ছাত্রাবাসে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ভয়াবহ গণহত্যা চালায়। নিহত হয় অসংখ্য ছাত্র, শিক্ষক, পুলিশ, ইপিআর [ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস] সৈনিক ও সাধারণ মানুষ। আমরা এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনো সংবাদই পাইনি। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল, জয়দেবপুরে ২য় ইস্ট বেঙ্গল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল, ২৮ মার্চ সৈয়দপুরে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল গণহত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং প্রতিরোধসংগ্রামে লিপ্ত হয়। চট্টগ্রামে ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান [বীর উত্তম। পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি] কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আশ্চর্যের বিষয়, সীমান্ত এলাকার গন্ডগ্রামে অবস্থান করার কারণে এসব চাঞ্চল্যকর ঘটনা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতে পারিনি।
২৯ মার্চ বেতার মারফত নির্দেশ পেলাম যশোর সেনানিবাসে ফিরে আসার জন্য। মধ্যাহ্নভোজের পর আমরা সাড়ে তিন শ সৈনিক যশোরের উদ্দেশে মার্চ করা শুরু করি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, রাত গভীর হলো, আমরা একটানা মার্চ করেই চলেছি।
লোকালয় অতিক্রম করার সময় লক্ষ করলাম, আমাদের দেখে গ্রামবাসী পালিয়ে যাচ্ছে। অবাক হলাম, এমনটি তো কখনো হয়নি। ক্যান্টনমেন্টের প্রবেশপথে একদল সৈনিকসহ সুবেদার মেজর আজিম খান আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে অপেক্ষা করছেন। আমরা আমাদের আবাসস্থলে পৌঁছালাম। মেসে নিজ কক্ষে ঢুকে শ্রান্ত-ক্লান্ত দেহে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
৩০ মার্চ ’৭১। সকাল সাড়ে সাতটায় [পাকিস্তান সেনাবাহিনীর] ১০৭ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আবদুর রহিম দুররানি ১ম ইস্ট বেঙ্গলে এসে সিও লে. কর্নেল জলিলকে [রেজাউল জলিল] জানালেন যে এই মুহূর্ত থেকে ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করা হলো। সৈনিকেরা কোনো অস্ত্র বহন করতে পারবে না। আদেশ জারি করেই তিনি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে চলে গেলেন। আমার ব্যাটম্যান দৌড়ে এসে অফিসার মেসে আমাকে জানায়, ‘স্যার, আমাদের নিরস্ত্র করা হয়েছে। একটু পরই বালুচ অফিসার এসে আমাদের কোতের (অস্ত্রাগার) চাবি নিয়ে যাবে। হতভম্ব হয়ে গেলাম! একজন সৈনিকের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া চরম অবমাননার শামিল। সেকেন্ড লে. আনোয়ার আমার রুমেই ছিল। তাকে এ খবর জানাতেই সে উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘স্যার, পাকিস্তান আর্মিতে আর চাকরি করব না। আমি অফিসে গিয়েই সিওর সামনে বেল্ট খুলে পদত্যাগ করব।’ ‘চলো, আগে অফিসে যাই, হারি আপ।’ শান্তভাবে বললাম। পাশের রুমে তিনজন পাঞ্জাবি অফিসার নিসার, নাজির, ইকরামকে নিরস্ত্র করার খবর জানালাম। তারাও অবাক হলো। বললাম, চলো, সবাই অফিসে যাই।
আমরা পাঁচজন ইউনিফর্ম পরে দ্রুত অফিস অভিমুখে ছুটলাম। অফিস এলাকায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই শুনতে পেলাম বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ, ট্যা-টা, ঠা-ঠা-ঠা। দৌড়ে সিওর অফিসরুমে ঢুকলাম আমরা। তিনি উদ্ভ্রান্তভাবে পায়চারি করছেন, দুচোখ থেকে অবিরল ধারায় অশ্রু ঝরছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘স্যার, হোয়াট হ্যাপেন্ড (কী হয়েছে)?’
‘উই হ্যাভ বিন ডিসআর্মড (আমাদের নিরস্ত্র করা হয়েছে)।’ তাঁর জবাব।
এ সময় দৌড়ে রুমে এলেন সুবেদার মেজর আজিম খান, ‘স্যার, গজব হো গিয়া।
জওয়ানেরা কোত ভেঙে হাতিয়ার বের করে নিয়ে পার্শ্ববর্তী ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির (পাঞ্জাবি) ওপর গুলিবর্ষণ করছে। বাঘাওয়াত হো গিয়া (বিদ্রোহ করেছে আমাদের জওয়ানেরা)। খোদাকে লিয়ে কুছ কিজিয়ে (আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু একটা করুন)। কান্নাভেজা কণ্ঠে মিনতি আজিম খানের। সবাই স্তম্ভিত। পাকিস্তানি বাহিনীতে বিদ্রোহ, এও কি সম্ভব? নিরস্ত্র করার খবর পেয়েই বাঙালি সৈনিকদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়।
দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারা কমবেশি ক্ষিপ্ত ছিল, নিরস্ত্র করার পেছনে পাঞ্জাবিদের দুরভিসন্ধি রয়েছে ভেবে তারা চরমভাবে উত্তেজিত হয়ে অস্ত্রাগার ভেঙে হাতিয়ার বের করে নেয়। আমাদের সৈনিকেরাই প্রথম গুলিবর্ষণ করে পাঞ্জাবি ইউনিটের ওপর। পাঞ্জাবিরা এ বিদ্রোহের জন্য প্রস্ত্তত ছিল। কারণ, ইতিমধ্যেই ইস্ট বেঙ্গলের চারটি ব্যাটালিয়ন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। এ খবর অবশ্য আমাদের জানা ছিল না। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকেরা বিদ্রোহ দমনের প্রস্ত্ততি নিয়েই রেখেছিল। যশোর সেনানিবাসে আমাদের বিদ্রোহের ২০ মিনিটের মধ্যেই তারা পাল্টা গুলিবর্ষণ করে এবং তিন দিক থেকে আমাদের অফিস এরিয়ার ওপর আক্রমণ চালায়।
আমি একসময় সিওকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘স্যার, আমাদের ওপর আক্রমণ আসছে। আমরা এখন কী করব?’ তিনি জবাব দিলেন না, শুধু বললেন, ‘ও মাই গড, এখন কী হবে?’ উপ-অধিনায়ক মেজর ইকবাল কোরেশি সাহসী পুরুষ। সিওর চার কোর্স সিনিয়র ছিলেন পিএমএতে। তিনি টেলিফোন হাতে নিলেন এবং ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে টেলিফোন করে পাঞ্জাবি ভাষায় ব্রিগেড মেজর আসলাম খানকে আমাদের ওপর আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করলেন। ব্রিগেড মেজর জানালেন, আগে বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করুক।
পরিস্থিতি ভালোভাবে দেখার জন্য অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে পেছনের আমবাগানে গেলাম। আমাদের অফিস এরিয়ার চারদিকে পরিখা খনন করা ছিল আগে থেকেই। আমাদের সৈনিকেরা অস্ত্র হাতে নিয়ে পরিখায় অবস্থান নিয়েছে। ২৫ বালুচ এবং ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সৈনিকেরা উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে আমাদের ঘিরে রেখেছে এবং আক্রমণের চেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদের সৈনিকেরা ইতিমধ্যেই কয়েকটি আক্রমণ প্রতিহত করেছে। শত্রুর যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছে।
একদল সৈনিক ও এনসিও নিয়ে এগিয়ে এলেন ‘সি’ কোম্পানির সিনিয়র জেসিও সুবেদার আবদুল মজিদ।
‘স্যার, একটু কথা বলতে চাই আপনার সঙ্গে। ধৈর্য ধরে শুনবেন?’ বললেন মজিদ।
‘অবশ্যই, বলুন।’ আমার উত্তর।
‘স্যার, ২০ বছর চাকরি করেছি এ পল্টনে, আর এক সপ্তাহ পরই আমার রিটায়ারমেন্ট। আজ এক মহাবিপদ এবং পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছি আমরা। হয় বিজয়, নয়তো ধ্বংস অনিবার্য। আমরা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি কিন্তু আমাদের বিদ্যাবুদ্ধি অতি সামান্য। একজন অফিসারও নেই আমাদের সঙ্গে। আপনি এখন থেকে আমাদের নেতৃত্ব দেবেন, প্লিজ।’ মজিদ মিনতি করেন।
‘আমি কেন, কমান্ডিং অফিসার আছেন। তাঁর কাছে যান।’ আমার পরামর্শ।
‘গিয়েছিলাম স্যার, ওনার বয়স হয়েছে। তাঁর পক্ষে বিদ্রোহ করা সম্ভব নয়। এখন আপনিই আমাদের একমাত্র ভরসা।’ বললেন মজিদ।
‘ঠিক আছে। আপনারা এখানেই অপেক্ষা করুন, আমি সিওর সঙ্গে কথা বলে দেখি।’ আমি বললাম।
অফিস ঘরে ফিরে এলাম। মেজর কোরেশি পাঞ্জাবি ভাষায় তখন পর্যন্ত ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছেন। শত্রু থেমে থেমে গুলিবর্ষণ করছে।
কয়েকটি এসে আমাদের অফিসের দেয়ালে আঘাত করেছে। মাঝেমধ্যে মর্টারের গোলা বিকট শব্দ করে অফিসের আশপাশে ফাটছে। ভাবলাম, এই তাহলে যুদ্ধ, এত দিন যার জন্য প্রস্ত্ততি নিয়েছি। শত শত উড়ন্ত বুলেটের একটিই একজনের জন্য যথেষ্ট।
আমাকে দেখে সিও বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। বাংলাতে বললাম, ‘স্যার, এভাবে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। আপনি নির্দেশ দিন আমাদের, লেট আস ফাইট ইট আউট।’ তিনি কিছু বলার উদ্যোগ নিলেন, এ সময় পাশে এসে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন ইকরাম। কোনো জবাব পেলাম না, তিনি তাঁর ঘরে ফিরে গেলেন।
বারান্দায় একটি খামের আড়ালে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছি, আমার করণীয় কী? এখানে অফিসরুমে ছয়জন অফিসারের সঙ্গে বসে থাকব, নাকি বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেব? এ বিদ্রোহের পরিণতিই-বা কী হবে? দুই মিনিট চিন্তাভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নিলাম জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আমি বিদ্রোহ করব এবং পল্টনের সৈনিকদের নেতৃত্ব দেব।
ফিরে এলাম আমবাগানে। সুবেদার মজিদ ও অন্যরা অপেক্ষা করছেন আমার জন্য।
সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম, ‘আমি আছি আপনাদের সঙ্গে। তবে যুদ্ধ চলবে আমার নির্দেশে, সবাইকে শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে।’ আমার কথা শুনে যুদ্ধরত সৈনিকদের উৎসাহ-উদ্দীপনা বেড়ে যায়। তারা চিৎকার করে ওঠে, ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার।’
আমি জেসিওদের ডেকে এনে যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলাম। কোথায় মেশিনগান বসাতে হবে, কীভাবে ফায়ার কন্ট্রোল করতে হবে, কীভাবে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে-এসব বিষয়ে নির্দেশ দিলাম। আমাদের সৈনিকেরা একটি মর্টারও বের করতে পারেনি। কারণ, শত্রুর গোলায় আমাদের অস্ত্রাগার ধ্বংস হয়ে যায়। হঠাৎ মেগাফোনের শব্দ ভেসে আসে, ‘শোনো জওয়ান, আমি সুবেদার মোজাম্মেল হক মণ্ডল বলছি। তোমরা ফায়ার বন্ধ করো। ব্রিগেড কমান্ডার সাহেব জানিয়েছেন, বিদ্রোহের কারণে কাউকে শাস্তি দেওয়া হবে না। আমরা পাকিস্তান আর্মির সৈনিকেরা একে অন্যের ভাই। সিও সাহেবের নির্দেশ, ফায়ার বন্ধ করো।’
আমি সৈনিকদের গুলিবর্ষণ চালিয়ে যেতে নির্দেশ দিলাম। ঘোষণা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে অফিস ঘরের দিকে এগোলাম। সিও এবং অন্য অফিসাররা অফিস ঘর ছেড়ে পুকুরপাড়ে গাছের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন, মেজর কোরেশি টেলিফোনে বাক্যালাপ চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাকে দেখেই তিনি বলেন, ‘হাফিজ, মেগাফোন হাতে নাও, সৈনিকদের ফায়ার বন্ধ করতে নির্দেশ দাও। আমাদের পক্ষ থেকে যেন আর একটি গুলিও ছোড়া না হয়।’
‘স্যার, আমার পক্ষে এ ধরনের নির্দেশ দেওয়া সম্ভব নয়। ২৫ বালুচরা ফায়ার বন্ধ করছে না কেন?’ আমি বললাম।
‘তোমার মতলবটা কী? এটা ফুটবল খেলা নয়।’ কোরেশি বললেন।
‘আমি জানি এটা ফুটবল খেলা নয়। দুঃখিত,’ বলে ফিরে এলাম বিদ্রোহীদের মধ্যে। একসময় সেকেন্ড লে. আনোয়ারকে ইশারায় ডেকে নিলাম।
‘আমি বিদ্রোহ করেছি, তুমি কী করবে?’ আমার প্রশ্ন।
‘স্যার, আমি অবশ্যই আপনাদের সঙ্গে আছি, লেট আস ফাইট ইট আউট,’ আনোয়ার তেজোদীপ্ত কণ্ঠে জানাল।
একসময় ক্যাপ্টেন নিসার পরিস্থিতি জানার জন্য আমাদের দিকে এগিয়ে এল। কৃতী সাঁতারু হাবিলদার সাহেব মিয়া তাকে জাপটে ধরে লাইট মেশিনগানের নল ঠেকায় তার মাথায়, গুলি করতে উদ্যত হয়।
‘আরে আরে, কেয়া কর রহে হো (কী করছ),’ বলে আমার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। আমি সাহেব মিয়াকে কলার ধরে টেনে আনলাম এবং কড়া ধমক দিলাম। বললাম, এরা তো নির্দোষ, এ ধরনের কাপুরুষতা আমাদের সাজে না। এলএমজিসহ সাহেব মিয়াকে উত্তর দিকের ট্রেঞ্চে পাঠিয়ে দিলাম। কৃতজ্ঞ নিসার বলে, ‘আমিও সিনিয়র টাইগার, একটি হাতিয়ার দাও, আমিও তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধে শামিল হব।’ আমি বললাম, তার প্রয়োজন হবে না। তুমি অন্য অফিসারদের সঙ্গে বসে থাকো এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করো। সে দ্রুত পায়ে সিওর কাছে ফিরে গেল।
বিকেল চারটা প্রায় বাজে। আট ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলছে। আমাদের সৈনিকেরা কয়েকটি আক্রমণ সফলভাবে প্রতিহত করেছে। সুবেদার মজিদ এসে জানালেন যে অ্যামুনিশন প্রায় শেষ। মুহূর্তের উত্তেজনায় বিদ্রোহ করেছে সৈনিকেরা, অ্যামুনিশন দুই পকেটে ভরেছে তাড়াহুড়ো করে। আমাদের কোতের পাশেই ছিল ৭ম ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের অফিস। এদের কিছু সৈনিকও আমাদের বিদ্রোহে যোগ দেয়। আমাদের সৈনিকেরা তাদের চায়নিজ রাইফেলে গুলি ছোড়া শিখিয়ে দেয়। তারাও মহা উৎসাহে আকাশে এবং পাশের পাঞ্জাবি ইউনিটের দিকে গুলি ছুড়তে থাকে। গুলি যেহেতু ফুরিয়ে যাচ্ছে, জেসিওদের ডেকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম, ছোট ছোট গ্রুপে ফায়ার অ্যান্ড মুভ কৌশল ব্যবহার করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। আরভি, অর্থাৎ একত্র হওয়ার স্থান নির্ধারণ করলাম চৌগাছা বাজার এলাকা।
তিন-চারজনের গ্রুপে ধীরে ধীরে সৈনিকেরা পরিখা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া শুরু করে। শত্রু তিন দিক থেকে আমাদের ঘিরে রেখেছে। চতুর্থ দিক, অর্থাৎ পশ্চিম দিকে রয়েছে খোলা ফসলের খেত। ফসলহীন খেত শত্রুপক্ষ ফায়ার দিয়ে কভার করছে। গুলির আঘাতে ধুলা উড়ছে। এই গুলিবৃষ্টির মধ্য দিয়েই আমাদের বেরোতে হবে। অন্য কোনো পথ নেই। শত্রু আমাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে পশ্চিম দিকে গুলিবর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিল। আমরা তাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই রয়েছি। আমাদের অবশিষ্ট মেশিনগানসমূহ গুলিবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে তারা দেখেশুনে অ্যাইমড ফায়ার না করতে পারে।
সাড়ে চারটার দিকে আমি ও আনোয়ার আলাদা আলাদা গ্রুপে শুকনা খেতের মধ্য দিয়ে পার্শ্ববর্তী খিতিবদিয়া গ্রামের দিকে এগিয়ে গেলাম গুলিবর্ষণ করতে করতে। প্রায় আট শ গজ দূরে অবস্থিত গ্রামে পৌঁছেই দেখি এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। শত শত গ্রামবাসী কোদাল, খন্তা, কুড়াল, বর্শা ইত্যাদি দেশি অস্ত্র হাতে নিয়ে আমাদের অভিনন্দন জানিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে তারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে তারা ডাব, কলা ও গ্রামীণ খাবার দিয়ে আমাদের সৈনিকদের আপ্যায়ন করে। এখানেই এক সাংবাদিকের কাছে শুনলাম ঢাকায় গণহত্যা চালিয়ে বহু নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সেনারা।
বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি সেনারা আটক করেছে। চট্টগ্রামে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে ঘোষণা করেছেন। সারা দেশে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর সৈনিকেরা বিদ্রোহ করে প্রতিরোধসংগ্রাম গড়ে তুলেছে। অনির্বচনীয় আনন্দে ভরে ওঠে মন। এতক্ষণ ধারণা ছিল, দেশে একমাত্র আমরাই বিদ্রোহ করেছি। এর পরিণতি নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলাম। সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়েছে জেনে স্বস্তি বোধ করি। জনতার উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে শ্রান্ত-ক্লান্ত দেহে অসীম বল ফিরে পেলাম। আমরা ক্ষুদ্র দল নই, লাখ লাখ, কোটি দেশবাসী রয়েছে আমাদের সঙ্গে। বিজয় আমাদের হবেই।
চৌগাছার কাছাকাছি গিয়ে জানতে পারলাম, সীমান্তবর্তী এলাকার ইপিআর সৈনিকেরাও বিদ্রোহ করেছে। তারা আমাদের সৈনিকদের অভ্যর্থনা জানিয়ে নিকটস্থ মাসিলা বিওপিতে নিয়ে গেছে। স্থানীয় এক যুবক আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাসিলার উদ্দেশে। ইতিমধ্যে রাত গভীর হওয়ায় এক গ্রামে যাত্রাবিরতি করি। এক গৃহস্থের বাড়িতে রাত কাটিয়ে সকালবেলা পৌঁছে যাই মাসিলা বিওপিতে। ইপিআর সৈনিকেরা পুরি ও চা দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করে।
আমাদের বিদ্রোহী সৈনিকেরা ইতিমধ্যেই পৌঁছেছে সেখানে। তারা এসে আনন্দে জড়িয়ে ধরে আমাকে। কিছুক্ষণ পর পেলাম এক দুঃসংবাদ। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসার সময় খেতের মাঝামাঝি স্থানে লে. আনোয়ারের কোমরে শত্রুর মেশিনগানের বার্স্ট বিদ্ধ হয় এবং রক্তক্ষরণের ফলে সেখানেই সে শাহাদত বরণ করে।
সঙ্গের সৈনিকেরা তাকে বহন করে নিয়ে যায় হযরতপুর গ্রামে, কবি নজরুল ইসলাম কলেজের সামনে যশোর-কুষ্টিয়া মহাসড়কের পাশে তাকে দাফন করা হয়। নায়েক তাজুল ইসলাম তার রক্তমাখা বেল্টটি আমার হাতে তুলে দেয়। আমার বেল্ট খুলে আনোয়ারের বেল্টটি পরে নিই। তার তেজোদীপ্ত মুখমণ্ডল মানসপটে ভেসে ওঠে, ঐবৎড়বং ফরব ুড়ঁহম। গতকাল বলেছিল, সিওর সামনে গিয়ে বেল্ট খুলে চাকরিতে ইস্তফা দেবে, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সেই বেল্ট শহীদের রক্তে রঞ্জিত হলো।
চৌগাছার হাজার হাজার ছাত্র-যুবক পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্ত্তত, তারা শুধু অস্ত্র চায়। দেশের জন্য তাদের প্রাণ উৎসর্গ করার এই মনোভাব দেখে অভিভূত হলাম। একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেতৃত্বে গঠিত মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা সম্পর্ক অবহিত হলাম।
৩০ মার্চ ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর নেতৃত্বে ইপিআর ও ছাত্র-জনতা কুষ্টিয়ায় অবস্থানরত ২৭ বালুচের একটি কোম্পানিকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে। কোম্পানি কমান্ডার মেজর শোয়েব নিহত এবং লে. আতাউল্লাহ জীবিত অবস্থায় বন্দী হয়।
সকাল নয়টায় ১ম ইস্ট বেঙ্গলের বিদ্রোহী সৈনিকদের উদ্দেশে বক্তব্য দিলাম। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বর্ণনা করে তাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানালাম। ২০০ সৈনিক এবং ৯ জন জেসিও মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করার শপথ নেয়। জানালাম যে এখন থেকে তারা মুক্তিবাহিনীর সৈনিক, সামরিক বাহিনীর নিয়মকানুন-শৃঙ্খলা পেশাদার বাহিনীর মতোই তাদের প্রতি প্রযোজ্য হবে।
এভাবেই নবজন্ম লাভ করে ১ম ইস্ট বেঙ্গল, এক তরুণ অফিসারের নেতৃত্বে তারা স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
যশোর আমাদের বিদ্রোহ করার আধা ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা ৭ম ফিল্ডের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল ডা. আবদুল হাই এবং কোয়ার্টার মাস্টার ক্যাপ্টেন শেখকে হত্যা করে। ১ম ইস্ট বেঙ্গলের ১০০ সৈনিক ক্যান্টনমেন্টে থেকে যায়। তাদের বন্দী করা হয় এবং সপ্তাহ খানেকের মধ্যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। লে. কর্নেল রেজাউল জলিলকেও বন্দী করা হয় এবং কয়েক মাস পর পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ইপিআর উইং কমান্ডার মেজর ওসমান চৌধুরী চুয়াডাঙ্গায় বিদ্রোহ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ২ এপ্রিল তারিখে চুয়াডাঙ্গায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। আমরা সার্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করি। তিনি দুটি রিকোইলেস রাইফেল (ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র), জিপ ও চায়নিজ অ্যামুনিশন আমাকে দেন। এখানেই দেখা হলো আমার বাল্যবন্ধু মেহেরপুরের এসডিও তওফিক-ই-এলাহী চৌধুরী [বীর বিক্রম। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা] এবং ঝিনাইদহের মহকুমা পুলিশ অফিসার মাহবুব উদ্দিন আহমদের [বীর বিক্রম] সঙ্গে। তিন বন্ধু সারা রাত এসডিওর বেডরুমে শুয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময় করলাম। তওফিক মেহেরপুরে এবং মাহবুব ঝিনাইদহে পুলিশ ও আনসারদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চুয়াডাঙ্গার এসডিও সিন্ধি, সদ্য বিবাহিত। এ দম্পতির নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র বেডরুমে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, শুধু তারাই নেই। তওফিক বলল, ‘বহুবার এ দম্পতির উষ্ণ আতিথেয়তা উপভোগ করেছি, আজ তাদের বাঁচিয়ে রাখাই মুশকিল। উন্মত্ত জনতা তাদের হত্যা করতে চায়। এ দম্পতিকে মেহেরপুর কারাগারে রাখা হয়েছে জীবন রক্ষা করার জন্য।’ একসময় এ দম্পতিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
এক মহান সংগ্রামের পটভূমিতে তিন বন্ধুর পুনর্মিলন এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। পরদিন দুটি মিগ জেট বিমান এসে চুয়াডাঙ্গায় রকেট নিক্ষেপ করে। বিমান আক্রমণের মুখে অসহায় মেজর ওসমান বিনা প্রতিরোধে চুয়াডাঙ্গা ত্যাগ করে মেহেরপুরে রক্ষণব্যূহ গড়ে তোলেন।
৩ এপ্রিল ফিরে এলাম চৌগাছায়। বাজারকে পেছনে রেখে যশোরের দিকে মুখ করে প্রধান সড়কের ওপর রক্ষণব্যূহ তৈরি করি। স্থানীয় জনগণ আমাদের খাদ্য, রসদ ইত্যাদি জোগান দেওয়ার দায়িত্বভার গ্রহণ করে। মহেশপুরের খাদ্যগুদামের তালা ভেঙে স্থানীয় জনগণ চৌগাছায় যুদ্ধরত সৈনিকদের খাদ্য সরবরাহ করে।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে মাসিলা বিওপিতে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) কর্মকর্তা লে. কর্নেল মেঘ সিং, কমান্ডার মুখার্জি এবং ক্যাপ্টেন কে বি সিং। তাঁরা ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সব ধরনের সাহাঘ্য-সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দিলেন। মেঘ সিং ১৮ বিএসএফের সিও, ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডো অফিসার। ’৬৫-এর যুদ্ধে ‘বীরচক্র’ খেতাব পান। সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমাদের মধ্যে।
মেঘ সিংয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে আমার ব্যাটালিয়নকে বেনাপোল এলাকায় নিয়ে এলাম। যশোর-বেনাপোল মহাসড়কে (গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড) কাগজপুকুর গ্রামে যশোরের দিকে মুখ করে রক্ষণব্যূহ গড়ে তুলি। আমার ২০০ সৈনিক এবং ইপিআরের দেড় শ সৈনিক নিয়ে বাঙ্কার খুঁড়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তুলি। প্রধান সমস্যা যোগাযোগের মাধ্যম বেতারযন্ত্র না থাকা। মর্টারের অভাবে ডিফেন্স অনেকটা দুর্বল রয়ে গেল।
১৭ এপ্রিল আমি ও মেঘ সিং মেজর ওসমানের সঙ্গে দেখা করার জন্য ভারতীয় ভূখণ্ডে সড়কপথে যাত্রা করি। সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে মেহেরপুরের পতন ঘটে। ওসমান ও ইপিআর বাহিনী ভারতীয় বিওপি বেতাইতে অবস্থান নেন।
মিসেস ওসমান অত্যন্ত সাহসী নারী। এহেন দুর্যোগের মধ্যেও তিনি আমাদের সুগৃহিণীর মতো মাংস-পরোটা দিয়ে আপ্যায়ন করেন। ওসমান জানালেন, সেদিন দুপুরে সদ্য গঠিত বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করবে।
*হাফিজ উদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রম: জন্ম ২৯ অক্টোবর ১৯৪৪, ভোলা। প্রথমে ৮ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। পরে জেড ফোর্সের মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। স্বাধীনতার পর মেজর হন। পরবর্তীকালে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়। প্রকাশিত বই সৈনিক জীবন: গৌরবের একাত্তর, রক্তাক্ত পঁচাত্তর; রক্তেভেজা একাত্তর; গৌরবাঙ্গন।
*সৈনিক জীবন: গৌরবের একাত্তর, রক্তাক্ত পঁচাত্তর (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২০, প্রথমা প্রকাশন) গ্রন্থ থেকে