পরবর্তী প্রজন্মের চোখে

যুদ্ধের রণাঙ্গনে, ১৯৭১। ছবি: সংগৃহীত
যুদ্ধের রণাঙ্গনে, ১৯৭১।  ছবি: সংগৃহীত
>মুক্তিযুদ্ধের রক্ত ও অশ্রু যাঁরা দেখেননি, তাঁরা কেমন করে অনুভব করেন মুক্তিযুদ্ধকে? এ দেশ নিয়ে কী তাঁদের ভাবনা? বিভিন্ন অঙ্গন থেকে জানাচ্ছেন স্বাধীন বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের কয়েকজন

‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’ 
মাহমুদুজ্জামান বাবু

মাহমুদুজ্জামান বাবু

২০০৫ সালের একটি ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রথমবারের মতো আমাকে অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে তখন অনেক তরুণ-তরুণী সেই সময়ের বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনে কাজ করছিলেন। তাঁদের অনুষ্ঠান পরিকল্পনার চমত্কারিত্ব, প্রযোজনার মুন্সিয়ানা এবং আঙ্গিক বিন্যাসের অন্য আলোয় উদ্ভাসিত দর্শকের একটা রুচিগত পরিবর্তনও ঘটছিল সাড়া ফেলে। সে বছরের ২৫ মার্চ স্মৃতিতে নিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের বন্ধুপ্রতিম প্রযোজক যখন প্রাথমিক পরিকল্পনা জানালেন, আমি সম্পৃক্ত হলাম সেই উদ্যোগের সঙ্গে। সিদ্ধান্ত হলো, অনুষ্ঠানের নাম হবে ‘কালরাত্রি’। সাক্ষাত্কারভিত্তিক এই অনুষ্ঠানে যুদ্ধে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও ব্যক্তির বয়ানে আমরা বেদনা ও বিজয়ের কথা তুলে আনব দর্শকের সামনে। অনুষ্ঠানের জন্য সাক্ষাত্কার নেওয়া হলো বীরাঙ্গনা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, ইলা মজুমদার, সারা মাহমুদ ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের। পণ্ডিত বারীণ মজুমদার ও ইলা মজুমদারের মেয়ে মধুমিতা হারিয়ে যান একাত্তরেই। সারা মাহমুদ শহীদ আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী। বীরাঙ্গনা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী নির্যাতিত হন বন্দিশিবিরে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল হারান তাঁর বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবী ফায়জুর রাহমানকে। মনে পড়ে, অনুষ্ঠানটির সম্পাদনা শেষে সম্প্রচারের আগে একটুখানি দেখে সহ্য করতে না পেরে টেলিভিশন ভবন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হিসেবে নিজের ত্রুটি আছে কি না, তা যাচাই করতেই দেখতে চাওয়া কিন্তু, তাই বলে এত কষ্ট!

সম্প্রচারের বেশ কয়েক দিন পরে একজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের সঙ্গে দেখা হলো। পূর্বপরিচিত এই মানুষটি যখন বিভিন্ন আয়োজনে একাত্তরের জনযুদ্ধের গণযোদ্ধাদের কথা বলতেন, খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষের অসাধারণ বীরত্ব ও অপরিসীম আত্মত্যাগের কথা বলতেন, সমবেত শ্রোতা-দর্শকেরা একই সঙ্গে তখন অগ্নিগমর্ভর মতো জ্বলে উঠতেন এবং সমুদ্রের নোনাজলে ভাসতেন। আমরা বহু আয়োজনে দেশজুড়ে একসঙ্গে ঘুরেচি। উপলক্ষ, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা কথা ও গানে ছড়ানো। কাঁদানো এবং জাগানো। তো, এবার দেখা হওয়ার পর তিনি থমথমে মুখাবয়ব নিয়ে বললেন, ‘আপনার অনুষ্ঠান দেখেছি। ওই মহিলাকে অনুষ্ঠানে এনে তো আপনি মুক্তিযুদ্ধের ইজ্জত মেরেছেন।’ আমার হতভম্ব চেতনা ও অসার শ্রুতি শুনতে থাকে তাঁর কথা। ‘ওই মহিলার কোনো আত্মসম্মানবোধ আছে? থাকলে কেউ নাতি-নাতনির বয়সীদের সামনে নিজের ধর্ষণের কাহিনি বলে?...’ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এবং মুক্তিযুদ্ধের সামরিক বাহিনীর জাদুঘরের দায়িত্বে থাকা সেই ক্ষিপ্ত মুখাবয়বের দিকে যেই চোখ আমি পেতেছিলাম সেদিন, আজ অবধি সেই চোখ দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের পরের বাংলাদেশ দেখছি।

মুক্তিযুদ্ধে রক্তস্নাত বিজয়ের পর ৪৮ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। এই দীর্ঘ সময়ে কত থানা শহর উপজেলা, মহকুমা শহর জেলা, জেলা শহর বিভাগ হলো। কত নতুন সড়ক, সংযোগ সড়ক, উড়ালসড়ক, প্রমত্তা নদীর বুক চিরে সুদীর্ঘ সড়ক-রেলসেতু হলো। হচ্ছে। বড় শহরগুলোতে আকাশমুখী অপরিকল্পিত আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন উঠল। একদল মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হলো। দেশের টাকা পাচার হয়ে বিদেশে গেল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হলো। শিক্ষিত বেকারের সূচক ঊর্ধ্বগামী হতে থাকল। বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদ খুন হতে থাকল। কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, ভোগবাদ, স্বার্থপরতার বাইরে যেন আর কোনো স্বর ও ধ্বনি নেই। একটা ধর্ষকামী মনস্তত্ত্বের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম্মান ও নিরাপত্তাহীনতা এখন গা-সওয়া ও স্বাভাবিক। শোষণ ও দুঃশাসন দূর হওয়া দূরে থাক, রাজনৈতিক ও সামাজিক জবরদস্তির থাবায় ছিন্নভিন্ন সমস্ত মানবিক বোধ ও উচ্চারণ। মুক্তিযুদ্ধ এই সবকিছুর অবসান চেয়েই তো সেদিন বিজয়ী হয়েছিল।

রক্তের দাগ না শুকাতেই আমরা ঘাতকদের-বিশ্বাসঘাতকদের ক্ষমা করেছিলাম। উদারতাবাদের নামে আমরা ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’কে পুনর্বাসিত করেছি শ্রেণিস্বার্থে। শ্রেণিস্বার্থেই যদি না হবে, তাহলে চটকলের শ্রমিক মুক্তিযোদ্ধা, লাঙল ফেলে যাওয়া কৃষক মুক্তিযোদ্ধা, আর নিরুপায় ধর্ষিত হওয়া বীরাঙ্গনারা বিষপান বা গলায় দড়ি দিয়ে মরলেন কেন—উপেক্ষায়-নিন্দায়-অনাচারে? আমাদের উদারতাবাদ ও মানবতাবাদ এত অশ্লীল কেন?

এ রকম বহু কান্না ও অসহায়ত্বের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কথা ছিল, আমাদের উচ্চারণ হবে তীক্ষ্ম-শাণিত-অগ্নিগর্ভ। এখন বাস্তব ঠিক তার উল্টো। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী দেশে এখন আমরা কথা বলি এমন স্বরে, যেন আমাদের দুধের দাঁত পড়েনি। কবি আসাদ চৌধুরী লিখেছেন, ‘নদীর জলে আগুন ছিলো/ আগুন ছিলো বৃষ্টিতে/ আগুন ছিলো বীরাঙ্গনার/ উদাস করা দৃষ্টিতে/...এখন এসব স্বপ্নকথা/ দূরের শোনা গল্প/ তখন সত্যি মানুষ ছিলাম/ এখন আছি অল্প।’ এই ‘অল্প মানুষ’ দিয়ে কিছুই হয় না। ৪৮ বছরে স্বদেশ এখন শ্বাপদের অভয়ারণ্য হয়েছে। তা-ই তো কথা ছিল বোধ হয়।

মাহমুদুজ্জামান বাবু: সংগীতশিল্পী

অর্জিত অভিজ্ঞতা, অর্পিত স্মৃতি
সুমন রহমান

সুমন রহমান

ছোটবেলায় শুনেছি, আমার বাবা–মাকে আত্মীয়স্বজনেরা ‘মিলির বাপ’ ‘মিলির মা’ বলে ডাকতেন। মিলি আমার বড় বোন। আড়াই বছর বয়সে মারা যায়। তার ছবি, ব্যবহার্য কাপড়চোপড়, জুতা ইত্যাদি বহুদিন পর্যন্ত আমাদের ঘরে নিত্য আসবাবপত্রের মতো ছিল। বড় হয়ে বুঝেছি, মিলির মৃত্যুর ছায়ার মধ্যেই আমি ভীষণভাবে বড় হয়ে উঠেছিলাম। মিলি আমার মা–বাবার খুব প্রিয় সন্তান ছিল। তাকে হারানোর ফলে যে বৈরাগ্য তৈরি হলো তাঁদের মনে, আমার শৈশব দিয়ে তার অভাব পূরণ হলো না। মিলি মারা যায় হামজ্বরে, ১৯৭১ সালে। দাদির ভাষায়, সংগ্রামের বছরে। আমার তখন এক বছর বয়স। এক বছরের স্মৃতি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্মৃতিধরেরও মনে থাকার কথা না। কিন্তু আমার চোখে সবকিছু যেন ছবির মতো ভাসে! মুক্তিসংগ্রামের বছর। আমার বোনের মরে যাওয়া। অর্জিত অভিজ্ঞতা নয়, অর্পিত স্মৃতি।

এই স্মৃতির অর্পণ কতভাবে ঘটে! যুদ্ধ যখন গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে যেতে থাকল, তখন অন্য অনেক পরিবারের মতোই আমাদের পরিবারের শক্তসমর্থ তরুণ-যুবারা জীবনদানের যুদ্ধে গেল। বৃদ্ধ, অশক্ত, নারী ও শিশুরা জীবনরক্ষার যুদ্ধ বেছে নিল। এই বৃহত্তর দলের দায়িত্বে ছিলেন আমার বাবা। ছোট ভাইয়েরা তাদের পরিবারকে তাদের বড় ভাই অর্থাৎ আমার বাবার জিম্মায় রেখে আখাউড়ায় প্রশিক্ষণে চলে গেল। আর বাবা একটা অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। তিনি নুহের নৌকার আদলে বিশাল একটা বজরা বানালেন (বা সেটা কোনো বড়সড় মহাজনি নৌকাই হবে, তিনি কাস্টমাইজ করে নিলেন)। সেই বজরায় কয়েকটা শোবার ঘর, রান্নাঘর, গোসলখানা, টয়লেট ইত্যাদির ব্যবস্থা ছিল। যখন পাকিস্তানি বাহিনী লালপুর-বাইশ মৌজার দিকে আসতে শুরু করল, তিনি পরিবারের সব নারী-শিশু-বয়স্কদের দিয়ে ভাটিবাংলার বিস্তীর্ণ হাওরে ভেসে গেলেন। তত দিনে বর্ষাও এসে গেছে বাংলায়। জলে-অপটু পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে ভরা বর্ষার বিশাল হাওরে ধাওয়া করে আমাদের মেরে ফেলা নিশ্চয়ই খুব সহজ কাজ ছিল না।

যুদ্ধের শেষ দিকে আমার বড় বোন মিলি হামজ্বরে মারা যায়। ওর বয়স তখন মাত্র আড়াই বছর। জলে-ভাসা জীবনে ওর কাজ ছিল আমাকে চোখে চোখে রাখা। এক বছর বয়স, কখন হামাগুড়ি দিয়ে টুপ করে হাওরের জলে তলিয়ে যাই! আমার সেই বোনটি আমাকে পাহারা দিত। ভয়ে তার ঘুমই হতো না। ওর অতন্দ্র পাহারার কারণেই আমার পক্ষে আজও মরে যাওয়া সম্ভব হলো না। অথচ সে-ই মরে গেল, মাত্র তিন দিনের হামজ্বরে। মুক্তিসংগ্রামের বছরে।

মিলি মারা যাওয়ার পরদিন আমাদের বজরা গ্রামের ঘাটে এসে লাগে। নৌকা থেকে মিলির নিথর দেহ কোলে করে নেমে আসছেন বড় কাকা। বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে অন্যরা। একটা শান্ত দিন। কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই। শুধু ব্রহ্মাজুড়ে একটা বিশাল চিৎকার যেন ফ্রিজ হয়ে আছে। কেউ টোকা দিলেই ভেঙে হাজার টুকরো হয়ে নীহারিকাময় ছড়িয়ে পড়বে!

এই যে দৃশ্যটির কথা বললাম, এটিই আমার মুক্তিযুদ্ধের ব্যক্তিগত স্মৃতি। কিন্তু আমি তো এই দৃশ্য দেখিনি! মানে, মিলির মৃতদেহের বাড়ি ফেরার দৃশ্যটি—এটির কথা আমাকে কেউ বলেনি। বহুদিন পর, কিশোর বয়সে একদিন গ্রামের বাড়িতে এসে, নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমি আনমনে এই দৃশ্যটি বানিয়েছিলাম। তারপর থেকে এ দৃশ্যটি আমার অভিজ্ঞতার অংশ। এটি যে অর্জিত অভিজ্ঞতা নয়, অর্পিত স্মৃতি। এর মধ্যে কোনো জোরাজুরি নেই, থাকলে ‘আরোপিত’ স্মৃতিও বলা যেত। অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসব স্মৃতি ব্যক্তির নিভৃতির অংশ হয়ে বেঁচে থাকে। এ লেখাটি না লিখলে হয়তো আমি বুঝতেই পারতাম না।

বজরার ঘটনাটিও এমনই। এ গল্পটি দাদি করতেন। সংগ্রামের সময়ে তিনিও আমাদের সঙ্গে বজরায় বসত করতেন। ছোটবেলায়, তাঁর মুখ থেকে এই গল্প শুনতে শুনতে একদিন আমার মনে হলো, আমি জানি বিষয়টা! আমার স্মৃতি থেকে একটা ঝাপসা ছবি একদিন ঝাপট দিল। ছবিটি এমন: আমি শুয়ে আছি পাটাতনে, আর ছইয়ের ওপরে কোথাও একটা হারিকেন আটকানো। নৌকার দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে ওটা ডানে-বাঁয়ে দুলছে। অদ্ভুত বিষয় হলো, হারিকেনের গল্পটা আমাকে কেউ বলেননি। আমি পরে মাকে জিজ্ঞাসা করেছি। যুদ্ধের সময়ের গল্প আমার মা-বাবা কেউই বলতেন না। মিলির মৃত্যুশোকই এর কারণ, অনুমান করি। পরবর্তী সময়ে নানাজনকে জিজ্ঞেস করেছি। হারিকেনের ব্যাপারটা তাঁদের কেউই নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারলেন না। আর দাদির গল্পের মধ্যে ছইয়ে আটকানো হারিকেনের ডানে-বাঁয়ে দোলার মতো কাব্যিক ব্যাপার থাকার কোনো কারণই নেই। তিনি খুব সংক্ষেপে নিখাদ আতঙ্ক আর ভোগান্তির গল্প বলতেন। ফলে, অনুমান হয়, এটিও আমি হয়তো বানিয়ে নিয়েছি। অন্য কোনো সময়ে অর্জিত অন্য কোনো অভিজ্ঞতা থেকে কেটে এনে এই দৃশ্যটিকে একাত্তরের কোনো গ্রামের ঘাটে বসিয়ে দিয়েছি! হতে পারে। কিন্তু সেটা জানা জরুরি না।

এর বাইরে মুক্তিযুদ্ধের যে মহা-আখ্যান, তার সুপারস্টোরের কোনো অচলিত র​্যাকে আমি আমার সামান্য গল্পগুলোকে জমা রাখি। আখ্যানকে বিব্রত করার জন্য নয়। বরং নিজের অর্পিত অভিজ্ঞতাকে এর অংশ হিসেবে একা একা পাঠ করার জন্য। আমার এসব অর্পিত স্মৃতির মায়ায় মহা-আখ্যানকেও অনেক মায়াময় মনে হয়। একান্ত নিজের অর্জনের মতোই লাগে।

‘আমরা স্বাধীন’—মুক্ত এলাকায় আনন্দে উৎফুল্ল জনতা। ছবি: রবিন সেনগুপ্ত

সুমন রহমান: কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক

‘একটি ফুলকে বাঁচাব বলে’
সায়ান

সায়ান

আমার জন্ম ১৯৭৬ সালে। নিজের চোখে আমি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। আমার ধারণা, আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্মেছি, মুক্তিযুদ্ধকে আবিষ্কারের জন্য আমাদের একটা বাড়তি সুবিধা আছে। সরাসরি দেখিনি বলেই আমাদের চোখের চশমাটি খানিকটা বিস্তৃত ও নির্মোহ। কেননা, মুক্তিযুদ্ধ ‘না দেখা প্রজন্ম’ হিসেবে বেড়ে উঠতে উঠতে আমরা অনেকেই বারবারই এমনটা দেখেছি যে যাঁরা নিজেদের চোখ দিয়ে কিছুটা দেখেছেন, তাঁরা শুধু নিজেদের দেখা দৃশ্যটিকেই বড় করে দেখেছেন, শুধু সেটিকেই আঁকড়ে থেকেছেন, শুধু সেই গল্পটিই বারবার বলেছেন। অন্যের দেখাকে নিজের দেখার চেয়ে ছোট করে দেখা কিংবা অগ্রাহ্য বা বাতিলের সুপ্ত বা প্রকাশ্য প্রবণতা তাঁদের থাকাটা তাই অস্বাভাবিক কিছু নয়। এর যৎসামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে আমরা বড় হয়েছি এই দেখে দেখে যে মুক্তিযুদ্ধের লিখিত ও কথ্য ইতিহাস পরিবর্তিত হয়েছে নানা খেয়ালখুশিতে।

মুক্তিযুদ্ধের গল্প আমার কাছে সে কারণেই অসংখ্য উৎস থেকে পাওয়া ইতিহাস, যার ভেতরে আছে নানা অস্পষ্টতা। পরের প্রজন্মের পাঠক হিসেবে এর সত্য–মিথ্যা নির্ভুলভাবে যাচাই করার উপায় আমার কাছে সে অর্থে নেই। আমাকে তাই অনেক ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হয়েছে গল্প–বলিয়ের চরিত্র বিশ্লেষণের ওপর। যিনি আমাকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছেন, গল্পের বিষয়বস্তু না শুনে বারবার আমি নিজেকে আবিষ্কার করেছি কঠোর কোনো পরীক্ষকের ভূমিকায়; গল্পকারের যোগ্যতা বিচারের তদন্তকারীর ভূমিকায়। মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী কয়েক দশকের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে এই অবিশ্বাস আমরা পেয়েছি অনেকটা উত্তরাধিকার সূত্রে। আক্ষেপের বিষয়, এই প্রক্রিয়ায় গল্প–বলিয়েদের অন্ধ পক্ষপাতপূর্ণ রাজনৈতিক সাযুজ্যের ঐতিহ্যের স্রোতে, তাঁরা তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমনভাবে হারিয়েছেন যে তাঁদের সম্পূর্ণ বয়ানে প্রজন্মগতভাবেই আমরা অনাগ্রহী ও উদাসীন হয়ে পড়েছি। কোনো ইতিহাসবিদ কী বলছেন, সেটি গৌণ হয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে তিনি কাদের হয়ে কথা বলছেন সে পরিচয়টি। ইতিহাসবিদের যে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য রাখার একটি দায়িত্ব আছে, নিজের পক্ষপাত স্পষ্ট রেখেও যা করা সম্ভব বলে মনে করি; বেদনার বিষয়, আমরা অনেকেই তেমনটা দেখতে পেয়েছি খুব কম।

এমন একটি অবস্থায় তাই আমরা অনেকেই আমাদের নিজস্ব সন্দেহ, প্রশ্ন ও পক্ষপাতের ছাঁকনি দিয়ে এবং গল্প–বলিয়েদের বিশ্বাসযোগ্যতার ছাঁকনির ওপর ভিত্তি করে নিজেদের মুক্তিযুদ্ধকে পুনর্নির্মাণ করে নিয়েছি। তার মধ্যে সংগত কারণেই বড় বড় ফাঁক রয়ে গেছে। তবু নানাজনের স্তুতি দিয়ে সাজানো নানা সময়ের ক্ষমতাসীনের পৃষ্ঠপোষকতায় বহুল প্রচারিত জোড়াতালিমারা গল্পের চেয়ে এই অসম্পূর্ণ, সংশয়কাতর, অস্পষ্ট ও ছাড়া ছাড়া গল্পগুলোই আমাদের অনেকের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। অন্ধ, গোঁড়া, পক্ষপাতদুষ্ট উত্তরদাতাদের উত্তরের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের প্রশ্নজড়ানো অনুসন্ধিৎসাকে আমরা বেশি গুরুত্বের জায়গায় রাখতে চাই।

এ রকম একটি প্রজন্মের একজন সত্যাগ্রহী উৎসুক নাগরিক ও শিল্পী হিসেবে আমার জ্যান্ত সব জিজ্ঞাসা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে ইতিহাসের পাতার চেয়েও বেশি খুঁজেছি কবিতায়, সাহিত্যে, নাটকে, গানে, সিনেমায়, নানা দেশি–বিদেশি প্রতিবেদনে, একাত্তরকে যাঁরা তাঁদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করেছেন তেমন সাধারণ মানুষের ভাষ্যে—যাঁরা তাঁদের ভাষ্য প্রচার করে কখনো কোনো সুবিধা চাননি।

এ অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে এই সিদ্ধান্তে স্থির হয়েছি যে মুক্তিযুদ্ধের কোনো একটি রূপ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাইলে আমিও সেই গোঁয়ার্তুমির ধারাবাহিকতাকেই পুষ্ট করব, যাঁরা সমান্তরাল আর সব ভাষ্যকে অগ্রাহ্য করে কেবল তাঁর নিজের গল্পটিকেই ‘পূর্ণ ইতিহাস’ করে রাখতে চান। খেয়াল রাখা দরকার, আমরা এমন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতার ভেতরে বসবাস করি, যেখানে মুক্তিযুদ্ধকেও একটি মুনাফার উপকরণ করার চেষ্টা চলে। মুক্তিযুদ্ধকে এই কারবারিদের কাছ থেকে নিজেদের মতো করে নেওয়ার জন্য আমাদের প্রজন্মকে অনেক কসরত শিখতে হয়েছে।

এত সব ভালো–মন্দ মিলিয়েই আমার প্রাণের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ এখনো আমার কাছে একটি গান, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।’ আপাতত এটুকু নিশ্চিত জানি, আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। ভৌগোলিক স্বাধীনতা, একটি পতাকা, একটি নাম, একটি পরিচয়, মানচিত্রে একটি আলাদা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি আমরা নিশ্চয়ই পেয়েছি। এ জন্য কৃতজ্ঞতা রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সব কুশীলবের কাছে—যাঁদের কাউকে আমরা চিনি, আবার অধিকাংশকেই চিনি না, তাঁদের কেউ কেউ প্রচারের আলোয় আসতে পেরেছেন, অনেকেই পারেননি।

সেই ফুলকে বাঁচিয়ে রাখার যাত্রা বা সেই বৃহত্তর মুক্তির যুদ্ধ নিশ্চয়ই এখনো চলমান। আমরা দেখেছি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে নিদারুণ অবহেলায় ও দারিদ্র্যে ক্ষয়ে যেতে। আমরা দেখেছি মুক্তিযুদ্ধে না গিয়েও কোনো কোনো ব্যক্তিকে দেয়ালে সনদ ঝুলিয়ে বানানো গর্বে বুঁদ হয়ে থাকতে। আমরা দেখেছি, একদিন যিনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন মৃত্যুর সব আশঙ্কা বরণ করে নিয়ে, তেমন কাউকে কাউকে স্বাধীনতার পরে লোভের কাছে আত্মসমর্পণ করতে। আমাদের কাছে এসব গল্পের মিশ্রণ এক দৃশ্যমান বাস্তবতা।

যুদ্ধের বিনিময়ে পাওয়া এই ফুলটির একটি পাপড়িও যদি মুমূর্ষু থাকে, আমাদের আনন্দ কীভাবে পূর্ণ হতে পারে? যেদিন আমার স্বাধীন বাংলাদেশের সব কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ নাগরিক খেয়ে–পরে প্রাণ থেকে বলবেন, ‘আমরা ভালো আছি’; সেদিন যুদ্ধের বিনিময়ে পাওয়া এই ফুলটির সৌন্দর্য ও ঘ্রাণ পূর্ণতা পাবে।

সায়ান: সংগীতশিল্পী

বিজ্ঞাপনের মাস
মাহা মির্জা

মাহা মির্জা

ভিআইপি রোডে রিকশা ঢুকে পড়লে টায়ার ফুটো করে রিকশা উল্টে দেওয়ার নিয়ম। মাঝেমধ্যে ফুটপাতে সারি সারি উল্টো রিকশা দেখতে দেখতে ভাবি, দেশটা আসলে কাদের হওয়ার কথা ছিল? ‘ভিআইপি’দের?

লেখাটি যখন লিখছি, ১১ দফা দাবিতে মিলগেটে অনশন করছেন খুলনার শত শত পাটকলশ্রমিক। ১১ দফা যেন কী ছিল? ১৯৬৯ সালে? পাটকলশ্রমিকদের কথা কী যেন লেখা ছিল সেখানে!
এ বছর ধানের উৎপাদন খরচ ৭৫০ টাকা, কৃষক ধান বেচেন ৫৫০ টাকায়। উল্টো রাজার দেশে এটাই নিয়ম। কৃষক বুক চাপড়ান, নিদারুণ অভিমানে খেতের আলু, ফুলকপি রাস্তায় ফেলে দেন। কিস্তির টাকা শোধ করতে না পেরে কেউ হয়তো গলায় দড়ি দেন আর পুলিশ কারও পেটে দড়ি বাঁধে। তবু পরের বছর আবারও তীব্র মমতায় বীজতলা বানান কৃষক। ধান বোনেন, ঘাম ঝরান। আর ভর্তুকি দিয়ে একটা বিকারহীন জাতিকে যুগ যুগ ধরে খাওয়ান। মুক্তিযুদ্ধের ৪৮ বছরের মাথায় মহাকাশে স্যাটেলাইট গেছে, ১৮তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ হয়েছে বাংলাদেশ। আর পৃথিবীর সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের তালিকায় আমরাও আছি সামনের সারিতে। কিন্তু আমাদের খাওয়াতে খাওয়াতে উন্নয়নের এক্সপ্রেস হাইওয়েতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছেন ভাতের জোগান দেওয়া কৃষক।

সাদা–কালো ছবিতে দেখেছি, কাঁছা বেঁধে মেশিনগান ঝুলিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন কৃষক। সেই একই কৃষক ধানের দাম না পেয়ে কালো প্যান্টে নীল শার্ট গুঁজে রাজধানীর সিকিউরিটি গার্ড হন, ফুটপাতে কাপড় বেচেন, রিকশা চালান। ২৯টি কয়লা প্ল্যান্ট আর ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের বদলে আজীবনের বসতভিটা আর হেমন্তের ধানখেত হারিয়ে পোকামাকড়ের মতো নিখোঁজ হয়ে গেছেন লাখো চাষি। শিরোনাম বরাদ্দ হয়নি।

তো এই হলো আপনাদের ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে’? ডিজিটাল বাংলাদেশ, উন্নয়নের মহাসড়ক, সোনার বাংলা, আর কী কী যেন বলেন আপনারা? এই হলো তার নমুনা।

বারো মাসে এক হাজারের বেশি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে এ দেশে। বিচার হয়নি।

এখানে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর গলা টিপে মেরে ফেলা সব স্বাভাবিক। আর বিচার না হওয়াটা আরও স্বাভাবিক। এই রাষ্ট্র দ্রুত বিচার আইনেও ৯৭ ভাগ ধর্ষণের বিচার করতে পারে না। এই রাষ্ট্র ঘুষ খেয়ে ভিকটিমের মামলা ঘুরিয়ে দেয়। এই রাষ্ট্র কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় খুব এগিয়ে যাচ্ছে! কী অদ্ভুত! এ দেশে ১৯৭১–এর গণহত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ডিজিটাল বাংলাদেশে ন্যায়বিচার আর কোথায়?

আসলে এভাবে হয় না। লাল–সবুজ ব্যান্ডানা বেঁধে জাতীয় সংগীত গাইলাম, আর গিনেস বুকে নাম ওঠালাম, এটাই কি হতে পারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? রহিম–করিমের রেমিট্যান্সের জোরে টিকে আছে লুটপাটের ধাক্কায় নড়বড়ে অর্থনীতি। মরুর দেশের তীব্র তাপে খেটে খেটে শেষ হয়ে গেছেন এই মানুষগুলো। দূতাবাস, সরকার, রাষ্ট্র—কেউ তাঁদের পাশে থাকেনি। তবু গুনে গুনে পাঠিয়ে গেছেন ডলার। বছরে এক লাখ কোটি টাকা রেমিট্যান্স! ভাবা যায়? নইলে বাঁচত এই দেনাগ্রস্ত ফ্লাইওভারের দেশ? বড় কষ্টে পাঠানো এসব ঘামে ভেজা নোট দিয়ে আমরা চীন থেকে সাবমেরিন কিনেছি, রাশিয়া থেকে যুদ্ধবিমান কিনেছি। আধপেটাদের শহরে শয়ে শয়ে বিএমডব্লিউ আমদানি করেছি। আর বাকিটা পাচার করে দিয়েছি বিদেশে। এত দুর্নীতি, এত অসততা, এত বৈষম্য, এত জুলুম। তারপরও এই দেশকে আহ্লাদ করে সোনার বাংলা ডাকতে হবে? হ্যালো বাংলাদেশ, হ্যালো? পারভীনের ছেঁকা খাওয়া বুক, রোকসানার ভাঙা হাত–পা, সালমা বেগমের ধর্ষিত শরীর, আর ১৩ বছরে দেশে ফেরত আসা ৩৩ হাজার তরুণ–তরুণীর কফিনের ওপর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তোমার উন্নয়ন। রানা প্লাজা আর তাজরীনের কঙ্কালগুলোরও আঙুল ছিল। ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পৃথিবীর সর্বনিম্ন মজুরিতে সেলাই করে বিদেশি ডলার কামাই করে এনেছিলেন তাঁরা। দিনের পর দিন কুঁজো হয়ে বসে ওভারটাইম করা এসব মেয়ের মেরুদণ্ডের তীব্র ব্যথার ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে তোমার ৮ পার্সেন্ট জিডিপি। কোথায় বিবেক আমাদের? কোথায় লজ্জা? কীসের এত অহংকার? কীসের উন্নয়ন?

একদিন বড় বেশি রক্তে ভেসেছিল এই দেশ। এত এত মানুষের লাশ, এত এত ধর্ষিত মেয়ে, এত এত শরণার্থীর দীর্ঘ পথ হাঁটা, এত অবর্ণনীয় দুঃখ–কষ্ট আর অসম্ভব দাম দিয়ে কেনা একটু টুকরো স্বাধীন ভূখণ্ড, সেটাকে বেচতে বেচতে ও লুটতে লুটতে এক অদ্ভুত ইটপাটকেলের গ্যাসচেম্বার বানিয়েছি আমরা। এখানে নোট আছে, কংক্রিট আছে, ফ্লাইওভার আছে; শুধু কোথাও কোনো সততা নেই।

নৈরাশ্যবাদী লেখা লিখতে চাইনি, কিন্তু দেশ ভালো নেই। ভেঙেচুরে গেছে সবকিছু। আমাদের সংবাদমাধ্যম, আমাদের নদী, আমাদের বাতাস, আমাদের বনভূমি, আমাদের রাজধানী। আমাদের প্রজন্ম, আমাদের চাপা ক্ষোভ, আমাদের মেরুদণ্ড। ভালো নেই, কেউ ভালো নেই। যাদের কিছু দেওয়ার ছিল, তাদের ভাঙা মেরুদণ্ড, তাদের সীমাহীন দৈন্য দেখি।

মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান, মুক্তিযুদ্ধের ১১ দফা, আর মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা, কোনো কিছুরই প্রতিফলন নেই ডিসেম্বরের দিনগুলোয়। দেখি বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে যাওয়া ডিসেম্বর। কথা ছিল, জুলুমের দিনগুলোতে আমরা তীব্র ক্ষোভে ও রাগে ফেটে পড়ব। কথা ছিল, রাজনীতি আমাদের হবে। কথা ছিল, ‘আমাদের ধর্ম হবে ফসলের সুষম বণ্টন।’
হয়নি। কেউ কথা রাখেনি।

মাহা মির্জা: গবেষক ও লেখক