স্বাধীনতা আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন, সবচেয়ে গৌরবের, সবচেয়ে বেদনার। লাখো শহীদের রক্তে ভেজা, কত মা-বোনের আত্মত্যাগ আর নারী নির্যাতনের বিনিময়ে পাওয়া, কত অশ্রু, কত আনন্দ-বেদনার রক্তকুসুমে গাঁথা বিজয়ের এই নির্মাল্যখানি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুধু অস্ত্রের লড়াই ছিল না, এ ছিল আদর্শের লড়াই। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংগ্রামের লড়াই। একটি জাতিকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য, অস্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য, মেধাশূন্য করার জন্য পরিকল্পিত একটি হত্যাকাণ্ড। অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত ঘৃণ্য পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সম্পূর্ণ নিরস্ত্র বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর।
শুরু করেছিল নারকীয় গণহত্যা। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বাঙালি তুলে নিয়েছিল অস্ত্র। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ঘোষণা ও দিকনির্দেশনায় চেতনার জাগরণে বাঙালি খুঁজে পেয়েছিল মুক্তির পথ, সূচনা হয়েছিল স্বাধীনতাসংগ্রামের। এক কাতারে ছিল ছাত্র-জনতা-কৃষক-শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, সামারিক ও অসামরিক সর্বস্তরের মানুষ। কে নয়? দেশের জন্য প্রচণ্ড ভালোবাসা না থাকলে এ যুদ্ধ সম্ভব হতো না।
১৯৭১ সালে আমি আর্ট কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। শিল্পচর্চায় নিবেদিত মনপ্রাণ, উনসত্তরের উত্তাল দিনগুলো, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের গণজাগরণের ঢেউ যে শিল্পভাবনায় বিশাল আঘাত করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। ঘরকুনো শান্তিপ্রিয় মানুষ আমি উত্তাল ঢেউয়ের স্রোতে ভেসে জড়িয়ে পড়লাম সভায়, মিছিলে, ফুঁসে ওঠা প্রতিবাদে। চারুশিল্পীরা ৮ মার্চ সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। ১৭ মার্চ অসহযোগ চলাকালীন তাঁরা শহীদ মিনার থেকে এক বিশাল মিছিল বের করেন পোস্টার, ব্যানার ও চিত্রসংবলিত। স্বা ধী ন তা—এই চারটি অক্ষর চারজনের গলায় ঝুলিয়ে মিছিলের পুরোভাগে থেকে মিছিলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। এই চারজনের মধ্যে প্রথম ‘স্বা’ অক্ষরটি বুকে তুলে নিয়েছিলাম আমি, ‘ধী’ ধারণ করেছিলেন শিল্পী সামিদা খাতুন (১৯৭১ সালে প্রয়াত), ‘ন’ তুলে নিয়েছিলেন শিল্পী পিনু খান এবং ‘তা’ বুকে তুলে নিয়েছিল আমার বোন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সুলতানা কামাল। সে সময় আমরা এই মিছিলে অংশ নিয়েছিলাম যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণের সব রকম ঝুঁকি নিয়ে, প্রাণের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও।
২৫ মার্চের পর আমরা, পরিবারের অন্যরা ও ঢাকায় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করা, খবর পৌঁছানো, অস্ত্র লুকিয়ে রাখা, রেশন তুলে মুক্তিযোদ্ধাদের পৌঁছানো, নানাজনকে সীমান্ত পারাপারে সাহায্য করা ইত্যাদি কাজে জড়িয়ে পড়লাম। এর মধ্যেই কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে আমাদের দুই বোনকে ঢাকা ছাড়তে হলো।
আমার বোন সুলতানা ও আমি ঢাকা ছাড়ি ১৬ জুন ১৯৭১; মুক্তিযোদ্ধাদের বিরাট একটি দলের সঙ্গে। সাংবাদিক শাহাদৎ চৌধুরী ও মাহমুদুর রহমান বেনু (মুক্তির গানখ্যাত) আমাদের সীমান্ত পার করিয়ে ফিরে গেলেন ঢাকায়, তাঁর আরাধ্য কাজ শেষ করতে। শাহাদৎ ভাই রয়ে গেলেন আমাদের সঙ্গে। আমরা চান্দিনা হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে সোনামূড়া গ্রামে পৌঁছালাম বিকেলের দিকে। খবর পেলাম, ক্যাপ্টেন আখতার (সম্প্রতি প্রয়াত, আমার পূর্বপরিচিত) চেষ্টা করছেন ওখানে একটা ফিল্ড হাসপাতাল করার, মুক্তিবাহিনী ও আহত আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাজ করার এই অভাবিত সুযোগটি আমরা হাতছাড়া করলাম না। আমরা দুই বোন থেকে গেলাম সোনামূড়ায়। অন্যরা যে যার গন্তব্যে। আখতার ভাইয়ের সহযোগী হয়ে শুরু করলাম নার্সিং। কয়েক দিন পর তাঁর স্ত্রী খুকু আহমদও আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। আমাদের কারোরই নার্সিংয়ে কোনো রকম অভিজ্ঞতা ছিল না, কেবল একটিমাত্র বোধ আমাদের একত্র ও উজ্জীবিত করেছিল, তার নাম স্বাধীনতা।
যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই ছিল এই হাসপাতাল, যার শুরু হয়েছিল সোনামূড়া ফরেস্ট বাংলোর একটি ঘরের মেঝেতে, পাটি পেতে। আগরতলার সোনামূড়া গ্রামটি ছিল ২ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন খালেদ মোশাররফ, যাঁর সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায়। ডা. আখতার আহমদের সঙ্গে যোগ দেন ডা. মবিন, ডা. জামান, ডা. নাজিম উদ্দিন আহমেদ ও ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী। আমরা আখতার ভাইকে সহযোগিতা করতাম, দেখতাম কী অনায়াসে শুধু গ্লাভস পরে ক্ষতস্থানে হাত ঢুকিয়ে গুলি বা স্প্লিন্টারের টুকরা বের করে নিয়ে আসতেন তিনি। ক্রমে আমরা শিখে নিলাম ক্ষতস্থানে ড্রেসিং করা, ইনজেকশন দেওয়া, চার্ট দেখে ওষুধ খাওয়ানো ইত্যাদি।
ইতিমধ্যে ডা. ডালিয়া সালাহউদ্দীন ও ডা. সামসুদ্দিন আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। সোনামূড়া থেকে জুলাই মাসে আমরা হাসপাতাল সরিয়ে নিই দারোগাবাগিচায়, টিলার ওপর—পাকিস্তানি বাহিনীর শেলিং থেকে বাঁচার জন্য। ১০টি তাঁবু দিয়ে তৈরি হলো হাসপাতাল, ৮টি রোগীদের, মেয়েদের ১টি। একেকটি টিলায় তাঁবু ফেলা হলো। মাটির ওপর পলিথিন, তার ওপর পাটি বিছিয়ে আমাদের শোয়ার ব্যবস্থা। দেখতাম, প্লাস্টিকের নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কেঁচো, পোকামাকড়। ওরই ওপরে কাপড়ের পুঁটলি মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। খাবার বলতে ছিল রুটি আর সবজি। বহুদিন খেতে বসে দেখেছি রুটির মধ্যে মরা পোকা, এক পাশে সরিয়ে রেখে খেয়ে নিতাম, খেতে পাচ্ছি এই তো ঢের।
এক তাঁবু থেকে অন্য তাঁবুতে ঘুরে ঘুরে কাজ করতাম আমরা, মোটামুটি কাজ শিখে ফেলেছিলাম তত দিনে, তবে কষ্ট হতো প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে এক তাঁবু থেকে অন্য তাঁবুতে যেতে। যুদ্ধে আহত গ্রামবাসী, মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা, ম্যালেরিয়া রোগী—সবাই আসত হাসপাতালে। কারও হাত উড়ে গেছে, কারও পা, চোয়ালের পাশ দিয়ে গুলি চলে গেছে, বীভৎস দৃশ্য। কোনো কোনো সময় গুরুতর অপারেশন থাকলে আগরতলার গোবিন্দবল্লভ হাসপাতাল থেকে রক্ত কিনে আনতে হতো। আমাদের রক্ত সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এর মধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন ডা. নাজিম ও ডা. ফারুক আবদুল্লাহ্। মেলাঘর ক্যাম্পের ক্র্যাক প্লাটুন বা স্টুডেন্ট প্লাটুনের সদস্য, যারা অনেকেই আমাদের পুরোনো বন্ধু, শাফী ইমাম রুমী, শহীদুল্লাহ খান বাদল, হাবিবুল আলম, ফতেহ আলী চৌধুরী, আবুল মাসুদ সাদেক চুল্লু, সামাদ, মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ, বদিউল আলম—এদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল, ওরা ছুটির দিনগুলোতে প্রায়ই হাসপাতালে আসত।
এ সময়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল আমার প্রবাসী ভাই ড. সাজেদ কামাল ও তাঁর স্ত্রী রোজীর। ওরা বোস্টন থেকে আমাদের হাসপাতালে টাকাপয়সা, সাপে কাটা, ম্যালেরিয়া ও বিভিন্ন ধরনের ওষুধ পাঠিয়ে সহায়তা করেছে। ওদের মাধ্যমে ঢাকায় মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ হতো। ওদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমাদের দুই বোনের আসল নাম ব্যবহার না করে লিসি ও টিনা নামে উল্লেখ করা হতো।
দারোগাবাগিচা ছেড়ে ২৬ আগস্ট আমরা বিশ্রামগঞ্জে নতুন হাসপাতালে এসে উঠি। এটা ছিল প্রায় পূর্ণাঙ্গ একটি হাসপাতাল। ৬০ শয্যাবিশিষ্ট, ৩০টি মেডিকেল ও ৩০টি সার্জিক্যাল। দারোগাবাগিচায় যথেষ্ট ওষুধপথ্য ও অন্য যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য সুবিধা ছিল না। যুদ্ধে এই সময় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণাত্মক ভূমিকার জন্য রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল। আমরা দুই শিফটে কাজ করতে করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম। চেষ্টা করতাম সাধ্যমতো সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে তাদের সারিয়ে তুলতে। পুঁথিগত বিদ্যায় নয়, আন্তরিকতা ও মমতা দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করার। ইতিমধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন পদ্মা, নীলিমা, অনুপমা দেবনাথ, কিরণ দেবনাথ, আসমা আলম, রেশমা আলম, মিনু বিল্লাহ্, ডা. মুর্শেদ চৌধুরী ও অধ্যাপক জাকিয়া খাতুন। আরও পরে যোগ দেন গীতা কর ও বাসনা চক্রবর্তী। প্রথম দিকে ডালিয়া ও আমি ছিলাম মেডিকেল ওয়ার্ডে, খুকু ও লুলু (সুলতানা কামাল) সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে, পরে অন্য মেয়েরা যোগ দিলে আমরা অনেকটা সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করতে শুরু করি। হাসপাতালের জন্য জায়গাটি দান করেছিলেন হাবুর ব্যানার্জি, যাঁর পেয়ারাবাগানের অনেকটা অংশে তৈরি হয়েছিল হাসপাতাল।
লম্বা বাঁশের ব্যারাকে ৩০টি বেড, মধ্যে ছোট একটি বসার জায়গা ডাক্তার বা নার্সের জন্য। এরপর আবার ৩০টি বেড। মেয়েদের থাকার জায়গাও ছিল একটি লম্বা বাঁশের ব্যারাকে। বাঁশের মাচায় বিছানা, দুজনের একটি করে বালিশ।
সম্পূর্ণ অনিশ্চিত, অপরিচিত এক জীবন—জানি না কবে দেশে ফিরতে পারব, দেখতে পাব প্রিয়জনদের মুখ। জানি না কাকে ফিরে পাব, কাকে পাব না।
ইতিমধ্যে অক্টোবরে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন ক্যাপ্টেন সেতারা, তিনি ক্যাপ্টেন হায়দারের বোন—মেলাঘর ক্যাম্পের হেডকোয়ার্টারের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন হায়দার ভাই। বিখ্যাত ক্র্যাক প্লাটুন তাঁরই হাতে তৈরি।
অক্টোবরের পর থেকে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। হাসপাতালের অবস্থানটি আমাদের জন্য নিরাপদ ছিল না। যেকোনো মুহূর্তে পাকিস্তানি বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারত। সহকর্মীরা অনেকেই তখন যুদ্ধক্ষেত্রে চলে গিয়েছিলেন। খালেদ মোশাররফ কোনাবনে আহত হয়ে দিল্লিতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ফলে আমরা একেবারে অরক্ষিত ও অনিশ্চিত অবস্থায় পড়ে যাই। এ সময়ে মিত্রবাহিনী তৎপর হয়ে ওঠায় পুরো জায়গা প্রায় রণাঙ্গনে পরিণত হওয়ায় ওখানে মেয়েদের কাজ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, পরিণামে আমরা নভেম্বরে বিশ্রামগঞ্জ ছেড়ে কলকাতা চলে আসি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার, ইতিহাসের অংশ হওয়ার, ইতিহাস গড়ার সুযোগ পাওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল, সৌভাগ্য হয়েছিল এই বিশাল অর্জনে নিজেদের একটি ভূমিকা রাখার, তা যৎসামান্যই হোক না কেন—এ আমাদের সারা জীবনের অহংকার।
সাঈদা কামাল চারুশিল্পী ও শিক্ষক