১৮৬১ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে দুটি ঘটনা ঘটে। সে বছরই মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখলেন মেঘনাদবধ কাব্য এবং জন্ম নিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেলেন। সেই প্রথম বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
১৯১৩ থেকে আজ ২০২০। পেরিয়েছে এক শ বছরের বেশি সময়। এই সময়–পরিধিতে বাংলা ভাষার অবস্থান বিশ্বে কোথায়? পৃথিবীর প্রধানতম একটি ভাষা হয়ে অন্তর্জালের এই জগতে কীভাবে ছড়িয়ে আছে বাংলা? ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট এথনোলগের ২০২০ সালের ২২তম সংস্করণের পরিসংখ্যান আমাদের জানাচ্ছে, পৃথিবীজুড়ে মোট বাংলাভাষীদের সংখ্যা প্রায় ২৬ কোটি ৫০ লাখের (ভাষা–গবেষক হিসেবে আমাদের ধারণা ২৮ কোটি হবে) কিছু বেশি। ক্রমিক বিচারে এর অবস্থান সারা বিশ্বের ভাষাগুলোর মধ্যে পঞ্চম। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে।
বাংলার বিশ্বজয়
২০১৭ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, শুধু বাংলাদেশেই বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খন্ড, ওডিশা, আন্দামান-নিকোবর, ধানবাদ, মানভূম, সাঁওতাল পরগনা প্রভৃতি এলাকায়ও বাংলা ভাষার প্রচলন রয়েছে। এর বাইরে নেপাল, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ইতালি ইত্যাদি দেশে বিপুল পরিমাণ বাংলাভাষী অভিবাসী ও প্রবাসী রয়েছেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে যে আন্দোলন হয়, তার স্মরণে ১৯৯৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন শুরু হয়। এই আন্তর্জাতিক দিবসের পেছনের গল্পে আছে কানাডাপ্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালামসহ কানাডার বহুভাষিক ও বহুজাতিক সংগঠন ‘মাতৃভাষা প্রেমিকগোষ্ঠী’ উদ্যোগ। এরই ধারাবাহিকতায় এসেছে ইউনেসকোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি, যা বাংলা ভাষার দ্বিতীয়বার বিশ্বজয়।
বিশ্বব্যাপী বাংলাচর্চা
বাংলা ভাষায় শিক্ষা-গবেষণা এখন বিশ্বময়। একসময় শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় গবেষণাকর্ম পরিচালিত হতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগ থেকেই লন্ডনের সোয়াসে প্রাচ্যবিদ্যা ও ভাষাচর্চা বিভাগে চলছে বাংলা ভাষার চর্চা ও গবেষণা। যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এবং এশীয় গবেষণাকেন্দ্রে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে, যার মধ্যে নিউইয়র্ক, ইথাকা, শিকাগো, মিনেসোটা, ফ্লোরিডা, মেরিল্যান্ড, ক্যালিফোর্নিয়া ভার্জিনিয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বাংলা ভাষা শিক্ষাদান ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, লালন সাঁই, চর্যাপদ এবং মধ্যযুগের সাহিত্য নিয়ে। অতীতে এবং বর্তমানে যাঁরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন প্রপঞ্চ নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং এখনো করছেন, তাঁদের মধ্যে বাংলা ভাষা-আগ্রহীদের কাছে ক্লিন্টন বি সিলি বা উইলিয়াম রাদিচে এখন বেশ পরিচিত নাম।
এর বাইরে আরও কিছু নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন: হানা রুথ টমসন, জে ডি এন্ডারসন, টি ডব্লিউ ক্লার্ক, জন বোল্টন, জেমস লয়েড, রজার গোয়েন (যুক্তরাজ্য); র্যাচেল ফন বমার, র্যালফ নিকোলাস, ডেভিড কফ ব্যাচেলবাওয়ার, ক্যারল সলোমন, রিকি সলোমন, উইন্সটন ল্যানলি, ক্যারোলিন রাইট, হেনরি গ্লাসি, অ্যান্ড্রু সিম্পসন, অ্যান ডেভিড, (যুক্তরাষ্ট্র); মারিয়ান ম্যার্ডান (অস্ট্রেলিয়া); জোসেফ ও কনেল, ব্যারি মরিসন (কানাডা), জিং কুইং (চীন) প্রমুখ।
জাপান, চীন, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা ও চর্চা হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অগ্রণী জাপান ও চীন। জাপানে প্রায় ৭০ বছর আগে কাজুয়ো আজুমা রবীন্দ্রপ্রেম থেকে বাংলা ভাষার চর্চা শুরু করেছিলেন। কেই শিরাই, অধ্যাপক নারা (প্রয়াত), কিওকো নিওয়া, কাজুহিরো ওয়াতানাবে, তোগাওয়া মাসিকো প্রমুখ জাপান ফাউন্ডেশন এবং টোকিও, ওসাকা প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও শিক্ষকতা করেছেন।
আট বছর আগে টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজে বাংলা ভাষা শেখানো শুরু হয়। বর্তমানে এই বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩০ জন। ওসাকা ও কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে বাংলা ভাষা শিক্ষা দিচ্ছেন বাংলা ভাষার তরুণ গবেষক হুজিয়ারা। এ ছাড়া গিফু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিদিকি মাকি বাংলা ও জাপানি ভাষার বাক্য গঠন নিয়ে তুলনামূলক গবেষণা করছেন।
চীন দেশে বাংলা ভাষা
দীর্ঘদিন ধরে চীনের রেডিও বেইজিং থেকে বাংলায় সম্প্রচার চলে আসছে। চীন থেকে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু বাংলা অনুবাদকর্ম। গত কয়েক বছর ধরে সেখানে ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ চলছে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বাংলা থেকে চীনা ভাষায় অনুবাদের কাজ করছেন প্রায় ৩০ জন সিআরআইয়ের (চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনাল) সাবেক কর্মী। এ ছাড়া চায়না ব্রডকাস্টিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান চাংসিং বেশ কিছু চীনা ভাষাবিদ-গবেষককে বাংলা-চীনা-বাংলা অনুবাদ এবং বাংলা ভাষাবিষয়ক গবেষণা প্রকল্পে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নত হওয়ায় চীনে বাংলা ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। সে দেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে শুরু হয়েছে গবেষণা। বাংলা ভাষার কোর্স চালু হয়েছে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্প্রতি সেখানকার দুটি বিশ্ববিদ্যালয় বেইজিং ইউনিভার্সিটি ও বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজ বাংলা ভাষার কোর্স চালু হয়েছে। এমনকি সেখানে বাংলা বিষয়ে অনার্সও চালু হয়েছে, যেখানে নয়জন চীনা শিক্ষার্থী বাংলা ভাষা অধ্যয়ন করছেন। অধ্যাপক জিং কুইং বাংলা নিয়ে কাজ করছেন। তা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের বাংলা ভাষার প্রাক্তন চীনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে বর্তমানে চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শিক্ষাদানে নিয়োজিত রয়েছেন।
ইউরোপের দেশে দেশে
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্রে বাংলা ভাষার চর্চা ও গবেষণা চলছে। ফ্রান্সে বাংলা থেকে ফরাসি অনুবাদকদের মধ্যে রয়েছেন ফ্রাঁস ভট্টাচার্য, পৃথ্বীন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও প্রবাল দত্তগুপ্ত। পৃথ্বীন্দ্র মুখোপাধ্যায় অনুবাদ করেছেন বাউলগান ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস। ফ্রাঁস ভট্টাচার্য অনুবাদ করেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস পথের পাঁচালী, জীবনানন্দ দাশের কবিতা এবং সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে পৃথিবীর নানা দেশে বাংলা শেখার পর্যাপ্ত সুযোগ ও চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার চাহিদা আরও বাড়ছে। অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয় সে দেশের বিদ্যালয়ে যেসব এশীয় ভাষা শেখার অনুমতি দিয়েছে এবং যেসব ভাষা শেখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, বাংলার অবস্থান তার মধ্যে তৃতীয়।
বিদ্যালয় ও সংবাদপত্রে
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষের মাধ্যমে বাংলা পাচ্ছে বৈশ্বিক ব্যাপ্তি। আগেই বলেছি, বাংলাভাষী মানুষেরা ছড়িয়ে আছেন নানান দেশে। তাঁদের মধ্যে কায়িক শ্রমের মাধ্যমে বিদেশি শ্রমবাজার এবং দেশি অর্থনীতির হাল ধরা মানুষ যেমন আছেন, তেমনি ব্যবসায়িক প্রয়োজনে, উচ্চশিক্ষা কিংবা চাকরিসহ বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত প্রবাসী বাংলাভাষীদের সংখ্যাও এখন ক্রমে ক্রমে বেড়ে চলেছে। আর তাঁদের অনেকেই দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষাকে তুলে ধরতে প্রবাসে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাভাষী বিভিন্ন বিদ্যালয়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্য কোথায় নেই এই বিদ্যালয়। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ও কানাডা থেকে বাংলা ভাষায় বর্তমানে একাধিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে, টিভি-বেতার চ্যানেলে বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হচ্ছে। এসব বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক অনুষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্যই হলো বাংলা ভাষাকে বিদেশের মাটিতে নতুনভাবে তুলে ধরা। বইমেলা, সংগীত-কবিতা সন্ধ্যা, নৃত্যনাট্য—সবকিছুতেই বাংলা ভাষার জয়ধ্বনি আজ শোনা যায় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি নিজ নিজ অভিবাসী দেশে এখন সংবাদমাধ্যম চালু করেছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই বাংলাদেশি অনলাইন বাংলা পত্রিকার অনুমোদন মিলেছে। ফলে বাংলা পত্রিকা এখন কেবল বাংলাদেশ বা ভারতের ছাপাখানা থেকেই নয়, বরং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে।
বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহের কারণে বিশ্বের প্রায় ১০টি দেশের রাষ্ট্রীয় বেতারে বাংলা ভাষার আলাদা চ্যানেল রয়েছে। আরও ১০টি দেশের রেডিওতে বাংলা ভাষায় আলাদা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে ৬টি ও যুক্তরাষ্ট্রে ১১টি বাংলাদেশি মালিকানাধীন ও বাংলা ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। রয়েছে কানাডাতেও। বাংলা ভাষায় যুক্তরাজ্য থেকে মোট ১২টি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হয়। বেতার বাংলা নামে সেখানে একটি বাংলা রেডিও স্টেশন রয়েছে। ধূমকেতু, জন্মভূমি, প্রতিদিন, স্বদেশ-বিদেশ নামে পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকাও প্রকাশিত হচ্ছে।
ইউরোপের ইতালিতে বর্তমানে পাঁচটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা এবং রোম ও ভেনিস শহর থেকে তিনটি বাংলা রেডিও স্টেশন পরিচালিত হচ্ছে।
বিশ্বজুড়েই বাংলাভাষীদের উপস্থিতি এবং তাদের মাতৃভাষাপ্রেম বাংলা ভাষাকে ছড়িয়ে দিয়েছে পৃথিবীর পথে পথে। একুশ শতকে বিশ্বজুড়ে বাংলার এই অহংকারদীপ্ত পদচারণ বায়ান্নর ভাষাশহীদদের কাছে কৃতজ্ঞতায় আমাদের আরও একবার নত করে দেয়।