বৈরাগীও ছিলেন, আবার ছিলেন ঘোর সংসারী

>সচিত্র সন্ধানী, ১ বর্ষ, ১২ সংখ্যা, ৯ জুলাই ১৯৭৮
আব্বাসউদ্দীন আহমদ (১৯০১–১৯৫৯)
আব্বাসউদ্দীন আহমদ (১৯০১–১৯৫৯)

আপনার ছেলেমেয়েদের সবাই সংগীতশিল্পী বাবা আব্বাসউদ্দীনের সার্থক উত্তরাধিকারী। আজ সারা দেশে তাঁদের খ্যাতি। আপনার স্বামী ও তাঁদের খ্যাতি, আপনার স্বামী ও তাঁদের নিয়ে আপনার নিশ্চয় খুব গর্ব হয়? প্রশ্নটি করেছিলাম বেগম আব্বাসউদ্দীনকে। তাঁর পুরো নাম লুৎফুন্নেসা আব্বাসী।

নির্মল হেসে তিনি বলেন, ‘গর্ব হয় বৈকি। তবে এদের বাবার মতো বড় শিল্পী এরা কেউ হয়নি। মেয়ে ফেরদৌসী হতে পারত, কিন্তু মেয়ে তো! বড় ত্যাগ না হলে সাধনা পূর্ণ হয় না। যেমন আমি শিল্পীর স্ত্রী হিসেবে আমার গান, আমার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে আব্বাসউদ্দীনকে বড় হওয়ার পথে সাহায্য করেছি। তা ছাড়া কী যেন নেই এ যুগে, গানের মতো বড় সাধনার ধন যেন বড় হেলাফেলা।’

লুৎফুন্নেসা আব্বাসী বড় হয়েছেন একটি সুন্দর সাংস্কৃতিক পরিবারে, কিন্তু তাঁর গানের চর্চা বন্ধ হয়ে যায় বিয়ের পর। তা–ই কি? তাঁর কণ্ঠ কিছুটা বেদনাহত শোনাল।)

 ‘ঠিক তা-ই, আমি সুর হারিয়ে ফেললাম বিয়ের পর। একটি ফুল ফুটল, একটি ঝরে গেল।’

সে তিরিশের দশকের কথা। চাঁদা দিয়ে গ্রামোফোনে কত গান শুনেছেন। শিখেছেন গান শুনে শুনে। হঠাৎ করে আব্বাসউদ্দীন এলেন বন্ধুর সঙ্গে কনে দেখতে। তিনি শুনেছেন ডোমারের মেয়েরা গান জানে, পড়ালেখা করে। কনে দেখা বড় কথা নয়। দুই পক্ষেরই গান গাওয়ার পালা। সুশ্রী তরুণ আব্বাসউদ্দীন যখন চতুর্দশী কালো মেয়ে আলেয়াকে বিয়ে করে মায়ের কাছে গেলেন, চারপাশে চাপা গুঞ্জন ওঠে—এ কী বউ! কালো! হ্যাঁ, এখনো বেগম লুৎফুন্নেসার মনে আছে, এই কালো রঙের বউটি বহুদিন পর সে পরিবারের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। শিল্পীর সহচরী হওয়া যে কী কষ্টের, কী বেদনার, তিনি জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। দিনের পর দিন আব্বাসউদ্দীন কলকাতায় গান গেয়েছেন, গানের সাধনায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর কবে যে বালিকা বধূ থেকে মা হলেন লুৎফুন্নেসা—এক, দুই, তিন করে চার সন্তানের জন্মদাত্রী হলেন, যেন বুঝতেই পারলেন না।

আব্বাসউদ্দীন আহমদের সঙ্গে স্ত্রী লুৎফুন্নেসা আব্বাসী। ছবি: সংগৃহীত

সে দিনগুলো হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার উৎস তাঁর কাছে। কামাল আর জামাল টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বড় ছেলে মোস্তফা কামাল বেঁচে গেলেও মেজ ছেলে জামালকে হারাতে হলো। এ ছাড়া আছেন সংগীতশিল্পী দুই ছেলেমেয়ে মোস্তাফা জামান আব্বাসী ও ফেরদৌসী রহমান।

কোচবিহারে বাড়ি বানালেন শিল্পী আব্বাসউদ্দীন। সংসার যেন এত দিনে একটা স্থায়ী রূপ পেল। শিল্পীজায়া বলেন, ‘আমার খারাপ লাগত শিল্পীকে বাস্তব সংসারে টেনে এনে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমি বড় ভয়ে থাকতাম। “সদাই হারাই তারে”—এই ভয়ে কাছে টেনেছি। চাকরির বেতন ৩৫ টাকা থেকে ১৫ টাকা পাঠাতেন সংসার খরচ। এর বাইরেও রেকর্ড ও অনুষ্ঠান থেকে রোজগার হতো। কিন্তু সে টাকা কখনো সংসারের মুখ দেখেনি। না, এটা যেন কেউ না ভাবেন, শিল্পীর খেয়ালিপনায় সে টাকা শেষ হয়েছে। কোনো না কোনো সমাজসেবার কাজেই টাকাটা ব্যয় হতো।’

আব্বাসউদ্দীনের রেকর্ড তখন ঘরে ঘরে। বহু মেয়েভক্ত চিঠি লিখছে। বাড়ি পর্যন্তও এসেছে অনেকে। আব্বাসউদ্দীনকে একপলক দেখে ‘নয়ন সার্থক’ করতে চায় সবাই। এদেরই কারও কারও কিছু গোপন অভিলাষও ছিল নাকি মনে?

‘আমি বুঝতাম সবই,’ মৃদু হেসে বললেন বেগম আব্বাসউদ্দীন। ‘তিনি তো আমাকে কিছু লুকাননি, এমনকি বিবাহপূর্বের সেই অপূর্ব সুন্দরীর প্রেমের কথাও, যার সঙ্গে বিয়ে প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিল। হয়তো ভেবেছিলেন সমস্ত কল্পনা আর মাধুরী দিয়ে তাঁকে ভালোবেসেছি, তাঁকে কেন ধুলোমলিন সংসারে টেনে আনা! তাঁর কৈশোরের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পায়নি। কিন্তু সে প্রেমে আমার বুকে ঈর্ষার কোনো ঝড় ওঠেনি। আমি জানতাম আমার স্থান তাঁর বুকের কোন জায়গায়। তবে মাঝেমধ্যে তাঁকে লেখা অজানা রূপসীদের প্রেমপত্র বুকে ব্যথা জাগাত। মনে হতো এসবের হাত থেকে শিল্পীকে, স্বামীকে আমি বাঁচাতে পারব তো?’

আঙ্গুরবালা, ননীবালাদের প্রসঙ্গ এলে তাঁর কণ্ঠে ফুটে উঠল উষ্ণ শ্রদ্ধা। তবে স্বামীর বন্ধুবান্ধবী বা গুণগ্রাহীদের কাউকে তিনি সামনাসামনি দেখেননি ওই সময়। রক্ষণশীল না হলেও স্বামীর মনে সংকোচ ছিল স্ত্রীকে বাইরে বের করার ব্যাপারে। তাই কাজী নজরুল ইসলামকে তাঁর দেখা হয়নি কবির টগবগে যৌবনে। অসুস্থ, মৌন কবিকে তিনি দেখেছিলেন অনেক পরে; দেখেছিলেন আঙ্গুরবালা, ননীবালা—তাঁদেরও।

আড়াল থেকেই তিনি অন্তরঙ্গভাবে জেনেছিলেন কবি জসীমউদ্‌দীন, কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ, হাবীবুল্লাহ বাহার, এ কে ফজলুল হক ও সোহরাবউদ্দিনকে।

তাঁদের সঙ্গে শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের বহু সময় কেটেছে। সংসারের ঝড়ঝাপটা স্ত্রীর ওপর ফেলে তিনি প্রায়ই বাইরে চলে যেতেন সভা-সমিতিতে গানের জন্য। শিল্পীজায়া এ নিয়ে কখনো কি অনুযোগ করতেন? না, তা কখনো করেননি। প্রথম থেকেই লুৎফুন্নেসা আব্বাসী স্বামীকে বুঝে নিয়েছিলেন। অপূর্ব সমঝোতা ছিল দুজনের। শিল্পীদের জীবন ছন্নছাড়া হয়, কিন্তু আব্বাসউদ্দীন তেমন ছিলেন না। তিনি বৈরাগীও ছিলেন, আবার ছিলেন ঘোর সংসারী। তিনি ভাত পছন্দ করতেন না। প্রচুর ফল আর সবজি ছিল তাঁর প্রধান খাদ্য। পুরানা পল্টনের বাসায় এসে নিজের হাতে বাগান করেছিলেন স্ত্রীকে নিয়ে। আর কী সরলই না ছিলেন তিনি! সব গানের জলসার গল্প, বন্ধুদের গল্প স্ত্রীকে যেন না বললেই নয়।

l লেখাগুলো মূল শিরোনাম পরিবর্তন করে সংক্ষিপ্ত আকারে এবং কয়েকটি লেখায় বর্ণনাত্মক অংশ বাদ দিয়ে প্রশ্ন–উত্তর আকারে ছাপা হয়েছে এবং অনুসরণ করা হয়েছে প্রথম আলোর বানানরীতি।