কবি ও নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ সুফিয়া কামাল

সাহস যেন খণ্ডিত না হয়

>প্রথম আলো, ৪ নভেম্বর ১৯৯৮
বেগম সুফিয়া কামাল (১৯১১–১৯৯৯)
বেগম সুফিয়া কামাল (১৯১১–১৯৯৯)

সাদাকালো ব্লকপ্রিন্টের চাদর পাতা পাটপাট বিছানার ওপর গুটিসুটি শুয়ে দুজনে। কবি, নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ সর্বজনশ্রদ্ধেয়া সুফিয়া কামাল এবং তাঁর আদরের বিড়াল কুটু।

মাথার কাছে ভাঁজ করা দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিকগুলো। চশমার খাপের চাপে একটা দৈনিকের একটি কোনা শুধু ফরফর আওয়াজ করে যাচ্ছে। উড়তে পারছে না কিছুতেই। ৮৭ বছরে পৌঁছে বার্ধক্যের কাছে কাবু হয়েও তরুণ সুফিয়া কামাল বললেন, ‘ঘর থেকে তো এখন আর বের হতে পারি না। তাই সংবাদপত্র পড়েই সব খবরাখবর পাই। চোখের সমস্যায় পড়তে কষ্ট হয়, তবুও সংবাদপত্র ছাড়া কি দিনের শুরু সম্ভব? তবে এ কথাও ঠিক, পত্রিকা পড়লেই আমার নিজেকে অনেক বেশি অকেজো মনে হয়। চারদিকে এত অন্যায়, অনিয়ম, মেয়েদের ওপর নির্যাতন অথচ আমি ঘর থেকে বের হতে পারছি না। সমাজের, দেশের কোনো কাজেই লাগছি না।’

সুমনা শারমীন: প্রথম আলো নামে দেশে আরেকটি দৈনিক পত্রিকা বের হচ্ছে শুনেছেন নিশ্চয়ই?

সুফিয়া কামাল: হ্যাঁ, শুনেছি। তবে কত নতুন নতুন পত্রিকাই তো বের হচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে মেয়েদের পাশে কেউ তো দাঁড়াচ্ছে না। গ্রামে-গঞ্জে-শহরে মেয়েরা ফতোয়াবাজির শিকার হচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে, অসম্মানিত হচ্ছে, ভাইয়ে ভাইয়ে জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব, অ্যাসিডদগ্ধ হচ্ছে বাড়ির মেয়েরা, বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হলেই ঝলসে যাচ্ছে মেয়েটার মুখ, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে মেয়েরা, কিন্তু সত্যিকার অর্থে কোনো পত্রিকা কি দাঁড়াচ্ছে মেয়েদের পাশে বন্ধুর মতো? প্রথম আলো যদি সেই ভূমিকা নিয়ে প্রকাশিত হয়, তবেই বুঝতে হবে এই পত্রিকা প্রকাশের সার্থকতা।

সু. শা.: প্রথম আলো নিরপেক্ষতার অঙ্গীকার করেছেএ প্রসঙ্গে কিছু বলবেন?

বেগম সুফিয়া কামাল। ছবি: নাসির আলী মামুন

সু. কা.: আমাদের দেশে নিরপেক্ষতা মানেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির খবরাখবরের নিরপেক্ষতা। কিন্তু আমি মনে করি, এই রাজনৈতিক ইস্যু ছাড়াও নিরপেক্ষতার অনেক অনেক দিন আছে। মানুষ হিসেবে নারী-পুরুষকে নিরপেক্ষ দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হবে। এই যে এত ফতোয়াবাজি, অ্যাসিড ছোড়ার ঘটনা, একজন সচেতন পুরুষকে তো দেখি না মুখ খুলতে। ভাবটা এমন, নির্যাতনের শিকার যেহেতু হচ্ছে মেয়েরা, সুতরাং প্রতিবাদ–প্রতিরোধ যা কিছু করার, তা শুধু করবে মেয়েরাই। কেন? নির্যাতনের শিকার একটি মেয়ের পক্ষ হয়ে কথা বলতে কি সচেতন পুরুষদের লজ্জা লাগে? নাকি এটার গুরুত্বই তাদের কাছে নেই? রাজনীতিবিদ বলুন, বুদ্ধিজীবী মহল বলুন, কেউ নারী নির্যাতন প্রসঙ্গে সোচ্চার নন। অথচ এ দেশের বুদ্ধিজীবী মহল কি ভুলে গেছে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা? এসব মহৎ পুরুষই তো অন্ধকার থেকে মেয়েদের জীবনকে আলোতে এনেছিলেন। সংবাদপত্র দুর্নীতির রিপোর্ট ছাপায়, অনিয়মের কেচ্ছা শোনায়, কিন্তু বুদ্ধিজীবী মহল, দেশের সচেতন পুরুষদের এই নির্লিপ্ততা, এই একচোখা নীতিকে তো কখনো তুলে ধরে না? গৃহপরিচারিকার ধর্ষণ নিয়ে বড় বড় অপরাধ প্রতিবেদন প্রকাশ পায়, কিন্তু কোথা থেকে দুর্বৃত্তরা অ্যাসিড কিনতে পারছে, এত অ্যাসিড কারা বিক্রি করছে, তা নিয়ে তো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন চোখে পড়ে না। সারা জীবন সাহসে ভর করে রাজপথে হেঁটে চলা মানুষটি থেমে থেমে মৃদুস্বরে বললেন, ‘অবশ্য কাকে কী বলব? আমি নিজেইবা কী করতে পারলাম? একটা কথা বলি, প্রকাশনার শুরুতে সব সংবাদপত্রই সাহসের কথা বলে। কিন্তু সাহস মানে তো আর খণ্ডিত সাহস হতে পারে না। শরিয়তের দোহাই দিয়ে, হাদিসের দোহাই দিয়ে গ্রামে-গ্রামে ফতোয়াবাজেরা মেয়েদের নির্যাতন করছে, কিন্তু কয়টা সংবাদপত্র বলিষ্ঠভাবে প্রশ্ন তোলে যে শরিয়তের কোথায় বিধান আছে এসব ফতোয়ার? প্রথম আলোর কাছে তাই প্রত্যাশা, নিরপেক্ষতা যেন একচোখা না হয়, সাহস যেন খণ্ডিত না হয়।

একনাগাড়ে বেশিক্ষণ বসে থাকলে কষ্ট হয় মানুষটির। আবার আস্তে আস্তে শুয়ে পড়লেন। শুভ্রবসনা মানুষটির কোল ঘেঁষে এতক্ষণে আবার জায়গা করে নিয়েছে আদরের কুটু। বাড়িতে চলছে রঙের কাজ, দালান সারাইয়ের কাজ। মিস্ত্রিদের শব্দকে লক্ষ করে বললেন, ‘বাড়িটা পুরোনো হয়ে গিয়েছিল, তাই সারাইয়ের কাজ চলছে। কিন্তু বয়স পুরোনো হলে যে সারাই চলে না।’

কিন্তু কে না জানে? এ দেশের সব রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দুর্যোগে যে মানুষটি নির্দ্বিধায় হাল ধরেন বলিষ্ঠ হাতে, এখনো তাঁকে বয়স কি পারে আসলেই কাবু করতে? ৮৭ বছরের তরুণ চোখে এখনো তাঁর নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রত্যাশা। বললেন, ‘বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে এ দেশের মেয়েরা সংগ্রাম করে চলেছে। একটা শক্তিশালী সংবাদপত্রকে যদি তারা বন্ধুর মতো পেত, তবে কাজ এগিয়ে যেত আরও অনেকটা, সেটা কি পাব? প্রথম আলোর প্রথম দিনে এটাই আমার প্রথম প্রত্যাশা।’

তাই তো! এ জাতির অনেক প্রত্যাশাই পূরণ করেছেন মানুষটা। তাঁর এ প্রত্যাশার কথা মনে থাকবে তো আমাদের?