চলচ্চিত্রনির্মাতা আলমগীর কবীর

সবই সত্যি এবং আমাদের প্রত্যক্ষে ঘটেছে

>বিচিত্রা, ১ম বর্ষ, দ্বাদশ সংখ্যা, ৩ আগস্ট ১৯৭২
আলমগীর কবীর (১৯৩৮–১৯৮৯)
আলমগীর কবীর (১৯৩৮–১৯৮৯)

ক্যালেন্ডারের পাতায় ইংরেজিতে মাস চলছে মার্চ আর বাংলায় চৈত্র। ইংরেজি–বাংলা দ্বৈত বর্ষ গণনা মিলিয়ে তখনকার বড় পরিচয়। মৌসুম বসন্তের। যেমন পদ্মা-যমুনা মিলে আরিচার উজানে অগাধ নীলাভ জলরাশি। আমের বোল ঝরে গিয়ে সবে গুটি। শীতার্ত উত্তরে হাওয়া তাড়িয়ে মৃদুমন্দ দুলিয়ে যাচ্ছে দখিনা বাতাস। প্রকৃতির এমনই হিরণ্ময় ক্রান্তিকালের মাঝে সেবার একাত্তরে এল যথারীতি পঁচিশে মার্চ দিনটি। পঁয়ষট্টির পাক–ভারত যুদ্ধের লেলিহান শিখা দূর থেকে প্রত্যক্ষ করলেও বাঙালি মানস তখনো বারুদের গন্ধ ও কার্যকারিতায় প্রায় অনভিজ্ঞ। দুরন্তপনা ছেলের জন্য ‘পুলিশ এল,’ উদ্ধৃতিই যথেষ্ট। এমনই সরল-সাদা, কাব্যমনস্ক, সংগীতপ্রিয় বাঙালিকে প্রতারিত করল তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা মুখে আলোচনার ধুয়া তুলে, নেপথ্যে পূর্ণাঙ্গ সামরিক হামলার প্রস্তুতি নিয়ে। পঁচিশের সন্ধ্যায় উত্তর ঢাকার রাজপথে নেমে এল চেইনে রাবার জড়িয়ে জলপাই রঙা ট্যাংক। যেন বর্বর হামলার আগেই কলঙ্কের পূর্বচিহ্ন এঁকে না নেয় রাজপথ। না, অতখানি অবিশ্বাস তখনো বাঙালির চেতনায় ঠাঁই পায়নি। কিন্তু দিনান্তের গৃহস্থালি গুটিয়ে ঢাকাবাসী যখন মাঝরাতে নিদ্রামগ্ন, তখনই সর্বপ্রকার মানবিক আচরণ পায়ে দলে সামগ্রিক সামরিক শক্তি একজোট করে নির্মম হামলা চালানো হলো। অবোধ–সুবোধ নিরপরাধ শিশু আপন সৃষ্টিতে নিমগ্ন ভাবুক শিল্পী মসজিদের মুয়াজ্জিন মিলিয়ে একমাত্র ঢাকা শহরেই নিহত হলেন লাখ লাখ মানুষ। এরপর ৯ মাসব্যাপী চলে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। এক নদী রক্তের বিনিময়ে পাওয়া ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জিত হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু এখানেই কি শেষ? কর্তব্য নেই কি আগামী দিনের জন্য যথার্থ ইতিহাস ধরে রাখার জন্য উদ্যোগী আয়োজনের? চলচ্চিত্রের মতো শিল্পমাধ্যমে স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধ কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে?

আলমগীর কবীর পরিচালিত ধীরে বহে মেঘনা ছবিতে হাসু বন্দ্যোপাধ্যায় ও আজমল হুদা (মিঠু)

বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবীর মুক্তিযুদ্ধের সময় সরাসরি রণাঙ্গনে চলচ্চিত্রকর্মে অংশ নিয়েছেন। তৎকালে গঠিত ফিল্ম ইউনিটেরও একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা জহির রায়হানের সঙ্গে ওই সময় তাঁর ঘনিষ্ঠ সংযোগ ঘটে। আমার কিছু নির্বাচিত প্রশ্ন, তার উত্তর সাজিয়ে আলমগীর কবীরের একটি সাক্ষাৎকার এখানে পত্রস্থ করা হলো:

জাহাঙ্গীর আলম:জানা আছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি ভারতে ছিলেনওই সময় স্বাধীনতার পক্ষে কীভাবে দায়িত্ব পালন করেন?

আলমগীর কবীর: মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি দুই দফায় ভারতে গেছি। ২৮ মার্চ ঢাকা ত্যাগ করে ১২ এপ্রিল ফিরে এসে আজিমপুরে আত্মগোপন করে থাকি। প্রথমবার ঢাকা ফিরি রণাঙ্গন থেকে পায়ে বুলেট বিদ্ধ হয়ে। আত্মগোপন অবস্থায় থেকে কিছুতেই তার সুচিকিৎসা হচ্ছিল না দেখে ফের একটি বিদেশি দূতাবাসের সহায়তায় জুনে হংকং হয়ে ভারত যাই এবং শেষবারের মতো ৮ ডিসেম্বর যশোর সেক্টর হয়ে দেশে ঢুকি। বলে রাখি, তখন পর্যন্ত আমার প্রথম ও প্রধান পরিচয় একজন সাংবাদিক হিসেবে। যদিও একাত্তরের মার্চে আমার নির্দেশনায় একটি বিদেশি গল্পের চিত্র রূপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছিল। চলচ্চিত্রের সঙ্গে এই রকম অপ্রত্যক্ষ যোগাযোগ সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধকালে আবদুল জব্বার খানকে প্রধান করে গঠিত ফিল্ম ইউনিটের আওতায় আমাকে দিয়ে সম্ভব সব কাজ সক্রিয় উদ্যোগে করেছি।

জা. আ.: স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর যে স্বল্পমাত্রায় প্রামাণ্যচিত্র উঠেছে, তা কি যথেষ্ট মনে করেন?
. ক.: মোটেও না। স্বাধীনতার বা মুক্তিযুদ্ধের মতো ব্যাপক মর্মার্থের জাতীয় ঘটনায় আমরা কয়েকজন মাত্র যে ছবি ক্যামেরায় ধরেছি, তা নগণ্যসংখ্যক। হাতে গোনা যে কটি প্রামাণ্যচিত্র উঠেছে, তারও কাজের মান ছিল নিম্নমানের এবং অপরিকল্পিত। এমনকি চলচ্চিত্রের সংজ্ঞায় ফেলা যায় কি না সন্দেহ। শুধু ঘটনাবলির সেলুলয়েড চিত্র জোড়া দিয়ে দিয়ে একটা কিছু করার চেষ্টা মাত্র। হতে পারত বিপুল সম্ভাবনাময় কিন্তু প্রাপ্ত সুযোগ–সুবিধার অপ্রতুলতার কারণে জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইডও কোনো সুষ্ঠু ভাবনা–চিন্তাপ্রসূত দলিল চিত্র হয়ে ওঠেনি।

জা. আ.: আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কেন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সার্থক দলিলাকারে ধরে রাখা যায়নি?

. ক.: প্রথমত আর্থিক কারণে, দ্বিতীয়ত বলব কর্মকর্তাদের ধারণা ও মতামতের অস্বচ্ছতার কারণে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনে যে ফিল্ম ইউনিট গড়ে তোলা হয়, তার প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন আবদুল জব্বার খান। তিনি মূলত ফিচার ফিল্মের নির্মাতা। তবু এই চলচ্চিত্র জন ডকুমেন্টারি সম্বন্ধে প্রায় অজ্ঞ। তাঁর নেতৃত্ব আমাদের পিছিয়েছে শুধু। তা ছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার সব কাজেই তাদের প্রাধান্য চেয়েছে। ফিল্ম ইউনিটে আমরা সব মতের লোক ছিলাম। এটা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এমনকি জহিরের স্টপ জেনোসাইডএ আওয়ামী লীগের প্রাধান্য নেই।...

সুকদেব সারা পৃথিবী ঘুরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে এডওয়ার্ড কেনেডি, আঁন্দ্রে মালরোসহ বিশিষ্টজনদের মতামত সংগ্রহ করেন তাঁর ছবির জন্য। ওই ছবিটিতে ভাসানী, আবদুল জব্বার খান, জহির, আমারসহ অনেকের মতামত সন্নিবেশিত করা হয়। নাইন মান্থ অব ফ্রিডম-এর একটি কপি জাপান কিনেছে, পুরস্কার পেয়েছে রাশিয়ার তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে, একটা কপি বাংলাদেশ সরকারকে উপহার দেওয়া হয়, কিন্তু কখনো কোথাও দেখানো হয়নি। অন্য একজন নারী গীতা মেহতা তুলেছেন ডেটলাইন বাংলাদেশ তথ্যচিত্রটি। ভারত সরকার প্রখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে প্রস্তাব দেয় কাব্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি তথ্যচিত্রের পরিকল্পনা দিতে। সুভাষ রাজি হন। তিনি সাতক্ষীরার একটি গ্রামে শুটিং করতে এসে কিছু নারকীয় দৃশ্য দেখে এতই হতবুদ্ধি হন যে ছবি করার ভাবনা ত্যাগ করে ফিরে যান। তিনি ভাবতেই পারেননি ৯ মাসে বাংলাদেশে কী ব্যাপক বীভৎসতা ঘটে গেছে।

জা. আ.: ধীরে বহে মেঘনা বা লিবারেশন ফাইটার্স করার সময় আপনার মধ্যে কোনো উদ্দীপনা কাজ করেছে?

. ক.: স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লবটাকে যথাযথ তথ্যে ধরে রাখায় আমাকে বেশি করে টেনেছে, লিবারেশন ফাইটার্স সরাসরি রণাঙ্গন চিত্র। ধীরে বহে মেঘনা কাহিনিচিত্র হলেও তথ্যচিত্র বা প্রামাণ্যচিত্রের সব রকম গুণাবলি–সংবলিত। ছবিটি প্রথমে জহির করবেন ঠিক ছিল কিন্তু নির্মম পরিণতি তা হতে দিল না। ছবিতে দেখানো ঘটনা, কথন—সবই সত্যি এবং আমাদের প্রত্যক্ষে ঘটেছে।

জা. আ.: দেশের একজন দায়িত্বশীল চিত্রনির্মাতা হিসেবে আপনি আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে আগামী দিনের জন্য কী ভাবছেন বা অন্যরা বা সরকারের কী কর্তব্য বলে মনে করেন?

. ক.: কোনো মতের সরকারকে দিয়েই আগামী দিনে কোনো সঠিক মূল্যায়নকর্ম আশা করা যায় না। একমাত্র সরকারের বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগই যথার্থ কিছু করা সম্ভব, ইচ্ছুক অন্যদের এভাবেই এগোতে হবে। আমি ক্রমাগত তৈরি হচ্ছি, সংগ্রহ করছি, লিখছি; বেশ কিছু দুর্লভ প্রামাণ্য এরই মধ্যে শুট করেছি। তা ছাড়া গভীর অভিনিবেশের জন্য সময়ক্ষেপণও দরকার। যেমন পঁচাত্তরের আগে সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৫ আগস্টের পর ভোজবাজির মতো শতকরা আশিজনই বললেন, পাকিস্তানই ভালো ছিল। এখন আবার শুধু ভালোই নয়, আশিজনই নিজেকে পাকিস্তানি ভাবেন। কাজেই সঠিক ও মহৎ কিছু সৃষ্টির জন্য সময়ক্ষেপণও একটা মূল্যবান ফ্যাক্টর।