'স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন না হলে দারিদ্র্য দূর হবে না'

>সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের পথে বাংলাদেশ কতটুকু এগোল, কোথায় িপছিয়ে ও করণীয় কী—এসব িনয়ে কথা বলেছেন সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকােরর উপদেষ্টা, ব্র্যাকের েচয়ারপারসন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসির িনর্বাহী চেয়ারপারসন েহােসন িজল্লুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
.

প্রথম আলো: সবার জন্য স্বাস্থ্য থেকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা—পরিবর্তনটি কী এবং কেন?
হোসেন জিল্লুর রহমান: নাগরিকদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার বিষয়টি আমাদের সংবিধানেই রয়েছে। বৈশ্বিক পর্যায়ে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ বিষয়টি গুরুত্ব পায় ১৯৭৮ সালে সে সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের ও বর্তমানে কাজাখস্তানের রাজধানী আলমা আতায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে। এরপর দীর্ঘ সময় চলে গেছে। দেখা গেল, সবার জন্য স্বাস্থ্যের কথা বলা হলেও ব্যবস্থার বদল খুব হয়নি। স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নিশ্চিত করার উদ্যোগ হিসেবে হয়তো হাসপাতাল করা হয়েছে, কিন্তু সেই হাসপাতাল থেকে জনগণ আদৌ সেবা পেল কি না, বা সেই সেবার মান কেমন—এসব বিষয় নিয়ে পরে আলোচনা শুরু হয়। এসব বিবেচনায় নিয়েই ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ বা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মানের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টিকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আবার একই সঙ্গে চিকিৎসাসেবায় বেসরকারি খাতও রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, খরচের বিষয়টি স্বাস্থ্যসেবাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে জনগণ আর্থিকভাবে ফতুর হয়ে যাচ্ছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যে বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে, তা হচ্ছে কার্যকর ও মানসম্মত চিকিৎসাসেবা এবং বিনা মূল্যে না হলেও ব্যয়সাধ্য চিকিৎসা নিশ্চিত করা।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সরলভাবে একে ব্যাখ্যা করা বা বোঝা কঠিন। আমাদের দেশে কাঠামোগত ক্ষেত্রে বেশ পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। খুব দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। আগে আমাদের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ গ্রামে বাস করত এবং সেখানকার জীবনযাপনের একটি পদ্ধতি ছিল। সেখানে পরিবর্তন হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে। আগে সংক্রামক রোগ বড় সমস্যা ছিল, এখন অসংক্রামক রোগ সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমাদের জীবনযাপনের ধরন বদলেছে। অভ্যাস সব সময় ব্যক্তির বিষয় নয়। খেলার মাঠ নেই, হাঁটার ব্যবস্থা নেই। সবাই অলস হয়ে পড়ছে। স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপ্তি যেমন বেড়েছে, তেমনি চিকিৎসায় জনগণের খরচ বেড়েছে।

প্রথম আলো: সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের বাড়তি নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমাদের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। প্রথমেই নগর স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই। নগরের দরিদ্র লোকজন গ্রামীণ দরিদ্র লোকজনের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে ভালো। কিন্তু সামাজিক সূচকে পিছিয়ে আছে। প্রাথমিক চিকিৎসাসুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে নগরের দরিদ্র লোকজন পিছিয়ে রয়েছে এবং নিজেদের পকেট থেকেই তাদের টাকা খরচ করতে হয়। নগর স্বাস্থ্যব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। হাসপাতালগুলোর মান ও হাইজিন নিশ্চিত করা এক বড় চ্যালেঞ্জ। হাসপাতালগুলোর অবস্থা এমন যে সেখানে গিয়ে উল্টো অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন বা রোগ বাঁধিয়ে ফেলেন। রোগের বিরুদ্ধে কিছু কিছু লড়াইয়ে আমরা জিতেছি, আবার কিছু ক্ষেত্রে আমরা পুরোপুরি জিততে পারিনি। টিবি নতুন করে সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে অব্যাহত নজরদারি থাকতে হবে। স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা সব দেশেই বড় একটি ব্যবসা। কিন্তু এখানে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা বা নৈতিক ব্যবসা নিশ্চিত করার বিষয়টি খুবই জরুরি। বেসরকারি খাতের চিকিৎসাসেবার ব্যয় বাড়ছে। ওষুধের দামের ওপরও এখন কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। চিকিৎসাক্ষেত্রে বেসরকারি খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একে নিয়মনীতির মধ্যে আনতে পারা সত্যিই এক বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রথম আলো: সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এসডিজি অর্জনের পথে বাংলাদেশ কতটুকু এগোল?

েহােসন িজল্লুর রহমান

হোসেন জিল্লুর রহমান: অনেক সূচকে আমাদের অগ্রগতি আছে। মাতৃমৃত্যু কমেছে। তবে কমার গতি আগের তুলনায় ধীর হয়েছে। মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও নার্স, মিডওয়াইফারি ও চিকিৎসকের সংখ্যা বেড়েছে। স্বাস্থ্য খাতের নানা চ্যালেঞ্জ ও নতুন নতুন বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, একেও আমি অগ্রগতি বলে মনে করি। স্বাস্থ্যবিমা, জিপি সিস্টেম—এসব বিষয়ে তেমন অগ্রগতি না হলেও আলোচনার মধ্যে চলে এসেছে। নগর স্বাস্থ্যসেবার পরিস্থিতি ও এর কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। অসংক্রামক ব্যাধির বিপদ বিভিন্ন আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে। এগুলো নিশ্চয়ই ফল দেবে।

প্রথম আলো: কোথায় সমস্যা মনে করছেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: চিকিৎসাক্ষেত্রে জনগণের নিজের পকেটের ব্যয় বেড়েছে। বৈশ্বিক মান বিবেচনায় নিলে ১০০ টাকা চিকিৎসা ব্যয়ের ৩৫ টাকার বেশি রোগীর পকেট থেকে যাওয়া উচিত নয়। ২০১২ সালে আমাদের ব্যয় করতে হতো ৬০ টাকা। আর ২০১৫ সালে তা বেড়ে ৬৭ টাকা হয়েছে। মানে চিকিৎসার খরচ বেড়েই চলেছে। বৈশ্বিক মানের তুলনায় আমাদের বাজেটে চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ কম। তবে বাজেট কম, এর চেয়েও বড় কথা, অদক্ষ ব্যয় হচ্ছে। খরচ কাজে লাগছে না। হাসপাতাল বানানো হলো কিন্তু চিকিৎসকের নিয়োগ নেই। স্বাস্থ্যসংক্রান্ত অনেক সামাজিক দিনে মনোযোগ নেই। বিয়ের গড় বয়স এখনো ১৬-তে আটকে আছে। সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। যেভাবে নগরায়ণ হচ্ছে, তা জনস্বাস্থ্যের পরিপন্থী। আমাদের দেশ থেকে বড়সংখ্যক রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছে। এতে আমাদের অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার প্রকাশ। চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আমাদের সমস্যা রয়েছে। এটা উন্নত করা প্রয়োজন। শিক্ষার মান, কমিউনিটি মেডিসিন ও মেডিকেল কারিকুলামে সমস্যা রয়েছে।

প্রথম আলো: আপনি চিকিৎসা ব্যয় বাড়ার কথা বললেন। আমাদের দেশে চিকিৎসাসেবার বড় খাত হচ্ছে বেসরকারি খাত এবং এই খাতকে উপেক্ষা কারার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। এর একটি ব্যবসায়িক দিক রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ব্যয় কমানোর পথ কী?

হোসেন জিল্লুর রহমান: বেসরকারি খাতকে অবশ্যই উপেক্ষা করা যাবে না। কিন্তু একে নিয়মনীতির মধ্যে আনতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা একটি বড় ব্যবসার খাত হলেও এটি অন্য ব্যবসার থেকে আলাদা। এখানে নৈতিকতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিবেচনায় নিয়ে বেসরকারি খাতের জন্য যথাযথ বিধিবিধান ও তা যেন সবাই মেনে চলে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ওষুধের দাম, অযৌক্তিক নানা-পরীক্ষা, চিকিৎসকের প্রাইভেট প্র্যাকটিস—এসব বিষয়কে নীতিনৈতিকতার মধ্যে আনতে হবে। এ কাজ সহজ নয়, কিন্তু করতে হবে।

প্রথম আলো: সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এখন কোন কোন জায়গায় নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: প্রথমত, নগর স্বাস্থ্য নিয়ে নীতি সংস্কার জরুরি। দ্বিতীয়ত, অদক্ষ ব্যয় ও ব্যবস্থাপনা দূর করতে বড় ধরনের সংস্কার এবং তৃতীয়ত, মেডিকেল শিক্ষার বড় ধরনের সংস্কার জরুরি। সবচেয়ে বড় কথা, স্বাস্থ্যকে একটি কৌশলগত বিষয় হিসেবে নিতে হবে। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সম্পর্ক রয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন নিশ্চিত না করতে পারলে দারিদ্র্য দূর করা যাবে না। এটাকে শুধু চিকিৎসকদের আলোচনার বিষয় হিসেবে বিবেচনা না করে সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। এটা একটি কৌশলগত বিষয়।