'স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়লে অসুখ-বিসুখ কমবে'

>বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সাফল্য ও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা িনশ্চিত করার চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে কথা বলেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও আইসিডিডিআরবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য আব্বাস ভূঁইয়া। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিশির মোড়ল
.

প্রথম আলো: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখ করার মতো সাফল্য বা দিকগুলো কী কী বলে আপনি মনে করেন?
আব্বাস ভূঁইয়া: মৃত্যুহার কমা, বিশেষ করে শিশুদের এবং গড় আয়ু বাড়া। ১৯৭২ সালে প্রতি হাজার জীবিত জন্ম নেওয়া শিশুর মধ্যে ২২১ জন পাঁচ বছর বয়স হওয়ার আগে মারা যেত। ২০১৬ সালে এই হার কমে এসেছে ৩৪ জনে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে যারা জন্মগ্রহণ করত, তারা গড়ে ৫০ বছর বাঁচবে বলে আশা করা হতো আর যারা ২০১৭-এর দিকে জন্মগ্রহণ করেছে, তারা ৭২ বছর বাঁচবে বলে আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে আগে আমাদের দেশে মেয়েদের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার ছেলেদের থেকে বেশি ছিল আর মেয়েদের গড় আয়ু পুরুষদের থেকে কম ছিল। এখন মেয়েদের গড় আয়ু পুরুষের থেকে কয়েক বছর বেশি। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এগুলো অনেক বড় অর্জন। এই সব সম্ভব হয়েছে প্রধানত ভ্যাকসিন নেওয়া এবং ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার সঠিক চিকিৎসা নেওয়ার ফলে। সন্তান কম নেওয়া এবং এক সন্তান থেকে আরেক সন্তানের জন্মের ব্যবধান বাড়ছে এবং তা শিশুমৃত্যুর হার কমাতে অবদান রেখেছে।

প্রথম আলো: এসব সাফল্যের পেছনে সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও দাতাগোষ্ঠী—কে কী ভূমিকা পালন করেছে?

আব্বাস ভূঁইয়া: প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনা সেবাগুলো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে সরকার অবদান রেখেছে। এ ছাড়া খাওয়ার স্যালাইন ও ভ্যাকসিনকে জনপ্রিয় করতে সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সফলভাবে কাজে লাগিয়েছে। সত্তরের দশকে যেখানে দম্পতিপ্রতি ৬টি বাচ্চা হওয়া স্বাভাবিক ছিল, তা এখন কমে ২.৩টিতে এসেছে। স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা খাতে সরকার ও বেসরকারি খাতের সুচিন্তিত কার্যক্রম এবং দাতাগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা উন্নয়নে মূল্যবান ভূমিকা রেখেছে।

প্রথম আলো: স্বাস্থ্য খাতের এই অগ্রগতির পেছনে দেশের জনগণের কোনো ভূমিকা বা উদ্যোগ কাজ করেছে বলে মনে করেন কি?

আব্বাস ভূঁইয়া: জনগণের কার্যকর ভূমিকা ছাড়া কোনো উন্নয়নই সম্ভব নয়। যদিও আশির দশকে শিশুদের টিকা গ্রহণ, ডায়রিয়া চিকিৎসায় খাওয়ার স্যালাইন গ্রহণ ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার খুব কম ছিল। জনসাধারণকে যথাযথভাবে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব হয়। এ ব্যাপারে শিক্ষার প্রসার, বিশেষ করে নারীশিক্ষা বিশেষ অবদান রেখেছে। পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর ভূমিকা বেড়েছে, যা শিশু ও পরিবারের অন্যদের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষুদ্রঋণ ও শিক্ষা কার্যক্রম মেয়েদের ক্ষমতায়ন করতে সাহায্য করেছে।

প্রথম আলো: প্রতিবেশী কিছু দেশকে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসূচকে পেছনে ফেলেছে। এটা কী করে সম্ভব হলো?

আব্বাস ভূঁইয়া: বাংলাদেশ সরকার অনেক দূরদর্শিতার সঙ্গে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব উপলব্ধি করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে। সঠিকভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও দাতাগোষ্ঠীদের কাজে লাগিয়েছে।

প্রথম আলো: মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাকেই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সেবার মান বাড়াতে কোন কোন দিকে জোর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন?

আব্বাস ভূঁইয়া

আব্বাস ভূঁইয়া: মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রয়োজন সেবাদানকারীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও সেবার গুণগত মান নিয়মিত নজরদারি করা। এ ছাড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় জনবল, ওষুধ ও উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। জনসাধারণের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে অসুখ-বিসুখ প্রতিরোধ ও অসুস্থ হলে কী করণীয়, সে বিষয়গুলোতে তারা সচেতন থাকতে পারে। সে জন্য এসব বিষয় জনগণকে নিয়মিত জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সেবার ব্যাপারে নিয়মিত জনসাধারণের মতামত জানা এবং সময়মতো উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রথম আলো: আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবায় ‘আউট অব পকেট’ খরচ বেশি। স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ নিজের পকেট থেকে ব্যয় করে মানুষ। এটা বাড়ছে। কেন? এই খরচ কমাতে হলে কী করা উচিত বলে মনে করেন?

আব্বাস ভূঁইয়া: জনগণের পকেট থেকে খরচ কমাতে হলে অন্য কোথাও থেকে খরচের টাকা আসতে হবে। হয় সরকারি অনুদান অথবা স্বাস্থ্যবিমার মাধ্যমে। তবে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল জনগণের জন্য সরকারকেই খরচ বহন করতে হবে। স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়লে কিছু কিছু অসুখ-বিসুখ কম হতে পারে, সেই সঙ্গে চিকিৎসা খরচও।

প্রথম আলো: সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোথায় আছে? সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, এ ক্ষেত্রে কাজ বিশেষ কিছু হচ্ছে না। আপনার পরামর্শ কী?

আব্বাস ভূঁইয়া: কাজ একেবারেই হচ্ছে না, এমন বলা ঠিক হবে না। তবে যতটা গতিশীল হওয়া দরকার, তা হয়তো হচ্ছে না। আমার জানামতে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটা খসড়া দিকনির্দেশনা প্রস্তুত করেছে। খাতগুলো ধরে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে এগোতে হবে—এটাই তো পথ।

প্রথম আলো: দেশে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা নিয়ে গবেষণার উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান নেই। ব্যতিক্রম আইসিডিডিআরবি। বিএসএমএমইউ উল্লেখযোগ্য গবেষণাকাজ করছে না। আরও কোনো দেশি প্রতিষ্ঠান কেন গড়ে উঠল না? এ ক্ষেত্রে করার কিছু আছে কি?

আব্বাস ভূঁইয়া: বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু কিছু গবেষণা হচ্ছে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। গবেষণা ছাড়া উন্নয়ন বিঘ্নিত হবে। আমাদের প্রয়োজনীয় গবেষণা অন্যদের টাকায় কতটা হবে, বলা মুশকিল। স্বাস্থ্যবিষয়ক সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত কাজের অনেক চাপ। জাতীয়ভাবে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য গবেষণার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি তালিকা ও পরিকল্পনা থাকা উচিত। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সরকারি টাকায় গবেষণা করার জন্য গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা উচিত। আইসিডিডিআরবিকে আরও ভালোভাবে বাংলাদেশের কাজে লাগাতে পারলে সহজে সুফল পাওয়া যাবে।

প্রথম আলো: স্বাস্থ্যকে এগিয়ে নিতে কোন জায়গাগুলোতে সংস্কার করা দরকার বলে আপনি মনে করেন?

আব্বাস ভূঁইয়া: স্বাস্থ্যসেবায় তদারকি জোরদার করা, স্বাস্থ্যসেবাকে অতিমাত্রায় ওষুধনির্ভরশীল না করা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যানসার ও নারীদের অসুখ-বিসুখ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রতিরোধকে আরও গুরুত্ব দেওয়া। মুঠোফোনে ভিডিও কলের মাধ্যমে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াকে উৎসাহিত করা। হাসপাতালে ডেলিভারি নিশ্চিত করা। স্কুলশিক্ষা কার্যক্রমকে জোরদার করা। সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া। স্বাস্থ্য খাত ও চিকিৎসাবিষয়ক সিদ্ধান্ত ও নীতি গ্রহণকে অধিকতর গবেষণা ও তথ্যপ্রমাণনির্ভর করা।