২০০৭ সালের ২৯ নভেম্বর, সুন্দরবন থেকে ফিরে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দুই পর্ব ছাপা হয়ে গেছে। সম্পাদক ডেকে বললেন, ‘সুন্দরবন ধ্বংসের ঘটনা তো অনেক লেখা হলো। সুন্দরবনকে কীভাবে বাঁচানো যায়, সেটা তুলে আনো।’ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়েছে। দেশ–বিদেশে কাজ করা বিশেষজ্ঞদের কাছেও এ নিয়ে মতামত চাইলাম। ছাপা হলো প্রতিবেদন, ‘বিরক্ত না করলে বাঁচবে সুন্দরবন’।
শুরুটা অবশ্য আরও আগে। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ঘূর্ণিঝড় সিডর সুন্দরবনের ওপর দিয়ে বাগেরহাটের শরণখোলায় প্রথম আঘাত করে। সবার দৃষ্টি তখন ছিল শরণখোলার দিকে। তবে সুন্দরবনের বাধা পেয়ে ঝড়ের বাতাসের গতিবেগ যে প্রায় ১০০ কিলোমিটার কমে গেছে, তা প্রথম জানালেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ সুজিৎ কুমার দেবশর্মা।
১৫ নভেম্বর রাত থেকেই ঘূর্ণিঝড়বিধ্বস্ত এলাকাগুলোয় প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা একে একে রওনা হতে শুরু করলেন। ২৪ নভেম্বর ফটোসাংবাদিক জিয়া ইসলাম ও আমি রওনা হলাম সুন্দরবনের উদ্দেশে। ঝড়ে ক্ষতবিক্ষত সুন্দরবনের চিত্র, ঝড়ে উপড়ে পড়া গাছ, মৃত বাঘ, হরিণ, পাখিদের কথা পাঠকদের জানালাম। ধারাবাহিক প্রতিবেদনটির শেষ পর্বই ছিল সুন্দরবনকে বিরক্ত না করার ওই সংবাদ।
এরই মধ্যে আবার বিভিন্ন মহল থেকে বনের উপড়ে পড়া গাছ কেটে ফেলার পরামর্শ আসছে। বন বিভাগের একটি অংশ থেকেও উপড়ে পড়া গাছ কেটে ফেলার পক্ষে মত দেওয়া হলো। কিন্তু প্রথম আলোর সংবাদ প্রকাশের পর দৃশ্যপট পাল্টে গেল। সরকার সুন্দরবনকে বিরক্ত না করার সিদ্ধান্ত নিল। এক বছর যেতে না যেতেই সুন্দরবনের হারানো সবুজ ফিরে আসতে শুরু করল।
এরপর ২০০৯ সালের ২১ মে আঘাত হানল আরেকটি ঘূর্ণিঝড়—আইলা। সেবারও সেই সুন্দরবন বুক আগলে দিয়ে দেশের উপকূলের মানুষের ক্ষতি কমাল। বিশ্ব ঐতিহ্য ওই বন নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে বাংলাদেশকে বারবার ঝড়–জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করলেও মানুষ বারবার তাকে বিরক্ত করেছে। যেমন ২০১০ সালে সুন্দরবনের পাশে রামপালে দুটি কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হলো। সরকারের নিজের করা পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষায় (ইআইএ) উঠে এল ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের সম্ভাব্য ক্ষতির কথা। জাতিসংঘসহ দেশ–বিদেশের পরিবেশবাদী সংস্থাগুলোর আপত্তি আর আন্দোলন দানা বেঁধে উঠল। ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে–বিপক্ষের সব সংবাদ প্রথম আলোয় একে একে প্রকাশিত হতে থাকল। সরকার দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে একটি বাতিল করল।
২০১৪ সালের ১০ ডিসেম্বর একটি তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে যাওয়ার ফলে বনের মধ্যে প্রায় তিন লাখ লিটার তেল ছড়িয়ে পড়লে আবারও চলে গেলাম সুন্দরবনে। ছড়িয়ে পড়া তেলের কারণে বনের ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণীদের বিপদ আর সরকারের উদ্যোগ—সবই উঠে আসে প্রথম আলোর পাতায়। সরকার অস্থায়ীভাবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিলেও ২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় আবারও ওই নদী দিয়ে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয়। প্রথম আলোয় প্রকাশিত সেই খবরের পরে পরিবেশবাদীরা প্রতিবাদে নেমে পড়লেন। সরকার বাধ্য হয়ে শ্যালা নদীর বিকল্প পথ ঘসিয়াখালী খাল খননের কাজ শুরু করল। এক বছরের মাথায় সেই পথ চালু হলো আর বন্ধ হলো শ্যালা নদী দিয়ে নৌযান চলাচল।
২০১৪ সালে সুন্দরবনের নৌপথ নিয়ে কাজ করতে গিয়েই জানা গেল, বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সুন্দরবনের চারপাশে জমি কেনা শুরু করেছে। বনটির চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকা প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে চিহ্নিত। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, সেখানে কোনো ধরনের শিল্পকারখানা স্থাপন নিষিদ্ধ। জমির মালিকানার সব নথি ও সরকারি নিয়মকানুন ঘেঁটে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশিত হলো প্রথম আলোয়। সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত থেকে আদেশ এল, বনের চারপাশে কোনো শিল্পকারখানা স্থাপন করা যাবে না। আদালতের সেই নির্দেশনা এখনো বহাল আছে।
সুন্দরবনের পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির বাইরেও সেখানে প্রাচীন মানববসতি নিয়েও প্রথম আলো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছে। প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরোনো ওই সভ্যতার খবর প্রকাশের পর সরকারের নীতিনির্ধারক মহল থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষকদের দৃষ্টিতে আসে সুন্দরবন। ওই প্রতিবেদনের পর বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমগুলোতে তা পুনঃপ্রকাশিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির একদল ভূতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক সুন্দরবনের প্রাচীন মানববসতি নিয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা করছেন। সেখানে অনেক নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে। প্রথম আলো অতীতের মতো সামনের দিনগুলোতেও সুন্দরবনের পাশে থাকবে। সুন্দরবনের পক্ষ থেকে সংবাদ প্রকাশ করে যাবে।