>১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে নারায়ণগেঞ্জ পতিতাপল্লি উচ্ছেদ করা হয়। সেই সময়ে এই ঘটনার প্রতিবাদ ওঠে বিভিন্ন মহলে। প্রথম আলোর কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব সুফিয়া কামাল এ ঘটনাকে পুনর্বাসন নয়, উচ্ছেদ হিসেবে অভিহিত করেন। সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদনটি ছাপা হয় ৫ আগস্ট।
‘পতিতাদের নিয়ে যা করা হচ্ছে এটাকে কি পুনর্বাসন বলা যায়? এটাতো রীতিমতো উচ্ছেদ। কোনো পরিকল্পনা নেই, কোনো দূরদৃষ্টি নেই, নারী নেত্রী, নারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা নেই, দুম করে একটা কাজ করলেই সেটা পুনর্বাসন হলো? এতই সহজ? জীবনে কম তো দেখলাম না।
নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পতিতা বিয়ে দিয়েছি। ওদের পরিবারের আয়রোজগারের পথ করে দিয়েছিল নারী পুনর্বাসন সংস্থা থেকে। দুদিন পর শুনতে পেলাম, যে লোক এত ভালো ভালো কথা বলে মেয়েটাকে বিয়ে করে নিয়ে গেল সেই তাকে দিয়ে পতিতাবৃত্তি করাচ্ছে। সেই কারণে পরের দিকে নারী পুনর্বাসন সংস্থার উদ্যোগেই বলুন, মহিলা পরিষদের উদ্যোগেই বলুন, পতিতাদের বিয়ে দেয়ার চাইতে তার চিকিৎসা, তার বিকল্প অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, তার বাচ্চার লেখাপড়া এসব কাজই আমরা করেছি। এখনো করছি।
পতিতাদের পুনর্বাসন করতে গিয়ে পতিতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন কঠিন বাস্তব সত্যের মুখোমুখি হয়েছি যে, নিজেরাই বুঝেছি এ ধরনের পুনর্বাসন আসলে ওদের জীবনে ইতিবাচক হবে না। ওদের কঠিন প্রশ্নের মুখে কোনো উত্তর দিতে পারিনি। ফিরে এসেছি। ব্যাপারগুলো এত সহজ না।
সারাটা জীবন মেয়েদের অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে থাকলাম। অথচ এখন দেখছি যে ভুলগুলো জীবনের শুরুতেই কাজের মধ্য দিয়ে জেনেছিলাম, আজ এত বছর পর সেই ভুল পথেই যেন আমরা হাঁটছি। ভাসা–ভাসা ধারণা নিয়ে, মূল সমস্যা অনুধাবন না করে, উপরে উপরে ‘দরদ’ দেখিয়ে পতিতা পুনর্বাসন হয় না।
আর সবচেয়ে দুঃখজনক কথা, এত বড় একটা ঘটনা ঘটল, মেয়েগুলোর ওপর এত বড় অন্যায় করা হলো অথচ একটা পুরুষ মানুষ মুখ খোলে না?’
বলছিলেন সুফিয়া কামাল। কথা বলতে কষ্ট হয়, বিছানার ওপর কিছুক্ষণ বসে থাকলেও ক্লান্ত হয়ে পড়েন। এক গ্লাস পানি খেতে হলেও যঁাকে মাথার কাছে বালিশের পাশে রাখা ছোট্ট ঘণ্টাটা বাজাতে হয়, সেই মানুষটা খাটের পাশে স্তূপ করে রাখা দৈনিক পত্রিকাগুলোর দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে বললেন—‘আজকাল সাহসী লোকেরা সাহস বুকে চেপে ঘরে বসে থাকে। যোগ্য লোকেরা সাত-পাঁচ ভেবে কোনো কিছুতে জড়াতে চায় না। এভাবে হবে? সমাজে এত লোক অথচ একটা পুরুষ মানুষের যেন কিছু যায় আসে না? কেউ মুখ ফুটে অন্যায়ের প্রতিবাদ করল না। প্রতিকারের পথ দেখাল না। মেয়েদের পক্ষে দাঁড়াল শুধু মেয়েরাই। মেয়েরা নিজেরাই প্রতিবাদ করছে। মিছিল করছে। কিন্তু এই মেয়েরা তো শুধু প্রতিবাদই করতে পারবে। প্রতিকারের ক্ষমতা তো এদের হাতে নাই।’
গায়ের চাদরটা একটু টেনে নিয়ে চোখটা বন্ধ করলেন তিনি। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমিই বা কী বলব? বয়সের ভারে আমিও তো রাস্তায় নামতে পারছি না। ৩০–৩৫ বছর আগের কথা মনে পড়ে। তখন আইয়ুব খানের আমল। পতিতাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে একটা কমিটি করা হলো। অনেকেই ছিলেন। আকবর কবীর ছিলেন, ডা. নন্দী ছিলেন। আমি ছিলাম। আরও অনেকে। পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন পতিতালয়ে ঘুরেছি। কত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। পরিষ্কার মনে আছে একজন ডাক্তার আমাকে বলেছিলেন, বাড়ি বানাতে হলে আপনারা ড্রেন রাখেন না? পতিতালয়গুলো সমাজের ড্রেন। এটা বন্ধ করতে গেলে ময়লা উপচে পড়বে...। পতিতাদের সঙ্গে সরাসরি কথা হয়েছিল। তারা কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন করে, আমার একার পেট সরকার চালাবে। আমার সংসারের আরও ৬টা পেট কে চালাবে? বলেছিল, ‘আজকে এত ভালো ভালো কথা বলছেন, এই সমাজ আমাদের নেবে? আবার ফিরে আসতে হবে এই পতিতালয়েই। বরং আমার মেয়েটার জন্য কিছু করেন’। সেই কমিটি এসব রিপোর্টই জমা দিয়েছিল।
সুফিয়া কামাল বললেন, ‘বছর বছর আগে যে কঠিন সত্য জেনে গেছি আজ থুক্কু দিয়ে সেগুলোর সামনেই যেন আবার পড়তে হচ্ছে। আরেকটা কথা বলি। মাওলানা সাহেবরা পতিতাদের তওবা করালেন। এই পতিতাই যখন আবার তার পেশায় ফিরে আসতে বাধ্য হবে, তখন এই তওবার কী অর্থ থাকবে? তা ছাড়া মেয়েটাকে দিয়ে তওবা পড়ালেই পতিতাবৃত্তির দোষ কেটে গেল? পতিতালয়ে যারা যায় সেই সব পুরুষ মানুষদের তওবা পড়াবে কে? শাস্তি শুধু মেয়েটার একার জন্য কেন? পতিতালয় একটা ব্যবসা। এখানে মেয়েগুলোকে দিয়ে যে কাজ করানো হয় তার থেকে উপার্জিত অর্থের ভাগ বাড়িওয়ালা, দালাল, পুলিশ থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষের পকেটেও ঢোকে। তারা সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে অথচ মেয়েগুলোকে নিয়েই টানাহ্যাঁচড়া? এত বড় অন্যায় কী করে সম্ভব?’
‘হ্যাঁ, তাই বলে কি পুনর্বাসন সম্ভব নয়? নিশ্চয়ই সম্ভব। কিন্তু সেটার মধ্যে থাকতে হবে সদিচ্ছা, আন্তরিকতা। মহিলা পরিষদের রোকেয়া সদনে আমরা এমন মেয়ে এনে রেখেছি। তাদের বাচ্চা স্কুলে যাচ্ছে। মেয়েটাও হাতের কাজ শিখে স্বনির্ভর হচ্ছে। ছোট পরিসরের উদ্যোগ। কিন্তু হচ্ছে তো। একজন বিদেশির সঙ্গে টানবাজারের একজন পতিতার বিয়ে দিয়েছিলাম। লোকটাই প্রবল আগ্রহ দেখাল। মেয়েটা হল্যান্ডে আছে। সুখে আছে। আমাকে ফান করে। মহিলা পরিষদে ফোন করে। তবে এটা তো ব্যতিক্রম। কিন্তু যখন কাজটা সরকারি উদ্যোগে ব্যাপকভাবে হবে তখন তো ব্যাপক পরিকল্পনাও থাকতে হবে। আজ যারা অভিভাবকের নাম দিয়ে পতিতাদের নিয়ে যাচ্ছে, তারা এত দিন কোথায় ছিল? এরা যে দালাল নয়, এরা যে মেয়েটাকে দিয়ে ব্যবসা করাবে না, এই গ্যারান্টি কে দেবে? পত্রিকায় ছবি দেখলাম মেয়েগুলোর গায়ে হাত তোলা হয়েছে। কেন? ওরা মানুষ না? সমাজে অনেক বড়লোকের ঘরেই পতিতাবৃত্তি হয়। প্লেনে করে নামে প্লেনে করে চলে যায়। গাড়িতে নামে গাড়িতে চলে যায়। তাদের গায়ে তো ফুলের টোকা পড়ে না। তাদের নিয়ে তো মাথা ঘামাতে কেউ সাহস পায় না। এই গরিবের মেয়েগুলোর ওপর কেন এত অত্যাচার? কাকে কী বলব? কার কাছে বিচার চাব? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক পুলিশ সেই পুলিশই এদের পেটায় বেশি।’
‘আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করেন, এখন কী হবে? পতিতা পুনর্বাসন নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধান কী? আমি এ প্রশ্নটাই সমাজের কাছে, সরকারের কাছে সরাসরি করতে চাই, এখন সমাধান কী? অতীতে কান্দুপট্টি উচ্ছেদের পরে পতিতারা ভাসমান হয়েছে। না খেয়ে তাদের মারা যাবার জোগাড়। থাকার জায়গা নাই। অন্যদিকে সমাজ কলুষিত হয়েছে আরও বেশি। তা ছাড়া পতিতাদের এভাবে উচ্ছেদ করলে যৌনরোগ যে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে যাবে, এ কথাটা কেন বুঝতে এত কষ্ট?’
‘পতিতাই হোক আর মহীয়সীই হোক মেয়েরা মায়ের জাত। কোনো মেয়েই চায় না দেহ বিক্রি করতে। পুরুষ মানুষরাই তাকে এ পথে ঠেলে দেয়। তারপর বাধ্য হয়েই এরা এ বৃত্তি অবলম্বন করে। আশ্চর্য লাগে পতিতাদের নাকি লাইসেন্স থাকে, অথচ তারা মারা গেলে তাদের মাটি হয় না! পতিতাবৃত্তি কখনই কাম্য নয়। কিন্তু এর মানে এই নয় যে এদেরকে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করতে হবে। কাজে উচ্ছেদ করলাম আর মুখে পুনর্বাসন বললাম তবেই কি সাতখুন মাফ?
হঠাৎ এই গরমেও শীতের কাঁপুনি ধরল তঁার গায়ে। ৮৮ বছর পার হওয়া মানুষটি বললেন, ‘এটা বয়সের শীত’ গরম চা এল তঁার জন্য। কাঁপতে কাঁপতেই চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খেলেন। কিন্তু গোটা মুখটায় কষ্টের ছাপ।
‘শরীর খারাপ লাগছে আপনার?’
শরীরের কাছে তো হেরেছি অনেক আগেই। নতুন করে আর কী খারাপ হবে? কিন্তু ভাবছি সারাটা জীবন রাস্তায় থেকেই অন্যায়ের প্রতিবাদের শামিল হলাম। মেয়েদের যেন সমাজ ‘মানুষ’ হিসেবে দেখে সেই চেষ্টা করে গেলাম। অথচ আজ শেষবেলায় এসে দেখছি কিছুই করে যেতে পারিনি। এত বড় অন্যায় মেয়েগুলোর ওপর হচ্ছে একটা পুরুষ মানুষ মুখ খুলছে না। উল্টো তামাশা দেখছে সবাই। বড় ক্লান্ত লাগছে। এতটা পথ হাঁটলাম, অথচ মনে হচ্ছে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি...।
আরও পড়ুন :