>
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা জাতিসংঘ শান্তি মিশনে অংশ নিয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল আব্দুল হাফিজ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালন করেছেন। এসব মিশনের মধ্যে রয়েছে ইরাক, কুয়েত, ক্রোয়েশিয়া, আইভরিকোস্ট ও পশ্চিম সাহারা। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের এই সক্রিয় অংশগ্রহণ ও গৌরবময় ভূমিকা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে । সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মদ লুৎফুল হক
প্রথম আলো: স্বাধীনতা–পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জনগুলোর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি অন্যতম। কেন আমরা এটিকে একটি বড় অর্জন হিসেবে দেখছি?
আব্দুল হাফিজ: ১৯৮৮ সালে শান্তিরক্ষা মিশনে প্রথম অংশ নিয়ে মাত্র ৩০ বছরে আমরা যে অবস্থানে পৌঁছে গেছি, তা ঈর্ষণীয়। ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত শান্তিরক্ষা মিশনে জনবলের হিসাবে আমরা ছিলাম শীর্ষে, এখন আমরা আছি দ্বিতীয় অবস্থানে।
আমরা প্রায় ৪০টি দেশে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়েছি এবং কয়েকটি দেশে এখনো দায়িত্বরত আছি। এই দেশগুলোর সরকার থেকে সাধারণ মানুষ—সবাই আমাদের বিষয়ে জানতে পারছে। এ ছাড়া প্রতিটি মিশন এলাকায় আমরা সাত-আটটি ভিনদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাই। ফলে আরও ৪০-৫০টি দেশের সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ ও বেসামরিক কর্মীরা আমাদের সংস্পর্শে আসছে।
দায়িত্বকালে প্রতিটি মিশন এলাকায় আমাদের পতাকা শোভা পায়। শান্তিরক্ষীদের মাধ্যমে আমাদের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেওয়ায় আমাদের কূটনৈতিক শক্তিরও উৎকর্ষ সাধিত হয়। শান্তিরক্ষায় আমাদের অত্যাবশ্যকীয়তার কারণে আমাদের ‘সফট পাওয়ার ইমেজ’ বাড়তির দিকে। এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
প্রথম আলো: শান্তিরক্ষায় অংশ নিয়ে বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তির উন্নতির জন্য আপনি কাকে কৃতিত্ব দেবেন?
আব্দুল হাফিজ: এটা কারও একক কৃতিত্ব বলে মনে করছি না। সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের পরিশ্রম, নিষ্ঠা, পেশাদারি ইত্যাদির জন্য তাঁদের অবশ্যই কৃতিত্ব দেওয়া যেতে পারে। তবে ১৯৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত সব সরকারকেও কৃতিত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
প্রথম আলো: শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়ে দেশের ভাবমূর্তির উন্নতি ও ইতিবাচক পরিচিতি বৃদ্ধির পাশাপাশি আমরা আর কীভাবে লাভবান হচ্ছি?
আব্দুল হাফিজ: অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যক্ষ লাভ হচ্ছে দুভাবে। প্রথমত, শান্তিরক্ষা মিশনে আমরা ভারী অস্ত্র ও যানবাহন, আরমার্ড ভেহিকল, ইঞ্জিনিয়ারিং প্ল্যান্ট ইত্যাদিসহ বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে যাই। জাতিসংঘ এগুলোর বিপরীতে আমাদের নির্দিষ্ট হারে রিইমবার্সমেন্ট বা ব্যয় পরিশোধ করে। ফলে আমরা যদি কোনো মিশনে ৩ থেকে ৫ বছর অংশ নিই, তবে এসব অস্ত্র, যানবাহন ও অন্যান্য সামগ্রী ক্রয়ে যে অর্থ ব্যয় হয়, তা জাতিসংঘের ব্যয় পরিশোধ পদ্ধতিতে সরকার ফেরত পেয়ে যায়। উপরন্তু সেই অস্ত্র বা যানবাহন আরও কিছুদিন অন্য মিশনে বা দেশে ফেরত এনে প্রশিক্ষণ বা অভিযানে ব্যবহার করা যায়। দ্বিতীয়ত, আমাদের সৈনিক বা পুলিশ সদস্যরা শান্তিরক্ষার দায়িত্বে থাকাকালে জাতিসংঘ থেকে ভাতা পেয়ে থাকেন। ফলে শান্তিরক্ষীরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হন।
প্রত্যক্ষ লাভের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু পরোক্ষ লাভেরও সম্ভাবনা থাকে। যেমন আমরা যে দেশে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিই, আমাদের সরকারের সঙ্গে সে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে এই যোগাযোগকে কেন্দ্র করে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
প্রথম আলো: মিশনে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আমাদের সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের আরও সমৃদ্ধ করে...?
আব্দুল হাফিজ: নিশ্চয়ই। মিশন এলাকায় সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন ধরনের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। শান্তিরক্ষীদের প্রায়ই বিক্ষুব্ধ দুই বা ততোধিক দলের মাঝখানে যুদ্ধাবস্থায় অবস্থান করতে হয়। এই অভিজ্ঞতা তাঁদের জন্য খুবই মূল্যবান। যুদ্ধে অংশ নেওয়া ছাড়া স্বাভাবিক সময়ে এ অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায় না।
শান্তিরক্ষীরা মিশন এলাকায় দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নেন। এই প্রশিক্ষণ দেশে স্বাভাবিক অবস্থায় গ্রহণ করার সুযোগ খুবই সীমিত। যেমন আরমার্ড পারসোনাল ক্যারিয়ার বা এপিসির প্রশিক্ষণ ও ব্যবহার বেশ ব্যয়বহুল। এ ছাড়া আমাদের দেশের সব এলাকায় এগুলো ব্যবহারও করা যায় না। মিশন এলাকায় আমাদের সৈনিকেরা অবাধে এপিসি ব্যবহার করার সুযোগ পান। একইভাবে ইঞ্জিনিয়ািরং কোরে সৈনিকেরা বড় বড় প্ল্যান্ট পরিচালনার, গাড়িচালকেরা ভারী যানবাহন চালানোর এবং ডাক্তারেরা হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার সুযোগ পান। পুলিশ সদস্যরাও বহুজাতিক পরিবেশে সর্বোচ্চ মানের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
শান্তিরক্ষার অংশ হিসাবে আমরা ন্যাটো অথবা ন্যাটোবহির্ভূত দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ প্রশিক্ষণে অংশ নিই। ফলে সৈনিকদের দক্ষতা ও মনোবল বৃদ্ধি পায়।
প্রথম আলো: বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শান্তিরক্ষা মিশনে নারীর ক্ষমতায়ন কীভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে?
আব্দুল হাফিজ: ২০০০-২০০১ সালে শান্তি পরিষদে ‘নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা’ শিরোনামে ১৩২৫ নং রেজল্যুশন গ্রহণ করা হয়। সেখানে উল্লেখ আছে, দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন বাঞ্ছনীয়। এই রেজল্যুশন গ্রহণে বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। এ পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনী থেকে ৩২৪ জন এবং পুলিশ থেকে ১ হাজার ১১১ জন নারী সদস্য বিভিন্ন মিশনে অংশ নিয়েছেন। শতভাগ মহিলা পুলিশের একটি দল ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত হাইতিতে দায়িত্ব পালন করেছে। কন্টিনজেন্ট অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশই প্রথম একজন মহিলাকে শান্তিরক্ষা মিশনে পাঠিয়েছিল।
প্রথম আলো: আমরা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে ধারণা পেলাম। এবার এ বিষয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু বলুন।
আব্দুল হাফিজ: বিশ্বশান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের বর্তমান মূলমন্ত্র হচ্ছে, অশান্তি সৃষ্টির আগেই শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ সংঘাত–পরবর্তী শান্তিরক্ষার চেয়ে সংঘাতপূর্ব নিরোধক ব্যবস্থাকে জাতিসংঘ বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এ কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে সংঘাত এড়ানোর জন্য জাতিসংঘ কূটনৈতিক পদক্ষেপ, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু করায় বেশি জোর দিচ্ছে।
যেসব দেশ শান্তিরক্ষা মিশনগুলো পরিচালনার জন্য আগে মোটা তহবিল দান করত, তারা এখন দানের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। তারা আগের মতো আর উদারতা দেখাচ্ছে না। এসব কারণে শান্তিরক্ষা মিশনের সংখ্যাই কমে আসছে।
আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে মিশন পরিচালনার সুবিধার্থে জাতিসংঘ ভাষা ও সংস্কৃতির মিল আছে, এমন দেশ থেকে শান্তিরক্ষীদের সুযোগ বেশি দিয়ে থাকে। বর্তমানে বেশির ভাগ মিশনই আফ্রিকা মহাদেশে পরিচালিত হওয়ার ফলে আফ্রিকার দেশগুলো আমাদের চেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছে। উপরন্তু অনেক দেশ, যারা আগে শান্তিরক্ষা মিশনে আসত না, তারাও এখন এগিয়ে আসা শুরু করেছে। সব মিলিয়ে শান্তিরক্ষা মিশনে আমাদের অংশগ্রহণ ভবিষ্যতে কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম
জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা
২৪ অক্টোবর ১৯৪৫
শান্তিরক্ষা মিশন শুরু
২৯ মে ১৯৪৮
শান্তিরক্ষা মিশনের সংখ্যা
৭১টি
অংশগ্রহণকারী দেশ
১২০টি
বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ
১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম শান্তিরক্ষা মিশনে যাত্রা
১৪ আগস্ট ১৯৮৮
বাংলাদেশ নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রথম শান্তিরক্ষা মিশনে যাত্রা
১৯৯৩
বাংলাদেশ পুলিশের প্রথম শান্তিরক্ষা মিশনে যাত্রা
এপ্রিল ১৯৮৯
শান্তিরক্ষা মিশনে নিহতের সংখ্যা
১৪৪
আহতের সংখ্যা
২২৫