ঘটনাই ঘটেনি, মামলা করে রেখেছে পুলিশ। গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোর প্রথম পাতায়। অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন সেদিন। তবে তাঁদের বিস্ময়ের ঘোর কাটতে দেরি হয়নি। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগ পর্যন্ত পুলিশ দেদার মামলা করেছে। প্রথম আলোও তার দায়িত্ব পালন করে গেছে।
প্রথম যে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছিল, সেটি লিখেছিলেন অপরাধ বিভাগের প্রধান কামরুল হাসান। প্রতিবেদনের শুরুটা ছিল এ রকম, ‘হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নাজমুল ইসলাম ১২ আগস্ট নিজের থানায় একটি মামলা করেছেন। আসামি ৭০ থেকে ৮০ জন, সবাই অজ্ঞাতনামা। অভিযোগ হচ্ছে, গত ৩০ জুলাই হবিগঞ্জ শহরের জে কে অ্যান্ড হাইস্কুলের সামনে আসামিরা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, যানবাহন ও সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন এবং সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা করেছে। যে সময় এই মামলা হয়েছে, একই সময় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে পথে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ৩০ জুলাই হবিগঞ্জ শহরে এ রকম কিছুই ঘটেনি।’ প্রতিবেদনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক সূত্রকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ওপরের নির্দেশে মাঠপর্যায়ে এমন মামলা হচ্ছে।
এক মাসের কম সময়ের ব্যবধানে অক্টোবরের ১ তারিখ হাতিরঝিল থানায় মামলা হলো। আসামি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির শীর্ষ কয়েকজন নেতা। অভিযোগ অনেক, উসকানিমূলক বক্তব্য থেকে পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুরুতর জখম করা পর্যন্ত। এর মধ্যেই প্রথম আলো এ ধরনের মামলাকে ‘গায়েবি মামলা’ নাম দিয়েছে। আর প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা এমন মামলার খবর ছাপছে।
তবে গায়েবি মামলার ব্যাপকতাটা মানুষ টের পায় গত বছরের ২০ ডিসেম্বর ‘এক ভয়ংকর সেপ্টেম্বর’ পড়ে। গোলাম মোর্তুজা ও মো. আসাদুজ্জামানের ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, পুলিশ বাদী হয়ে ওই মাসে ঢাকায় নাশকতার ৫৭০টি মামলা করেছে। উদ্ধার করেছে ১ হাজার ১৮৬টি ককটেল ও ৩৭০টি পেট্রলবোমা। পুলিশের ওপর হামলার সংখ্যা রেকর্ড করা হয়েছে ৯০টি। ওই দুই প্রতিবেদক যেখানে যেখানে নাশকতার অভিযোগ উঠেছিল, সেখানে সেখানে ছুটলেন। প্রমাণ করে ছাড়লেন ‘গায়েবি মামলা’ হচ্ছে।
ডিসেম্বরের দিকে কাজের ধরন বদলায় প্রতিবেদকদের। তখন দৌড়ঝাঁপ শুরু আদালতে। রোজ দুপুরের দিকে আদালতের সামনে গায়েবি মামলার আসামিতে ঠাসা প্রিজন ভ্যান এসে থামত। আর নিয়ম করে এক বা একাধিক প্রতিবেদক তুলে আনতেন মানুষের হয়রানির চিত্র। এখানেই শেষ নয়। নির্বাচনের পর যাঁরা গ্রেপ্তার এড়িয়ে ছিলেন ‘খড়ের গাদা, মেশিনঘর, এমনকি কবরস্থানে’, তাঁরা হাইকোর্টে জামিনের জন্য ভিড় করতে শুরু করেন চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে। প্রথম আলোও তাঁদের সঙ্গে ছোটে হাইকোর্টে। আসামি হিসেবে পাওয়া যায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী লালনের অনুসারী, জন্ম থেকে হাত অকেজো, পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষদের।
রাজনৈতিক হয়রানির এই অনন্য নজিরের পেছনে এখনো ছুটছেন আমাদের প্রতিবেদকেরা।