ফিরে দেখা ১৮:২০১২ ২৯ জুলাই

হলমার্কের ২৭৩১ কোটি টাকার কারসাজি

স্বল্প পরিচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী হল–মার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা থেকে নানা কারসাজি করে মোট ২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বের করে নিয়ে যায়, যা দেশের ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতির ঘটনা। সোনালী ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এই ঘটনা। ২০১২ সালের ২৯ জুলাই প্রকাশিত হয় এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।

সোনালী ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদন: শাখা কর্মকর্তারা ছাড়া প্রধান কার্যালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত জিএম, ডিজিএম ও শাখা নিয়ন্ত্রক কার্যালয় দায়ী

স্বল্প পরিচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী হল–মার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (শেরাটন হোটেল) শাখা থেকে নানা কারসাজি করে মোট ২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বের করে নিয়ে গেছে। এই শাখা থেকে আরও কয়েকটি কোম্পানি মিলে প্রায় একই প্রক্রিয়ায় ৩ হাজার ৫৫০ কোটি টাকার ঋণ দায় তৈরি করেছে।
সোনালী ব্যাংকের নিজস্ব নিরীক্ষা ও পরিদর্শন প্রতিবেদনে এসব তথ্য বের হয়ে এসেছে। প্রতিবেদনে ব্যাংকের শাখার ব্যবস্থাপক ও সহকারী শাখা ব্যবস্থাপকের পাশাপাশি প্রধান কার্যালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক (জিএম), উপমহাব্যবস্থাপক ও শাখা নিয়ন্ত্রক কার্যালয়কে এর জন্য দায়ী করা হয়েছে।
নিরীক্ষা ও পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসে হল–মার্কের নামে সর্বাধিক ঋণ সৃষ্টি হয়। এই সময়ে ব্যাংকটির যাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেননি, নির্লিপ্ত থেকেছেন। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে হল–মার্ক থেকে সুবিধা নেওয়ার ইঙ্গিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

তিন মাস ধরে নিরীক্ষা করে সোনালী ব্যাংকের নিজস্ব পরিদর্শক দল এ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে। এর অনুলিপি দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে।

সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে যখন হল–মার্ক টাকা বের করে নিচ্ছিল, তখন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন হুমায়ুন কবীর। মাস খানেক আগে ব্যাংকটির এমডি পদে যোগ দিয়েছেন প্রদীপ কুমার দত্ত। তিনি গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ইতিমধ্যেই কিছু ব্যবস্থা নিয়েছেন। নিজেদের নিরীক্ষা শেষ হওয়ার পর এখন পেশাদার নিরীক্ষক দিয়ে নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এর ভিত্তিতে দায়দেনা নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ঋণগুলোর জামানতও নিশ্চিত করা হচ্ছে।

আগের এমডি হুমায়ুন কবীর গতকাল বলেন, ‘যখন আমি এই ঘটনা জেনেছি, ব্যবস্থা নিয়েছি। পরিচালনা পর্ষদকে জানিয়েছি।’ তিনি দাবি করেন, যা হয়েছে তা তাঁর অজ্ঞাতে হয়েছে।

তবে ব্যাংকটির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, হল–মার্কের অর্থ সরিয়ে নেওয়ার বিষয় খতিয়ে দেখতে নিরীক্ষক পাঠানোর পরদিনই সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের একজন জিএম ও ডিজিএমকে তাত্ক্ষণিক ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়। জানতে চাইলে হুমায়ুন কবীর দাবি করেছেন, এ ঘটনার জন্য নয়, তাঁদের অন্য কারণে বদলি করা হয়েছিল।

ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অর্থনীতিবিষয়ক নন প্রধানমন্ত্রীর এমন একজন উপদেষ্টা পুরো বিষয়ে হল–মার্কের পক্ষে ব্যাংকের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন।

প্রসঙ্গত, গত ২৪ মে প্রথম আলোয় সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে অখ্যাত হল–মার্ক গ্রুপের দুই হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়ার বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তখনই জানা গিয়েছিল, হল–মার্কের অর্থ বের করে নেওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদনেই।

কারণ, ওই শাখায় গত মার্চ মাসে আমানতের পরিমাণ ছিল মাত্র ৬০৯ কোটি, আর এপ্রিলে ছিল ৬৫৬ কোটি টাকা। কিন্তু হল–মার্ককেই দেওয়া হয় এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ। অর্থাৎ​ অন্য শাখা থেকে এনে প্রধান কার্যালয়কে এই অর্থের জোগান দিতে হয়েছে। এ কাজ ব্যাংকের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনুমোদন ছাড়া কোনোভাবেই হওয়ার সুযোগ নেই।

যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক (ইডি) এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব পরিদর্শন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইতিমধ্যেই কিছু নির্দেশনা সোনালী ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে ব্যাংক খাতে এ ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু নীতিগত নির্দেশনা তৈরি করে ব্যাংক খাতের জন্য তা বাধ্যতামূলক করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখার ব্যবস্থাপক ও সহকারী ব্যবস্থাপককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল হল–মার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদের মুঠোফোনে দফায় দফায় চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। তারপর খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠিয়েও তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি।

তবে এর আগে হল–মার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) তুষার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘হয়তো কিছু অনিয়ম হয়েছে। আমরা সবকিছু নিয়মিত করে নিতে চাই। ইতিমধ্যেই ঋণের বিপরীতে কিছু নতুন জামানত রেখেছি।’

কারসাজির নমুনা: ব্যাংক থেকে হল–মার্কের নেওয়া পৌনে তিন হাজার কোটি টাকার মধ্যে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও চলতি মূলধনজাতীয় ঋণও আছে। তবে এ অর্থের ৮০-৮৫ ভাগই নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে স্থানীয় ঋণপত্র (এলসি) খুলে বের করে নেওয়া হয়েছে।

যেমন—গত ২৮ মার্চ হল–মার্ক গ্রুপ রূপসী বাংলা শাখাতে সুতা কিনতে আনোয়ারা স্পিনিং মিলস, ম্যাক্স স্পিনিং মিলস ও স্টার স্পিনিং মিলসের অনুকূলে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার স্থানীয় ঋণপত্র খোলে। বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান তিনটিও একই শাখার গ্রাহক। একই দিনে এই এলসির অর্থ পরিশোধে নিশ্চয়তা (অ্যাকসেপটেন্স) দেয় হল–মার্ক। তার বিপরীতে একই শাখা তিন প্রতিষ্ঠানের (অ্যাকসেপটেন্স বিল কিনে নিয়ে) হিসাবে টাকা জমাও করে দিয়েছে। এলসির প্রক্রিয়াটি ছিল কাগজপত্রে। কিন্তু নির্ধারিত অংশ জমা রেখে (মার্জিন) ব্যাংক তিন কোম্পানির হিসাবেই টাকা জমা করে দেয়।

এর কয়েক দিন পরই এই প্রতিষ্ঠান তিনটি ওই পুরো টাকা হল–মার্ককে দিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা দেয় ব্যাংককে। ব্যাংক যথারীতি এই তিন প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে অর্থ কেটে হল–মার্কের হিসাবে জমা করে নতুন নজির তৈরি করে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরে হল–মার্কের হিসাব থেকে সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনালের নামে খোলা একটি চলতি হিসাবে টাকা স্থানান্তর করা হয়। সেখান থেকে টাকাগুলো ‘সুচতুরভাবে’ বের করে নেয় হল–মার্ক গোষ্ঠী। আনোয়ারা স্পিনিং মিলস, ম্যাক্স স্পিনিং মিলস ও স্টার স্পিনিং মিলস এবং সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনালের নামে খোলা চলতি হিসাবগুলো অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান। এগুলো প্রকৃত অর্থে হল–মার্কের বেনামী প্রতিষ্ঠান বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক থেকে অর্থ বের করে নেওয়ার ক্ষেত্রে হল–মার্ক ৪২টি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেছে। প্রাথমিকভাবে এগুলো ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল এমন ৮৪টি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারের তথ্য পেয়েছিল। সোনালী ব্যাংকের প্রতিবেদনে এর মধ্যে গোটা বিশেক প্রতিষ্ঠানকে ‘নিশ্চিত ভুয়া’ বলা হয়।

আরও পড়ুন :