দেশে কর্মব্যস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এই ব্যস্ততা গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি। যে কারণে প্রতি ঘণ্টা ঠিকঠাক হিসাব করতে হচ্ছে। নষ্ট করার মতো সময় কারও হাতে নেই। ফলে প্রতিদিন বাজার করার ব্যাপারটাও কমে আসছে। এ বাজার সে বাজার ঘুরে চাল, ডাল, সবজি বা মাছ কেনার সময় কোথায়! তাই দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে সুপারশপের ধারণা।
যেখানে এক ছাদের নিচে আরামে সব কেনাকাটা করা যায়।বাজারের ব্যাগ বা চালের বস্তা টানার ঝামেলা নেই। মাছের গা টিপে দেখারও খুব একটা দরকার পড়ে না।বাড়তি সুবিধা হিসেবে গ্রোসারি পণ্যের দোকানেই মেলে পোশাক, প্রসাধনী, শুকনো খাবার, মসলাপাতি বা বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য। ঢাকা শহরে তো বটেই, দেশের অন্য বড় শহরগুলোতেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে সুপারশপ। তাই নিয়মিতই বাড়ছে সুপারশপের সংখ্যা।
অথচ বাংলাদেশে সুপারশপের সংস্কৃতি খুব বেশি দিনের নয়। ২০০১ সালে রিটেইল সুপারশপ হিসেবে দেশের বাজারে আসে রহিমআফরোজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আগোরা। শহরের উচ্চবিত্তদের মধ্যে বেশ একটা সাড়া পড়ে যায় নতুন ধরনের এই উদ্যোগ। অবশ্য তারও আগে দু–একটি এমন উদ্যোগের কথা জানা যায়। যার মধ্যে ১৯৯৯ সালের ২২ জুন ধানমন্ডিতে (পুরোনো ২৭ নম্বর রোডে) ৬ হাজার বর্গফুটের একটি সুপারশপ চালু হয়। ‘স্টপ অ্যান্ড শপ’ নামের এই সুপারশপ চালু করে সুবাস্তু ডেভেলপমেন্ট। যেখানে একই ঘরের মধ্যে চাল, ডাল, কাঁচাবাজার, তেল, মসলা থেকে দেশ–বিদেশের প্রসাধনী, পোশাক ও খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়। পাঁচ বছর চলার পর ২০০৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এটি বন্ধ হয়ে যায়। পিকিউএস নামের একটি প্রতিষ্ঠানও সুপারশপ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল, যা পরে আগোরা কিনে নেয়।
২০০১ সালে আগোরার পরই দেশের বাজারে আসে আরেকটি সুপারশপ, নাম—নন্দন। পরের বছর ২০০২ সালে যাত্রা শুরু করে মীনা বাজার। বর্তমানে মোট ১৭টি আউটলেট আছে মীনা বাজারের। পরপর বেশ কয়েকটি সুপারশপ আসায় উচ্চবিত্তদের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও সেখানে ঢুঁ মারতে শুরু করেন। মধ্যবিত্তদের মধ্যে শুরুতে কেনার চেয়ে বেড়ানোর মানুষই বেশি দেখা যেত। তবে উচ্চবিত্তদের জন্য বেশ সুবিধার হয়েছিল। এসির ঠান্ডা বাতাস গায়ে মেখে ঠেলাগাড়িতে মাছ, মাংস, আলু, পটোল বা লালশাকের আঁটি তুলে নিচ্ছেন। কাউন্টারে টাকা মিটিয়ে নতুন ব্যাগে ভরা বাজার নিয়ে চট করে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ২০০৯ সালে এসিআই লিমিটেড চালু করে নতুন সুপারশপ স্বপ্ন। অবশ্য এর আগের বছর অর্থাৎ ২০০৮ সালে এসিআই পাইলট প্রকল্প হিসেবে ঢাকার পোস্তগোলায় চালু করে ফ্রেশ অ্যান্ড এয়ার নামে একটি শপ। ভালো সাড়া মেলার পর ২০০৯ সালে কয়েক মাসের ব্যবধানে শহরের বেশ কয়েকটি এলাকায় স্বপ্নের শাখা চালু হয়। মধ্যবিত্ত মানুষকে লক্ষ্য করেই স্বপ্ন এগোতে শুরু করে। ১৬টি ফ্রাঞ্চাইজি শাখাসহ বর্তমানে ৭৮টি আউটলেট নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় চেইন সুপারশপ স্বপ্ন।
শুরুতে অনেকের ধারণা ছিল, সুপারশপে খোলা বাজারের চেয়ে পণ্যের দাম বেশি রাখা হয়। একটু একটু করে সেই ধারণা কমে আসছে। এখন খোলা বাজার আর সুপারশপের অধিকাংশ পণ্যের দাম সমান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে খোলা বাজারের চেয়ে কিছুটা কম দামে পাওয়া যায় সুপারশপে।
পচা গন্ধ, মানুষের ঠেলাঠেলি, দামাদামি করার ঝামেলা নেই বলে অনেকে পছন্দ করছেন সুপারশপ। অনেকের ধারণা, সুপারশপের বেশির ভাগ ক্রেতা নারী। তবে মীনা বাজারের জরিপ থেকে জানা গেল, এখনো মীনা বাজারে নারীদের চেয়ে পুরুষ ক্রেতার সংখ্যাই বেশি। স্বপ্নে আবার উল্টো চিত্র। সেখানে নারী ক্রেতাই বেশি। এর কারণ, স্বপ্ন যেহেতু ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি এলাকায় তাদের শাখা খুলেছে, তাই বাড়ির পাশে গিয়ে ঝট করে বাজার করছেন নারীরা।
২০১৪ সালে সুপারশপ শিল্পে বার্ষিক লেনদেন (টার্নওভার) হয় ১ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে সেই লেনদেন বেড়ে ২ হাজার ১৮০ কোটি টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। সুপারশপ শিল্পে প্রবৃদ্ধি গড়ে ১৫ শতাংশ।২০১২ সাল থেকে উচ্চবিত্ত ছাড়াও মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের সুপারশপে কেনাকাটার পরিমাণ চোখে পড়ার মতো করে বাড়তে থাকে। এই সময় থেকে দেশের সুপারশপগুলোতে নতুন ধরনের চিন্তা যুক্ত হতে দেখা যায়। অনেকে তখনো সুপারশপে অন্য বাজার করার পর মাছ বা মাংস কেনার জন্য খোলা বাজারে যেত। কারণ, এখানে মাছ বা মাংস তাজা কেনার সুবিধা প্রায় ছিল না। মানুষের আস্থা বাড়াতে সুপারশপগুলোতে বড় কাচের অ্যাকুয়ারিয়ামে তাজা মাছ এনে রাখা হয়। ক্রেতারা সেখান থেকে বেছে বেছে মাছ কেনেন। খাঁচাভর্তি তাজা মুরগি এনে রাখা হয়। মানুষের আস্থা বাড়তে থাকে।
২০১৪ সালে সুপারশপ শিল্পে বার্ষিক লেনদেন (টার্নওভার) হয় ১ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে সেই লেনদেন বেড়ে ২ হাজার ১৮০ কোটি টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। সুপারশপ শিল্পে প্রবৃদ্ধি গড়ে ১৫ শতাংশ। তবে খুব দ্রুত এটা আরও বাড়বে। কারণ, আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশের বড় সুপারশপ ব্র্যান্ডগুলো তাদের ব্যবসা বাড়ানোর কথা ভাবছে। বাড়বে সুপারশপের শাখাও। সুপারশপ বিষয়ে চালানো জরিপের তথ্য বলছে, কেনাকাটায় মানুষ এক জায়গা থেকে ঝামেলাহীনভাবে সবকিছু কেনাকাটা করতে চায়। আর সেই কেনাকাটার জায়গাটা চায় বাসার কাছাকাছি, তবে খরচ হবে তুলনামূলক কম। সেসব বিষয় মাথায় নিয়েই নতুনভাবে কাজ করছে মীনা বাজার, আগোরা, স্বপ্ন, প্রিন্স বাজারের মতো বড় সুপারশপগুলো।
ঢাকা শহর সুপারশপের সবচেয়ে বড় বাজার। ঢাকায় ১০০টির বেশি ছোট বড় প্রতিষ্ঠান আছে, যারা সুপারশপ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এর বাইরেও চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, রংপুর, যশোর, নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজার ইত্যাদি শহরে সুপারশপের বড় ব্র্যান্ড ছাড়াও ব্যক্তিপর্যায়ের সুপারশপ ব্যবসা আছে দেশের আরও অনেক জেলায়। সব মিলে দেশে প্রায় ১ হাজার সুপারশপ আছে। যার মধ্যে সংগঠিত সুপারশপের সংখ্যা ২০০।
দেশে সংগঠিত সুপারশপগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ সুপার মার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয় ২০০৫ সালে। যে সংগঠনের মাধ্যমে এই খাতের সুবিধা–অসুবিধা নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এই ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নে সমন্বিত হয়ে কাজ করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। রমজান মাসে হঠাৎ দেশে যে জরুরি পণ্যগুলোর দাম বেড়ে যায়, সুপার মার্কেটগুলোতে তেমন জরুরি ১১ ধরনের পণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখা হয়। তবে এই খাতের বর্তমানে সবচেয়ে বড় বাধা ভ্যাট যুক্ত করা। কারণ, সাধারণ বাজারে যে পণ্য ১০ টাকায় কেনা যায়, তা যদি সুপার মার্কেটে ভ্যাটসহ বিক্রি করতে হয় তাহলে প্রতিযোগিতায় টিতে থাকা চ্যালেঞ্জ। এসব বিষয় নিয়েও সরকারি পর্যায়ে আলোচনা করে সুপার মার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। এ ছাড়া সুপার মার্কেটের জন্য যে আইন প্রয়োগ করা হয়, সেটা খোলা বাজারের আইন। তাই এই খাতের ব্যবসায়ীদের দাবি, সুপারশপবান্ধব নতুন আইন করা। সুপারশপের বাজার বাড়াতে রিটেইল চেইনের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দরকার। তৈরি করা দরকার ট্রেনিং ইনস্টিটিউশন। দেশের যোগাযোগব্যবস্থা যত ভালো হবে, পণ্য তত দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যোগাযোগ খাতে যে উন্নয়ন চলছে, সেটার সুফল সুপারশপ প্রতিষ্ঠানগুলোর পেতে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের সুপারশপ খাতে বড় ও জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে আছে স্বপ্ন, মীনা বাজার, আগোরা, নন্দন, প্রিন্স বাজার, ইউনিমার্ট, ঢালী, ল্যাভেন্ডার, ফ্যামিলি নিডস, ডেইলি নিডস, ডিএসএস, গরমে বাজার ইত্যাদি। স্থায়ী দোকান ছাড়াও সুপারশপ ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইনেও। ২০১২ সালে মীনা বাজার প্রথম অনলাইনে তাদের পণ্য কেনা ও পৌঁছে দেওয়ার সুবিধা চালু করে। এরপর স্বপ্নসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অনলাইনে কেনার সুবিধা চালু করে। কোনো স্থায়ী দোকান না থাকলেও চালডাল ডটকম অনলাইনে কেনাকাটার জন্য দেশের মানুষের কাছে এখন একটি জনপ্রিয় নাম। এই প্রতিষ্ঠানের পণ্যও সুপারশপের মতো বহুমুখী।
সুপারশপে সাধারণত ৫ থেকে ৬ হাজার পণ্য থাকে। বিশাল এই ভান্ডার থেকে ক্রেতারা তাঁদের পছন্দমতো পণ্য কিনে নেন। কোনো পণ্যে সমস্যা পাওয়া গেলে অভিযোগ জানিয়ে পরিবর্তনেরও সুবিধা থাকে। তাই এসব সুবিধাই দেশের মানুষকে টেনে নিচ্ছে সুপারশপে কেনাকাটার দিকে।
তথ্য কৃতজ্ঞতা: শাহিন খান, সিইও, মীনা বাজার
সাব্বির হাসান, নির্বাহী পরিচালক, স্বপ্ন,
ফরহাদ এফ আহমেদ, সিইও, আগোরা
জাকির হোসেন, মহাসচিব, বাংলাদেশ সুপার মার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন
হাসান ইমাম : প্রথমআলোর সহসম্পাদক