ঈশ্বর যদি আমাকে বলেন, আমি তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেব, কিন্তু বিনিময়ে ফিরিয়ে নেব তোমার ল্যাপটপ আর কম্পিউটারের দক্ষতা; তাহলে আমি আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে চাইব না। আমি আমার তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান নিয়েই বাকি জীবন বেঁচে থাকতে চাই। কারণ, তথ্যপ্রযুক্তির এই জ্ঞান দিয়ে আমি আমার সব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করতে পেরেছি। আমার যা কিছু অর্জন, তা এই তথ্যপ্রযুক্তির জন্য। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে আমি আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই জীবনযাপন করতে পারি।
যাঁরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নন, তাঁরা সকালে প্রথম আলো পত্রিকাটা হাতে নিয়ে পড়েন। আমিও প্রথম আলো পড়ি স্মার্টফোনে। তাঁদের সঙ্গে কি আদৌ আমার কোনো পার্থক্য আছে? আর এটা সম্ভব হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে। আর আমি কাজ করে চলেছি, এ প্রযুক্তি যাতে বাংলাদেশের সব প্রতিবন্ধী মানুষের কাছে পৌঁছায় সে উদ্দেশ্য নিয়ে।
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের বাগদণ্ডী গ্রামে আমার জন্ম। আমার বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা। মা গৃহিণী। আমার যখন জন্ম হয়, তখন আমাদের গ্রামে কোনো হাসপাতাল বা ডাক্তার ছিল না। জন্মের পর আমার নাক ও মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়। আমার পরিবারের সদস্যদের কোনো ধারণা ছিল না, সে অবস্থায় তাদের কী করা দরকার। যখন আমার বয়স দুই বছর, তখন আমার মা-বাবা বুঝতে পারলেন, আমি চোখে দেখতে পাই না।
একসময় আমার স্কুলে যাওয়ার বয়স হলো। প্রথমে আমাকে ভর্তি করা হলো বাগদণ্ডী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু স্কুলের শিক্ষকদের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও ওখানে আমি পড়তে পারিনি। প্রতিবন্ধী শিশুদের পড়ালেখা করানোর কোনো সুবিধা সে স্কুলে ছিল না। এরপর মুরাদপুরে সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে আমি পড়াশোনা শুরু করি। সেখানেও সমস্যা ছিল। ব্রেইলে লেখা বই ছিল না। অঙ্ক করার জন্য ছিল না যথাযথ কোনো প্রযুক্তির ব্যবহার।
নাসিরাবাদ বয়েজ স্কুল থেকে ১৯৯৫ সালে আমি মাধ্যমিক পাস করি। পরীক্ষা দিই প্রাইভেটে। আমি পরীক্ষা দিয়েছিলাম শ্রুতলেখকের মাধ্যমে। এরপর চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিল, আমাকে নেওয়া হবে না। এরপর ভর্তি হলাম সরকারি সিটি কলেজে। শিক্ষকেরা আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। বাবা-মা ও গৃহশিক্ষক পড়া রেকর্ড করে তা শোনাতেন। তাঁদের আন্তরিকতার কারণে প্রযুক্তির অভাব টের পাইনি।
তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করলাম। কিন্তু চোখে দেখতে পাই না বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমিসহ আরও কয়েকজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর আবেদন নাকচ করে দেয়। এরপর আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দাবিতে অনশন শুরু করলাম। আমাদের দাবির মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল। আমি ভর্তি হতে চাইলাম সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু তারা বলল, তুমি তো ফিল্ডওয়ার্ক করতে পারবে না। তখন ভর্তি হলাম ইতিহাস বিভাগে। না, সেখানেও কোনো ব্রেইলে লেখা বই ছিল না। শুনে শুনেই বইয়ের বিষয়বস্তু জেনে নিতাম। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হিসেবে কোনো সহযোগিতা পেতাম না। পরীক্ষায় কোনো অতিরিক্ত সময় দেওয়া হতো না। তবে বহু শিক্ষক আমাকে ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করেছেন।
তথ্যপ্রযুক্তি সত্যিই আমার জীবন পাল্টে দিয়েছে। আমি চাই, আমার মতো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা এভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের জীবনকে পাল্টে নেবে সবার আগে দরকার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করা, তারপর কাজে নেমে পড়া
অনার্স পাস করার পর ২০০২ সালে জাপানে ডাসকিন লিডারশিপ ট্রেনিং নেওয়ার জন্য যাই। প্রশিক্ষণটা ছিল এক বছরের। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে তারা ১০ জনকে নির্বাচিত করে। তাদের মধ্যে আমি একজন। আমি বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সে কারণে প্রশিক্ষণের জন্য তারা আমাকে নির্বাচিত করে।
এই ট্রেনিং প্রোগ্রামেই কম্পিউটারে আমার প্রথম হাতেখড়ি হয়। সেখানে আমি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর প্রশিক্ষণ পাই। আমার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। আমি অনেক কিছু শিখতে পারি, যা দেশে ফিরে আমার দারুণ কাজে লাগে। এর আগ পর্যন্ত আমার স্বপ্ন ছিল যেকোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষক হব।
২০০৩ সালে আমি দেশে ফিরে আসি। ফিরে এসে চাকরির চেষ্টা করি। কিন্তু প্রথম এক বছর কোনো চাকরি পাইনি। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছে—এমন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানেও আমি গিয়েছি। কিন্তু কাউকে বিশ্বাস করাতে পারিনি যে আমি কাজ জানি, কাজ করতে পারি।
তারা আমাকে নেয়নি বলে কিন্তু আমি থেমে থাকিনি। পুরো একটি বছর কাজ করেছি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। চট্টগ্রামে প্রথম কম্পিউটারাইজড ব্রেইল প্রোডাকশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করি। আমাকে সহযোগিতা করে ‘জাপান ব্রেইল লাইব্রেরি’ এবং ‘মালয়েশিয়ান কাউন্সিল ফর দ্য ব্লাইন্ড’। চট্টগ্রামের স্থানীয় সংগঠন ‘উৎস’ আমার পাশে ছিল।
আমার এই এক বছরের সংগ্রাম চোখে পড়ে ‘ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন’ (ইপসা) নামে চট্টগ্রামের একটি উন্নয়ন সংস্থার। তারা আমাকে সুযোগ দেয় তাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করার। এরপর আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মাঝখানে ২০০৪ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে ডাসকিন ফলোআপ ট্রেনিং প্রোগ্রামে অংশ নিই। ২০০৬ সালে ফের ব্যাংককে ডিজিটাল অ্যাকসেসেবল ইনফরমেশন সিস্টেম (ডেইজি) ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনার্স ট্রেনিং কোর্সে অংশ নিই। এই কোর্স শেষ করার পর আমি ডিজিটাল অ্যাকসেসেবল ইনফরমেশন সিস্টেমের আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষকে পরিণত হই। একই বছরের সেপ্টেম্বরে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ওপর তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিই।
বর্তমানে আমি কাজ করছি ইপসার প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে। ইপসাতে আমার সঙ্গে কাজ করছেন আরও ৩২ জন দৃষ্টি ও অন্যান্য প্রতিবন্ধী। পাশাপাশি কাজ করছি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন’ প্রোগ্রামে। সেখানে আমি ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট ওয়েব অ্যাকসেসেবিলিটি হিসেবে কর্মরত আছি। এ ছাড়া আমি ‘বাংলাদেশে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স অন অ্যাকসেসেবল টেকনোলজিস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টস’ (গ্যাটস)–এর আবাসিক প্রতিনিধি এবং ‘ন্যাশনাল ফোরাম অব অর্গানাইজেশনস ওয়ার্কিং উইথ ডিজঅ্যাবলড’ (এনএফওডব্লিউডি)–এর ন্যাশনাল আইসিটি থিম্যাটিক গ্রুপের আহ্বায়ক।
এ পর্যন্ত আড়াই শ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েকে কম্পিউটারের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ৬০০-রও বেশি ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া বই তৈরি করেছি। ৮০০ তৃণমূল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নিয়ে ৪০টি সংগঠন গড়ে তুলেছি, যাতে নিজেদের অধিকার নিয়ে তারা কথা বলতে পারে।
আমরা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করছি। আমরা প্রতিবন্ধী মানুষের ব্যবহারের জন্য ২৫ হাজার ওয়েবসাইট গড়ে তোলার কাজে নেমেছি। সরকার সবার জন্য সেগুলো উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তৈরি করেছি বাংলা স্ক্রিন রিডিং সফটওয়্যার। এটি যেকোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষ বিনা মূল্যে ব্যবহার করতে পারে। আমরা প্রথম থেকে দশম শ্রেণির সব বই ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া বইয়ে রূপান্তরিত করেছি। এসব বই তৈরি করা হয়েছে পুরো টেক্সট ও পুরো অডিওসহ। মানে পাঠক এ বইগুলো হয়তো দেখে নয়তো শুনে পড়তে পারবে, সহজে ব্রেইলও করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন’ প্রোগ্রামের সার্ভিস ইনোভেশন গ্রাউন্ডের আওতায় ইপসা এ কাজটি করেছে। কাজটির জন্য আমরা আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃতও হয়েছি। পুরস্কারের মধ্যে আছে ইন্টারন্যাশনাল এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড ফর অ্যাকসেসেবল পাবলিশিং। লন্ডন আন্তর্জাতিক বইমেলা থেকে আমি যখন এ পুরস্কারটি নিই, আনন্দে তখন আমার বুক ভরে গেছে। এ ছাড়া পেয়েছি ডব্লিউএসআইএফ এশিয়া পুরস্কার। এটি নিয়েছিলাম তুরস্কে অনুষ্ঠিত ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরাম থেকে। পেয়েছি ন্যাশনাল ই-কনটেন্ট অ্যান্ড আইসিটিফরডি চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড, মন্থন পুরস্কার, আইএসআইএফ এশিয়া পুরস্কার ইত্যাদি।
কাজ করতে গিয়ে আমার ২০ টিরও বেশি দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। সুযোগ হয়েছে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে আইসিটিফরডি নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে কয়েকবার প্যানেল আলোচক হিসেবে অংশ নিয়েছি। সৌদি সরকারের রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে দুবার সেখানে গিয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রযুক্তির ধারণা তুলে ধরেছি।
২০১৫ সালের মে মাসে প্রথম আলো পত্রিকায় আমাকে নিয়ে একটি লেখা বের হয়। সেই লেখা পড়ে দুবাইপ্রবাসী এক বাংলাদেশি বাবা আমাকে কৃতজ্ঞতা জানান। তাঁরও একটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়ে আছে। তিনি তাঁর মেয়ের জন্য সহযোগিতা চাইলেন। তাঁর মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। আমরা তাঁকে অষ্টম শ্রেণির সব ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া বই দিই। সে এ বছর জেএসসি পরীক্ষা দেবে।
আমার আশা, ২০১৬ সালে সব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রী বিনা মূল্যে ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া ও ডিজিটাল ব্রেইল বই পাবে। এ জন্য ইপসা, ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন’ প্রোগ্রাম ও সমাজসেবা মন্ত্রণালয় কাজ করছে। সঙ্গে রয়েছে এনসিটিবি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আমার পরবর্তী লক্ষ্য, সব বাংলা বই যাতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষেরা পড়তে পারে তার ব্যবস্থা করা। এ জন্য আমরা ন্যাশনাল অনলাইন অ্যাকসেসেবল লাইব্রেরি গড়ে তোলার জন্য কাজ করছি।
তথ্যপ্রযুক্তি সত্যিই আমার জীবন পাল্টে দিয়েছে। আমি চাই, আমার মতো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা এভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের জীবনকে পাল্টে নেবে। আমি এমন একটা দেশে বাস করি, যেখানে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। এর মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ শিক্ষিত। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়েদের অবস্থা খুবই করুণ। কারণ, একদিকে তাদের বিয়ে হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না, অন্যদিকে তারা না পায় কোনো শিক্ষা, না পায় চাকরি। নিজের পরিবারের মধ্যেও তারা অবহেলিত হয়ে থাকে। তাদের জন্য আমি কিছু করতে চাই। শৈশবে আমি আমার মায়ের অবিরাম কান্না শুনেছি। এখন যে তিনি আমাকে নিয়ে গর্ব করেন, অন্যদের সাহস জোগান, তার চেয়ে আনন্দ আমার আর কী হতে পারে?
ভাস্কর ভট্টাচার্য: প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা), চট্টগ্রাম