১৯৭০–৭১

সত্তরের নির্বাচন থেকে একাত্তরের অসহযোগ

নির্বাচনী প্রস্তুতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭০
নির্বাচনী প্রস্তুতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭০

সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন বাঙালির জাতিসত্তার প্রেক্ষাপটে জাগরণের শক্তি হিসেবে উদ্ভাসিত হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দুই আন্দোলনে মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালির আত্মজাগরণের জায়গা নির্ধারণ করেছিলেন। এই দুটো জায়গায় নিজের ভূমিকাকে আত্মপ্রত্যয়ী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে বাঙালির মানসপটে বিপুলভাবে আত্মজাগরণের দরজা খুলে দেন। বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করে। শুরু হয় স্বাধীনতার স্বপ্নে নিরন্তর যাত্রার দুঃসাহসী ভূমিকা। সত্তরের নির্বাচন ও অসহযোগ আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমান বিপুল সাহসী চৈতন্যে ঐক্যবদ্ধ বাঙালির তোরণ উন্মোচন করেন। বিশ্বজুড়ে বাঙালির জাগরণ এবং স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা বিপুল সাহসী প্রত্যয় বিশ্বের মানচিত্রে প্রলয় ঘটায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতার আসনে আসীন করে বাঙালি নিজের জাতিসত্তার বিকাশ ঘটায়। পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

ফিরে দেখা যাক ইতিহাস। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পদত্যাগের পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা দখলের পর সামরিক শাসক আইয়ুব খান পাকিস্তানে কোনো সাধারণ নির্বাচন হতে দেননি। সামরিক শাসক হিসেবে ক্ষমতা দখল করে আইয়ুব খান নির্বিচারে দেশকে শাসন করে ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে অপসারিত হয়ে আর একজন সামরিক ব্যক্তি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা অর্পণ করে বিদায় গ্রহণ করেন।

সাতচল্লিশ–পরবর্তী সময় থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জাতির অধিকারের প্রশ্নে প্রবলভাবে সচেতন ছিলেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান গণ-পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ব বাংলা বলুন বলে দাবি করেছিলেন। বাঙালির আত্মমর্যাদার জায়গাকে তিনি নিরন্তর স্মরণ করিয়েছেন দেশবাসীকে। ছয় দফা সনদে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর রাজনীতির সচেতন বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল গণমানুষ।

ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, তিনি দ্রুতই সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন। ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্যারাকে ফিরে যাবেন। পরবর্তী সময়ে আইনগত কাঠামো আদেশ ঘোষণা করেন। বলা হয় ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর জাতীয় পরিষদ এবং ২২ অক্টোবর প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল রাজনীতির মাঠের আসর সরগরম করে তোলে। কিন্তু যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না। পূর্ব বাংলার কিছু অঞ্চলে সেপ্টেম্বর মাসে প্রবল বন্যা হওয়ায় নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার দাবি ওঠে। ইয়াহিয়া খান নির্বাচন পিছিয়ে দেন। জাতীয় পরিষদের ৭ ডিসেম্বর এবং প্রাদেশিক পরিষদের ১৭ ডিসেম্বর দিন ধার্য করা হয়।

১৯৭০ সালের ১২–১৩ নভেম্বর পূর্ব বাংলার দক্ষিণের উপকূলীয় এলাকায় ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সে সময় এই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি এবং রিলিফ পাঠানোর বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। উপরন্তু, ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য বিদেশ থেকে রিলিফ সামগ্রী এলেও সেসব দুর্গত এলাকায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন দেরিতে। দেশবাসী ক্রুদ্ধ হয় কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু তাঁর দলের মানুষদের নিয়ে ত্রাণকাজে নিজেকে যুক্ত করেন। এই ঘটনায় প্রায় ১০ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এলাকায়। এরপর ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিপুল ভোটের ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করে।

১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন। ২৫১ জন এমএনএ ও ২৬৭ জন এমপিএকে শপথবাক্য পাঠ করান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরে তিনি নীতিনির্ধারণী ভাষণ দেন। ভাষণের একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে তোমরা ৮৫ জন, আমরা ১৫ জন। সামরিক বিভাগে তোমরা ৯০ জন, আমাদের দিয়েছে ১০ জন। বৈদেশিক সাহায্যের তোমরা খরচ করছ ৮০ ভাগ, আমাদের দিয়েছে ২০ ভাগ। মহাপ্রলয়ে দক্ষিণ বাংলার ১০ লাখ লোক মারা গেল। লাখ লাখ লোক অসহায় অবস্থায় রইল। রিলিফ কাজের জন্য বিদেশ থেকে হেলিকপ্টার এসে কাজ করে গেল, অথচ ঢাকায় একখানা মাত্র সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টার ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আর কোনো হেলিকপ্টার এল না। আমরা এসব বে-ইনসাফির অবসান করব।’

সত্তরের সাধারণ নির্বাচন ছিল বাঙালির প্রাণের জোয়ার। এই জোয়ারের প্রবল ঢেউয়ে সাধারণ মানুষকে মাতিয়ে তোলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নিঃসন্দেহে বলা যায় স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর বাঙালির সামনে দরজা খুলে যায়। প্রতি পদক্ষেপের হিসাবে উঠে আসে স্বাধীনতার সূর্য।

আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে দেয়। সত্তরের নির্বাচন বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে বৃহত্তর স্বার্থে অনুপ্রাণিত করে। বাঙালি বুঝতে পারে বঙ্গবন্ধু যে উদাহরণ দিয়ে পাকিস্তানি জনগোষ্ঠীর হাতে বাঙালির বঞ্চনার দিক তুলে ধরেছেন, তার নিরসনকল্পে ঐক্যের শক্তির সামর্থ্যে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে এমন ঘোষণা করার পর আবার সেই তারিখ ১ মার্চ স্থগিত ঘোষণা করে ইয়াহিয়া খান।

>সত্তরের সাধারণ নির্বাচন ছিল বাঙালির প্রাণের জোয়ার। এই জোয়ারের প্রবল ঢেউয়ে সাধারণ মানুষকে মাতিয়ে তোলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নিঃসন্দেহে বলা যায় স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর বাঙালির সামনে দরজা খুলে যায়। প্রতি পদক্ষেপের হিসাবে উঠে আসে স্বাধীনতার সূর্য।

শুরু হয় বাঙালির জীবনের নতুন অধ্যায়। সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল বিসিসিপি ও আন্তর্জাতিক একাদশের মধ্যে। রেডিওতে এই খবর শুনে ঢাকায় বিক্ষুব্ধ মানুষ রাজপথে নেমে আসে। মতিঝিলের হোটেল পূর্বাণীতে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি কমিটির মিটিং করছিলেন। বিভিন্ন মিছিল বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে কী করতে হবে, তা জানার জন্য পূর্বাণীর সামনে জমায়েত হতে থাকে। স্টেডিয়ামের দর্শকেরাও বেরিয়ে এসে হোটেল পূর্বাণীর সামনে জড়ো হন। বঙ্গবন্ধু মিটিং থেকে উঠে এসে জনতার সামনে দাঁড়ান। বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। বিকেলে তিনি তাঁর মিটিং শেষ করে সংবাদ সম্মেলন করেন। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার কঠোর প্রতিবাদ করেন। বলেন, বাংলার জনগণ প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশজুড়ে আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে ২ মার্চ ঢাকা শহরে এবং ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল পালনের ঘোষণা দেন। ৭ মার্চ রেসকোর্সে জনসভা হবে বলে জানান।

শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বাঙালির সর্বাত্মক চেতনায় প্রতিবাদ-প্রতিরোধে দুঃসাহসী বোধ প্লাবিত হয়। সাহসের দুর্জয় ঘাঁটি নিয়ে দেশের সব স্তরের মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন প্রতিরোধের আলোকে। ৭ মার্চের বক্তব্যে ঘোষিত হয়, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বাঙালির অস্তিত্বের প্রতিটি রক্তকণায় ঢুকে যান চিরঞ্জীব শেখ মুজিব। অসহযোগ আন্দোলনের ২৫ দিন পূর্ব বাংলার বাঙালি তাঁর নির্দেশে দেশ পরিচালনার সবটুকু জায়গা নিজেদের মধ্যে ধারণ করেন। পাকিস্তান সরকারের বিপরীতে জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার সরকার পরিচালনা পাকিস্তানের ইতিহাসে এক ভিন্ন অধ্যায়ের সূত্রপাত করে।

এভাবে সত্তরের নির্বাচন এবং অসহযোগ আন্দোলন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালি জাতিকে মানসম্মত জায়গায় উন্নীত করার দিকনির্দেশনা। জন্ম হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। বাঙালির অমরত্বের সাধনাকে জাতিগোষ্ঠীর বিনির্মাণে উদ্ভাসিত রাখেন। যে কারণে তিনি বলতেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশ একমাত্র রাষ্ট্র, যার রাষ্ট্রভাষা বাংলা। 

সেলিনা হোসেন: কথাসাহিত্যিক 

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গত বছর ‘ঐ মহামানব আসে’ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল প্রথম আলো। ক্রোড়পত্রের সেই লেখাগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরা হলো।