>শিক্ষার মূল ভিত্তি হলো প্রাথমিক শিক্ষা। বর্তমানে কেমন চলছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা, মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভবিষ্যতে কী করা উচিত—সেসব নিয়ে কথা বলেছেন দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ।
প্রথম আলো: বর্তমানে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা কেমন চলছে?
মনজুর আহমদ: প্রাথমিক শিক্ষার অনেক প্রসার হয়েছে। তবে সমস্যাও আছে অনেক। প্রাথমিক শিক্ষা সব শিক্ষার ভিত্তি। কিন্তু ভিত্তিটি এখনো নড়বড়ে। এই নড়বড়ে ভিত্তির ওপর পুরো শিক্ষার বিকাশ ও উন্নয়ন খুব মুশকিল। প্রাথমিক শিক্ষা বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত। পুরোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী পড়ে। কয়েক বছর আগে সরকারি হওয়া প্রায় ২৬ হাজার বিদ্যালয়ে প্রায় ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ছে। অর্থাৎ প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আছে। এর বাইরে মাদ্রাসা, এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়, ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেন আছে। এখন কিন্ডারগার্টেন সবচেয়ে বেশি প্রসারিত হচ্ছে। প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী সেখানে যাচ্ছে। মাদ্রাসা বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ৭ থেকে ৮ শতাংশ পড়ছে। তবে প্রায় সব ধারাতেই আবার মানের সমস্যা আছে। সবকিছু মিলিয়ে হয়তো সব শিশুর কাছে প্রাথমিক শিক্ষা পৌঁছানো যাচ্ছে। সরকার বলছে, ৯৭ থেকে ৯৮ শতাংশ শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। এটা ভালো। কিন্তু পৌঁছালেই হবে না, তারা কী শিখছে, সেটা দেখতে হবে। সেখানেই বড় সমস্যা। শুধু প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা দিয়ে অর্জন যাচাই করা যাচ্ছে না। সরকারের উদ্যোগে করা মূল্যায়নেই দেখা যায়, অধিকাংশ শিশু ঠিকমতো ভাষা ও অঙ্ক শিখতে পাচ্ছে না। এখানে শিখনের ভিতটা দুর্বল। মানে, এখনো মানসম্পন্ন শিক্ষা হচ্ছে না।
প্রথম আলো: মানসম্মত শিক্ষা হচ্ছে না কেন?
মনজুর আহমদ: একটি বিষয় হলো, বিভিন্নভাবে বিভক্তি থাকা। সবই যে একই ছকে হতে হবে, তা নয়। কিন্তু মানের একটি সামঞ্জস্য রাখতে হবে। যে ধারাই হোক না কেন, শক্ত ভিত্তি তৈরি হচ্ছে না। বিভিন্ন ধারার জন্য যে তত্ত্বাবধান ও আর্থিক সংস্থান প্রয়োজন, তা–ও যথেষ্ট নয়। অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে, সেটিও যথেষ্ট নয়। এখনো যথেষ্ট পরিমাণ শিক্ষক নেই। আবার শিক্ষকের মান, যোগ্যতা ও দক্ষতা এবং নিবেদন কতখানি, সেটাও বিরাট সমস্যা। শিক্ষক হিসেবে যাঁদের পাচ্ছি, তাঁদের অনেকের যথেষ্ট যোগ্যতা ও দক্ষতা নেই। আবার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতায় আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হলেও কিন্ডারগার্টেনে কম টাকায় কাজ করানো হয়। তাঁদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এ জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ও মানসম্মত শিক্ষক দরকার। শিক্ষকের সংখ্যা অন্তত দ্বিগুণ করা দরকার। শিক্ষকদের বিষয় নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তা করতে হবে। ভালো শিক্ষকের জন্য ব্যয়ও দরকার। তবে বর্তমানের খরচ দিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা সম্ভব নয়।
প্রথম আলো: অনেকেই বলেন, প্রাথমিক শিক্ষায় পরীক্ষানির্ভরতা বেশি। আপনার কী মনে হয়?
মনজুর আহমদ: এটিও একটি সমস্যা। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা তো ২০০৯ সালের আগেও ছিল না। মান যাচাইয়ের জন্য এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য হয়তো ভালো ছিল। কিন্তু এখন এই পরীক্ষার দিকেই সব নজর চলে গেছে। এ জন্য মুখস্থ করা, টিউটরিং, পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য আবার মডেল টেস্ট ইত্যাদি হচ্ছে। এমনকি এই পরীক্ষায় ভালো করার জন্য গাইড বই, নোটবই মুখস্থ করানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা আসলে শিখতে পারল কি না, সেটা ঠিকমতো যাচাই করা হচ্ছে না। সৃজনশীলও মুখস্থনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। আসলে পরীক্ষা সৃজনশীল নয়, পাঠদান সৃজনশীল হওয়া প্রয়োজন।
প্রথম আলো: ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম থেকে বাড়িয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার কথা থাকলেও তা এখনো কেন হয়নি?
মনজুর আহমদ: সেটা তো অবশ্যই হওয়া উচিত ছিল; আমরা যেহেতু উন্নত দেশের পর্যায়ে যেতে যাচ্ছি, তখন চিন্তা করা উচিত সমতাভিত্তিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক করা। শুধু পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত নয়, সামগ্রিক বিদ্যালয় শিক্ষাই ভিত্তি ধরা উচিত। ১০ বছর আগেই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু দুই মন্ত্রণালয়ের টানাপোড়েনে এটা হয়নি।
প্রথম আলো: প্রাথমিকের শিক্ষাক্রম এবং বই ও পড়ার চাপ নিয়ে নানা কথা আছে। আপনার কী মনে হয়?
মনজুর আহমদ: এর যুক্তিও আছে। কিছু ভিত্তিমূলক দক্ষতা ধরে প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য স্থির করে সেভাবে জোর দেওয়া হলে এত বিষয়ের প্রয়োজন হয় না। আর পরীক্ষাও দক্ষতাভিত্তিক করা উচিত।
প্রথম আলো: তাহলে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতি কী দেখছেন?
মনজুর আহমদ: অগ্রগতি হলো, প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার হয়েছে। মানের যে সমস্যা আছে, সেটা নিয়েও কথা বলছি। আর শিক্ষক বিষয়েও নানা রকম দুর্নীতি কমানোর চেষ্টা হচ্ছে। সেগুলো অগ্রগতি। কিন্তু এই অগ্রগতি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারছি না।
প্রথম আলো: তাহলে প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তিটি শক্ত করার জন্য কী করা উচিত বলে মনে করেন?
মনজুর আহমদ: কাঠামোগত মৌলিক কিছু সমস্যা যেমন বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে আছে। সেগুলোর সবার মান রক্ষা করা যাচ্ছে না। সেখানে সরকার কীভাবে দায়িত্ব নিচ্ছে, সেটা দেখতে হবে। এটিকে (প্রাথমিক শিক্ষা দেখভাল) একটু বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার। স্থানীয়ভিত্তিক পরিকল্পনা করতে হবে। ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ, যথেষ্ট অবকাঠামো, শিক্ষক ও তত্ত্বাবধান এবং প্রশিক্ষণের জন্য ব্যয় বাড়াতে হতে। জবাবদিহির অভাব আছে, সেটা দূর করতে হবে। শিক্ষানীতির আলোকে ক্ষমতা দিয়ে স্থায়ী শিক্ষা কমিশন করা দরকার। আমি বলব, শিক্ষানীতিও পর্যালোচনা করা উচিত। আর বিদ্যালয় শিক্ষাকে একটি প্রশাসনের আওতায় এনে সামগ্রিকভাবে চিন্তা করতে হবে। মূলকথা, শিক্ষার ভিত্তিটি মানসম্পন্ন হতে হবে। সেটাই চিন্তা করা জরুরি।