লাল-সবুজের গর্ব 'মেড ইন বাংলাদেশ'

স্বল্পোন্নত দেশের অস্বস্তিকর তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হয়েছে বাংলাদেশ। দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় প্রবৃদ্ধি কমবেশি ৭ শতাংশ।সচল রয়েছে দেশের অর্থনীতির চাকা।এসব অর্জনের পেছনে নেতৃত্ব, কর্মপরিকল্পনা, বিবিধ উদ্যোগের পাশাপাশি যে একক শিল্প খাত সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে, তা হচ্ছে এ দেশের তৈরি পোশাকশিল্প।

অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা আর প্রয়োজনীয় পোশাকের অপ্রাপ্যতার কারণে তিন-চার দশক আগেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক মানুষ (বিশেষত পুরুষ) খালি গায়ে ঘুরে বেড়াত। শহরের নিম্নমধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্তদের অনেকেই শীতের পোশাক হিসেবে বিদেশ থেকে বস্তায় করে আনা অনেকটা জীর্ণ, পুরোনো পোশাকের অপেক্ষায় থাকত। এসব আমরা অনেকেই দেখেছি। গর্ব করেই বলতে পারি, সেই বাংলাদেশের চেহারা আজ অনেকটাই পাল্টে গেছে। দেশের ক্রমবিকাশমান বস্ত্র ও পোশাকশিল্পের অব্যাহত অগ্রযাত্রার ফসল হিসেবে আজ প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কাউকে খালি গায়ে ঘুরতে দেখা যায় না। শহরেও সেই জীর্ণ পুরোনো শীতবস্ত্র কিনতে ভিড় করে না কেউ। সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে বিদেশের বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের আধিপত্য। অনেক বড় বড় এবং প্রতিষ্ঠিত প্রতিদ্বন্দ্বী দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারী দেশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। 

 গত অর্থবছরে (জুলাই ’১৮ থেকে জুন ’১৯) বাংলাদেশ থেকে মোট ২ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার তৈরি পোশাক সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে। এ ছাড়া হোম টেক্সটাইলের বিভিন্ন খাতে ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা এবং ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকার তোয়ালে, ক্যাপ ও বিভিন্ন রকম কাপড় রপ্তানি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এটি ৩ লাখ কোটি টাকার ওপরে। গর্ব করার মতোই একটা পরিসংখ্যান।

তবে অগ্রযাত্রা বা আজকের এই অবস্থানে পৌঁছানোর পথটা কিন্তু মোটেই মসৃণ ছিল না। আশির দশকের গোড়ার দিকে যখন পোশাক রপ্তানির যাত্রা শুরু হয়, তখন কিন্তু আমাদের কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছিল না। পোশাক তৈরির উপকরণ, যেমন তুলা, সুতা, কাপড়, রং, কেমিক্যাল, প্যাকিং সামগ্রী—এসবের কিছুই আমরা উৎপাদন করতাম না। মেশিনপত্র তো অনেক দূরের কথা। বিদেশি কিছু উৎসাহদাতা, কিছু নবীন তরুণ উদ্যোক্তার অদম্য উৎসাহ, অল্প শিক্ষিত এবং অদক্ষ কিছুসংখ্যক শ্রমিক—সব মিলিয়ে এই ছিল আমাদের সূচনাযাত্রার পুঁজি। ভাবা যায়, এ রকম একটা দল নিয়ে বিশ্বের বাঘা বাঘা সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে হটিয়ে বাংলাদেশ তার জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বদরবারে।

প্রায় চার দশকের এই পথচলায় অনেক জানা-অজানা বেদনার কাহিনিও আছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনা, তাজরীন ফ্যাশনসের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডসহ এর আগেও ঘটে যাওয়া অনেক দুর্ঘটনায় শত শত শ্রমিকের প্রাণহানির কথা আমরা সবাই জানি, যা আমাদের ব্যথিত করেছে। শোকগ্রস্ত করেছে পুরো জাতিকে। পাশাপাশি সবার অগোচরে অনেক উৎসাহী উদ্যোক্তা সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন এই ব্যবসার জটিল ও বিপজ্জনক বাঁক ঠিকমতো বুঝে না ওঠার কারণে, যার সর্বশেষ উদাহরণ মিরপুরের তরুণ পোশাক ব্যবসায়ী এস এম বায়েজিদ, যিনি সপরিবার আত্মহত্যা করেছেন মাসখানেক আগে। 

বিদেশে পোশাক রপ্তানির ঢেউ স্থানীয় পোশাকের বাজারকেও প্রভাবিত করেছে এবং দেশের পোশাকবাজারও বেশ সমৃদ্ধ হয়েছে। উন্নত প্রযুক্তিতে স্থানীয় বস্ত্র উৎপাদকেরা এখন অনেক আধুনিক বস্ত্র উৎপাদন করছেন। পাশাপাশি বিদেশি পোশাকের চাহিদা ও সরবরাহ—দুটোই বেড়েছে অনেক গুণে। রপ্তানির উদ্বৃত্ত বা ক্রয়াদেশ বাতিলের কাপড়গুলো আইনের ফাঁকফোকর গলে দেশের আপামর জনসাধারণের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে। অনেক নামীদামি ব্র্যান্ডের পোশাক এখন ক্রেতারা কিনতে পারছেন কম মূল্যে। এ সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ব্র্যান্ডের নকল পণ্য বাজারজাত করছেন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধমূলক যে কাজের কথা প্রায়ই শোনা যায়, তা হচ্ছে বন্ড লাইসেন্সের বিপরীতে রপ্তানির জন্য কাপড় বিদেশ থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় এনে স্থানীয় কালোবাজারে তা বিক্রি করে দেওয়া। যদিও অমন অসাধু কারবারির সংখ্যা খুবই সামান্য।

তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করছেন নারী শ্রমিকেরা। ছবি: হাসান রাজা

১৬ কোটি মানুষের দেশে স্থানীয় পোশাকের ক্রমবর্ধমান চাহিদার বাজারে দেশীয় পোশাকের অবস্থান কতটুকু, তা নিয়েও একটা মিশ্র ধারণা আছে। পুরুষ ও নারীদের অন্তর্বাস, লুঙ্গি, টি-শার্ট, সুতি শাড়ি, সুতি সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি—এসব ক্ষেত্রে দেশীয় পোশাকের একচেটিয়া প্রাধান্য থাকলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন শার্ট, প্যান্ট, সিনথেটিক শাড়ি ও সালোয়ার কামিজ ইত্যাদি পোশাক বা পোশাকের কাপড় বিপুল পরিমাণে বিদেশ থেকে আমদানি হচ্ছে।একসময়ের দুই ঈদভিত্তিক পোশাকের বাজার এখন প্রায় সারা বছরই কমবেশি জমজমাট থাকে। পয়লা বৈশাখকেন্দ্রিক পোশাকের কেনাকাটা ঈদুল আজহাকেও ছাড়িয়ে গেছে। কয়েক কোটি সচ্ছল মানুষের এই বাজার কিন্তু অনেক উন্নত দেশের বাজারের চেয়েও বেশ বড়। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাস্তবায়িত হলে এ পোশাকের বাজার আরও বিস্তৃত হবে, তা দখলে নেওয়ার জন্য অনেক দেশই আগ্রহী হয়ে উঠবে। স্থানীয় উদ্যোক্তা বা উৎপাদকেরা যদি এ বাজার দখলের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেন, তাহলে নতুন কর্মসংস্থান তৈরির পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় করা সম্ভব। স্থানীয় বেশ কিছু তৈরি পোশাকের ব্র্যান্ড এখন বাজারে আসছে, যা যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। যেসব ব্র্যান্ড ইতিমধ্যে বাজারে এসেছে, তারা দেশব্যাপী তাদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ নেয় এবং নতুন আরও কিছু উদ্যোক্তা যদি এই কাতারে শামিল হয়, তবে স্থানীয় পোশাকের এই আকর্ষণীয় বাজারে বিদেশি কাপড়ের বর্তমান আধিপত্য অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যই একটি বড় সুসংবাদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

এবার আসা যাক আমাদের অত্যন্ত সফল ও বিপুল সম্ভাবনাময় পোশাক রপ্তানি খাতের আগামীর পথচলার কথায়। যেটা শুরুতেই বলেছিলাম, বিগত অর্থবছরের শেষ (জুন ২০০৯) পর্যন্ত রপ্তানির চেহারাটা ছিল খুবই জ্বলজ্বলে, কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই রপ্তানির সেই ঊর্ধ্বগতিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে এবং রপ্তানিকারকেরা তাঁদের হাতের বর্তমান ক্রয়াদেশ বিশ্লেষণ করে বলছেন, অন্তত আগামী কয়েক মাস এই ভাটা অব্যাহত থাকবে। কেউ কেউ মনে করছেন, এ মন্দাভাব বেশ দীর্ঘায়িত হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

এর আগে আমরা এই উত্থান–পতন মোকাবিলা করেছি বেশ কয়েকবার। বিশেষ করে ২০০১ সালে নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার হামলা, ২০১০ সালে সুতার দাম বিশ্ব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়া, ২০১৫ সালে ইউরোর দাম রেকর্ড পরিমাণ কমে যাওয়ায় আমাদের রপ্তানি বড় ধরনের টালমাটাল অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়। এমনকি ২০১৩ সালের রানা প্লাজার ভয়াবহ বিপর্যয়–পরবর্তী সময়েও আমাদের বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। সুখের বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকেরা সরকার, শ্রমিক, ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সফলতার সঙ্গে এগিয়ে গেছেন ওই সব প্রতিকূলতা পেছনে ফেলে।

চলমান যে সংকট, তা মূলত ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে পোশাক বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়া এবং আমাদের একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বীর নতুন করে বাজারে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করার প্রচেষ্টার যৌথ ফলাফল। এই অবস্থা খুব বেশি দীর্ঘায়িত হবে না বলেই ধারণা করছি; তাই এ নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে বলে মনে হয় না। তবে সন্তুষ্ট চিত্তে বসে থাকারও কোনো উপায় নেই। চীন যেমন অর্থনৈতিক উন্নতি ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে পোশাক রপ্তানির বাজার হারাচ্ছে, যা আমাদের জন্য সুখকর, কিন্তু অন্যদিকে ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান, কম্বোডিয়ার মতো শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো নিজেদের আরও কার্যকর ও প্রতিযোগিতমূলক করার নানা কৌশল অবলম্বন করছে। আবার মিয়ানমার, ইথিওপিয়া, মাদাগাস্কারের মতো নতুন নতুন দেশ আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ভবিষ্যতে যে আমাদের আরও বড় প্রতিযোগিতায় শামিল হতে হবে, তা বলাই বাহুল্য। তা ছাড়া কোনো চূড়ায় যখন আপনি উঠতে চাইবেন, তখন যত এগোবেন, তত বড় চ্যালেঞ্জ আপনাকে মোকাবিলা করতে হবে; সেটা খুবই স্বাভাবিক।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনা–পরবর্তী সময়ে আমাদের পোশাকশিল্প যে বড় ধরনের ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছিল, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তা আজ আমরা শুধু কাটিয়েই উঠিনি, বরং অন্য সব দেশের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে আছি। অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্সের উদ্যোগ, উদ্যোক্তাদের অভূতপূর্ব পদক্ষেপ, সরকারসহ অন্যদের সহায়তায় কারখানাগুলোর সামগ্রিক নিরাপত্তামূলক পরিবেশ এখন শুধু অনেক উন্নতই নয়, সম্ভবত তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো। এর সঙ্গে গত পাঁচ বছরে সবুজ কারখানা নির্মাণের যে বিপ্লব প্রত্যক্ষ করেছি, তা আমাদের সারা বিশ্বে নতুন মর্যাদার আসনে আসীন করেছে। আন্তর্জাতিক মানের সবুজ কারখানার সংখ্যায় আমরা শুধু শীর্ষ অবস্থানই দখল করে আছি, তা নয়, দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা দেশটির তুলনায় আমাদের সবুজ কারখানার সংখ্যা ছয়-সাত গুণ বেশি।

কিন্তু দুঃখের কথা হলো, এসব ইতিবাচক ও প্রশংসনীয় অর্জনের কোনো ধরনের ব্র্যান্ডিং আমরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে করতে পারিনি। ফলে এখনো বাংলাদেশের নামের সঙ্গে রানা প্লাজা কিংবা তাজরীন ফ্যাশনসের নাম যতটা উচ্চারিত হয়, সে তুলনায় আমাদের প্রশংসনীয় অর্জনগুলো অনেকটা আড়ালেই রয়ে যাচ্ছে। সরকার, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ যৌথভাবে দ্রুততার সঙ্গে আমাদের সামগ্রিক শিল্পের এই ইতিবাচক ব্র্যান্ডিং করতে পারলে চলমান এবং ভবিষ্যতের শক্ত প্রতিযোগিতার বাজারে তা আমাদের জন্য ব্যাপক সুফল বয়ে আনবে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা উদ্যোগ নিলে বিদেশি অনেক বন্ধুরাষ্ট্র এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা তাদের হাত প্রসার করবে বলেই দৃঢ়বিশ্বাস।

আরও একটা বড় ভয়ের কথা ইদানীং বিভিন্ন মহলে উচ্চারিত হচ্ছে, তা হলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০। রোবটনিয়ন্ত্রিত কারখানা গড়ে পোশাকশিল্প আবার পশ্চিমা দুনিয়ায় ফেরত যাবে, কিংবা এ বিপ্লবের জোয়ারে আমাদের লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বেন ইত্যাদি। আলোচনার ব্যাপ্তিটা অনেক বড়, যা নিয়ে আলাদা একটি দীর্ঘ রচনা তৈরি করা দরকার, তবে সংক্ষেপে এটুকুই বলতে পারি, ওপরে বর্ণিত বিভিন্ন রকমের আপদ বা বিপদের আপাতত কোনো আশঙ্কা নেই। প্রযুক্তির উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং তাতে বিগত দিনগুলোয় আমাদের কারখানাগুলোও বিশ্বমানের আধুনিক যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত হয়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের করেছে সদা প্রস্তুত। এতে আমাদের শিল্পের অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিতই হয়েছে, কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। ভবিষ্যতের দিনগুলোয় এর ব্যতিক্রম হবে না বলেই বিশ্বাস রাখতে চাই। তবে এ ক্ষেত্রে আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলাটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং এই জায়গায় আমরা এখনো বেশ পিছিয়ে আছি বলতে হয়। শিক্ষাবিষয়ক নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে শিল্পের বিজ্ঞজনদের যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে দ্রুত এ ব্যাপারে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। এতে শুধু আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাই সহজ হবে না, বরং দক্ষ জনশক্তির ক্ষেত্রে বিদেশিদের ওপর আমাদের যে নির্ভরতা বিদ্যমান, তা–ও অনেকটা কমে আসবে। ফলে মূল্যবান প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক স্থানীয় লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।

শেষ করতে চাই সরকারি সহায়তা আর ভবিষ্যতের কর্মকৌশলের কথা বলে। সরকার বরাবরই তৈরি পোশাকশিল্পকে বিশেষ সমর্থন দিয়ে এসেছে, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। পাশাপাশি আমরা প্রায়ই বলি, আগামী এত বছর পর ৫০ বিলিয়ন বা ১০০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করব, কিন্তু কীভাবে তা অর্জন করতে পারব, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কৌশল বা কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়নি বলে কা​ঙ্ক্ষিত সময়ে ঘোষিত অর্জন সম্ভব না হওয়ার আশঙ্কাই প্রবল। ভবিষ্যতে বিশ্ববাজারের অনিশ্চয়তা, তীব্রতর প্রতিযোগিতা সামনে রেখে আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন সময়ের দাবি। পাশাপাশি সরকারি সহায়তাকে এই কর্মপরিকল্পনায় কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করাটাও অত্যন্ত জরুরি। যেমন আমরা জানি না, ছয় মাস পর গ্যাস বা বিদ্যুতের দাম কেমন হবে। আমরা জানি না, আগামী বাজেটে উৎসে কর কত নির্ধারণ করা হবে, আর তা নিয়ে কত দিন দেনদরবার অব্যাহত থাকবে ইত্যাদি। অর্থাৎ যেসব বিষয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে, তা দীর্ঘ মেয়াদে একটি মূল্য বা হারে নির্ধারণ করে দেওয়া। সব মিলিয়ে যদি নীতিনির্ধারক ও শিল্পের নেতৃস্থানীয় লোকজন যৌথভাবে আগামী ৫ বা ১০ বছর মেয়াদি একটি সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন, তাহলে আমাদের কর্মঠ ও নিবেদিত শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে নবীন-প্রবীণ উদ্যোক্তারা এ দেশের পোশাকশিল্পের পতাকাকে নিয়ে যেতে পারবেন সবার ওপরে। এ দেশের তৈরি পোশাক রাজত্ব করবে সারা বিশ্বে, যা হবে আমাদের লাল-সবুজের গর্ব আর বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’।

মো. ফজলুল হক সাবেক সভাপতি, নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেড