২০১৮ শেষ হয়েছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। বছরজুড়েই ছিল এ নিয়ে আলোচনা। বছর শেষ হচ্ছে, কিন্তু আলোচনা শেষ হচ্ছে না। এটি ছিল সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে সাড়া জাগানো নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন হিসাব দিল, ৪০ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা গুটি কয়েক ছাড়া সব আসন নিজেদের কবজায় নিয়ে গেছে। নির্বাচনে সহিংসতা ছিল না বললেই চলে। পরাজিত পক্ষের ভাষায়, এটি ছিল ‘শান্তিপূর্ণ কারচুপি।’
২০১৯ সালটা শুরু হয়েছিল নতুন সরকার দিয়ে। এটি ছিল একনাগাড়ে মহাজোটের তৃতীয় মেয়াদের সরকার। মন্ত্রিসভায় এসেছিলেন অনেক নতুন মুখ। পুরোনোদের পাঠানো হলো অবসরে। সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে তাঁরা অনেকেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ পেলেন।
নির্বাচনের আগে বিরোধী দলগুলোর একটি জোট তৈরি হয়েছিল, ঐক্যফ্রন্ট। ফ্রন্টে ২০–দলীয় জোটের বড় শরিক বিএনপি ছিল। তারা বড় আশা করেই নির্বাচনে গিয়েছিল। কিন্তু এমনটি যে হবে, তা তারা কল্পনাও করেনি। ফলে ফ্রন্ট নড়বড়ে হয়ে গেল। এই নির্বাচনে তাঁদের কয়েকজনই কেবল জয়ী হতে পেরেছিলেন। একেবারে ৩০০-০ গোলের ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হলে দৃষ্টিকটু হতো। শেষমেশ বিরোধী দল প্রতিপক্ষের জালে সাত গোল দিতে পেরেছিল। তারা কয়েক মাস গাঁইগুঁই করল, ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচনের ফলে তৈরি হওয়া ‘অবৈধ’ সংসদে তারা যাবে না বলে হুংকার দিল। অবশেষে তারা গেল অনেক নাটক-ফাটক করে। ‘আরেকবার সাধিলে খাইব’—এমন অবস্থা হয়ে পড়েছিল। বাজারে গুজব ছড়াল, লন্ডন থেকে আসা মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে তারা ছিটকে সংসদ ভবনে গিয়ে পড়ল।
নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশন খুব অস্বস্তিতে ছিল, এমনটি বলা যাবে না। নামে স্বাধীন হলেও কাজে–কর্মে এই কমিশন কতটা স্বাধীন তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। তবে সেখানেও গোলমাল আছে। পাঁচজনের কমিশনে সবাই সব বিষয়ে একমত হন না। সেখানেও ‘হারাধনের একটি ছেলে’ মাঝেমধ্যে উল্টো-সিধে কথাবার্তা বলেন। এটা সংবাদ শিরোনাম হয়, কিন্তু কাজের কাজ হয় না। ১-৪ ভোটে পিছিয়ে থেকে তো প্রস্তাব পাস করানো যায় না। বিরোধী পক্ষের প্রধান নেতা খালেদা জিয়া দুই বছরের বেশি সময় ধরে কারাবন্দী। তাঁর বিরুদ্ধে অনেক মামলা। দুটি মামলায় তিনি দণ্ডিত হয়েছেন। তাঁর আপিল–প্রক্রিয়া জারি আছে। মামলা চলবে কি চলবে না, আপিল করা যুক্তিযুক্ত হচ্ছে কি না, এ নিয়ে বছরজুড়ে আদালতে দৌড়াদৌড়ি চলেছে। শেষদিকে এসে তো সুপ্রিম কোর্ট হয়ে গেল পল্টন ময়দান। সেখানে মিছিল, বিক্ষোভ, স্লোগান সবই চলল।
খালেদার আইনজীবীরা ‘মানবিক কারণে’ তাঁর জামিন চেয়েও তা পাননি। মানবিক কারণ উল্লেখ করায় এটি মোটামুটি ধরে নেওয়া হলো যে বিচারিক প্রক্রিয়ায় তাঁর জামিন যে পাওয়া যাবে না, এটি তাঁর আইনজীবীরা মেনেই নিয়েছেন। সরকারের সঙ্গে নেপথ্যে কোনো সমঝোতা বা লেনদেন না হলে তাঁর জামিন পাওয়ার আশু সম্ভাবনা নেই।
বিএনপির অবস্থা এখন কাপ্তান ছাড়া জাহাজের মতো। বাতাসের ওপর ভর করে মৃদুমন্দ স্রোতের টানে চলছে। কিন্তু বাতাসের কোনো ঠিকঠিকানা নেই। অনেক মানুষ সরকারি দলের ওপর খাপ্পা। কিন্তু সেটি যে বিএনপিকে শক্তি জোগাবে, তেমন ভরসা নেই। মাঠে কেউ নামছেন না। নামবেনই–বা কেন? মাঠে তো বিএনপি নেতারাও নেই। তাঁরা হামলা-মামলায় জেরবার। অনেকেই বাড়িতে ঘুমান না। কোর্ট-কাচারিতে নিয়মিত হাজিরা দিতে হয়। গণমাধ্যমই তাঁদের একমাত্র ভরসা।
দেশে খুচরাখাচরা অনেক দল আছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি যদি হয় সুপারশপ, বাকিগুলো ছোটখাটো মুদি দোকান। সেগুলোতেও ঘুণ ধরেছে। আ স ম আবদুর রব একসময় ডাকাবুকো নেতা ছিলেন। এখন জাসদের একটি খণ্ড নিয়ে জেএসডি নামে মিটমিট করে জ্বলছেন। তাঁর ঘরেও বিবাদ। দলের সাধারণ সম্পাদক নিষ্ক্রিয়তা এবং স্বজনতোষণের অভিযোগ তুলে জুদা হয়ে গেছেন। কানাঘুষা হচ্ছে, এখানে তৃতীয় পক্ষের উসকানি আছে।
ওয়ার্কার্স পার্টি অনেক বছর ধরেই আওয়ামী লীগের ছাতার তলায় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মতো আলাদা অফিস-লোগো নিয়ে চলছিল। সেখানেও ছোটখাটো সুনামি বয়ে গেছে। দলের অনেকেই প্রধান নেতা রাশেদ খান মেননের ‘ইন্টিগ্রিটি’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, দলের কংগ্রেস বর্জন করে পৃথক হয়েছেন।
অন্য দলগুলোও সুখে নেই। অলি আহমদের দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি যত ছোটই হোক, সেখানেও শরিকানা বিবাদ। ড. কামাল হোসেনের গণফোরামেও কালো মেঘ। নিষ্ক্রিয়তার নালিশ তুলে একে অপরকে দুষছেন। সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টুকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। কয়েকজন তো খোদ কামাল হোসেনের বিরুদ্ধেই অভিযোগ এনেছেন।
মহাজোটের অন্যতম স্তম্ভ ছিল জাতীয় পার্টি। সম্প্রতি এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রয়াত হয়েছেন। দলটি তিনিই এক হাতে চালাতেন। দলে কোন্দল ছিল অনেক দিন ধরেই। তাঁর অবর্তমানে সেটি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব–অভিমানের বেড়া ডিঙিয়ে রীতিমতো যুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়েছিল। আপাতত সেটি সামলানো গেছে। দুই পক্ষই এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাকে রেফারি মেনে একটা আপস-মীমাংসার পথে গেছে। সম্পদের সুষম বণ্টন হয়েছে। একজন দলের চেয়ারম্যান থাকছেন, অন্যজন থাকছেন বিরোধী দলের নেতা। একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সংকট কী এবং কীভাবে এর মোকাবিলা করা যায়, জাতীয় পার্টির গৃহযুদ্ধ এবং তার মিটমাট থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে।
সরকারপক্ষের ১৪–দলীয় জোট বহাল আছে। নির্বাচন নিয়ে উল্টাপাল্টা মন্তব্য করে মেনন ফেঁসে যাচ্ছিলেন। তিনি সুর পাল্টালেন। ১৪ দলের অন্যরা তাতে মহাখুশি। জোট ছাড়লে যে কী দুর্গতি, তা কমবেশি সবাই বোঝেন। সবাই মাটি কামড়ে আছেন।
বিরোধী পক্ষের ২০–দলীয় জোট আছে না নেই, বোঝা যায় না। এ বছর জোটের সভা হয়েছিল মাত্র একবার। জোটের শরিকদের নালিশ, বিএনপির বড্ড অহংকার। ছোটদের পাত্তা দেয় না, তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় না। অলি আহমদ তো একবার বিদ্রোহ করতে গিয়ে পরে মিইয়ে গেছেন। জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে এই জোটে অস্বস্তি আছে।
বছরের শেষ দিকে এসে সরকারি দল নানা সমস্যায় পড়েছে। দলের ডালপালাগুলো আর বশে নেই। ছাত্রলীগ-যুবলীগ নিয়ে অনেক কাণ্ড। চাঁদাবাজি-ক্যাসিনো নিয়ে তুলকালাম হলো। দলের অনেককে বহিষ্কার করে আপাতত কসমেটিক সার্জারি দিয়ে কাজ চলেছে। দলের পক্ষ থেকে জোর গলায় বলা হচ্ছে, ক্লিন ইমেজ না হলে দলে জায়গা নেই।
বছরের শেষ রাজনৈতিক ঘটনা হলো আওয়ামী লীগের কাউন্সিল। বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই দুই দিনের কেন্দ্রীয় সম্মেলনটি হয়ে গেল। নেতৃত্বে ছোটখাটো কিছু পরিবর্তন এসেছে। কয়েকজন পদোন্নতি পেয়েছেন। শীর্ষ নেতৃত্ব বহাল আছে আগের মতোই। দলের সবাই জানেন, দলে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। অতীতে বিকল্প খুঁজতে গিয়ে অনেকেই নকআউট হয়েছেন। নিকট ভবিষ্যতে এই সাহস আর কারও হবে না। দলের মধ্যে উত্তরাধিকার খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে। তবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, শেখ হাসিনা যত দিন শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্ষম আছেন, তত দিন তিনি না চাইলেও তাঁকেই সভাপতি থাকতে হবে। তিনি সরে দাঁড়াতে পারবেন না, কেউ তাঁকে চ্যালেঞ্জও করবে না। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে দলের স্লোগান ছিল—এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। এখন সময় পাল্টেছে, দল পেয়েছে নতুন নেতা। তবে স্লোগান আছে আগের মতোই—এক নেতা এক দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ। দল চলছে একক নেতৃত্বে। সরকারও চলছে একক নির্দেশনায়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ মুহূর্তে শেখ হাসিনার সমকক্ষ আর কেউ নেই। তিনি একটানা নেতৃত্বদান ও কর্তৃত্ব করছেন এগারো বছর ধরে। একটা দীর্ঘমেয়াদি শাসনের সব আলামত এখানে স্পষ্ট। এই পরিক্রমা কোথায় গিয়ে থামবে, এ মুহূর্তে বলা কঠিন। প্রশ্ন হলো, তিনি ও তাঁর রাজনীতি দেশবাসীকে কী দিচ্ছে বা দেবে। তিনি কি কাস্ত্রো-মাহাথিরের মতো অনেক বছর ধরে আলো ছড়াবেন? সময়ের প্রয়োজনে বা জনপ্রিয়তার নিরিখে কেউ কেউ অনিবার্য হয়ে ওঠেন। কিন্তু সবার পরিণতি একই রকম হয় না। রবার্ট ব্রাউনিং-এর ‘প্যাট্রিয়ট’ কবিতাটি আমাদের অনেকের পড়া আছে।
রাজনীতির এখন যে হাল, এ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো বলা যায়, বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ। তাতে শ্যাম-কুল দুই–ই থাকে। রাজনীতির ব্যাপারে কীই–বা বলা যায়? এখানে তো মানুষ নিয়ে কারবার। মানুষের মন বোঝা ভার। ১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলে এনএসএফ-এর গুন্ডা সাইদুর রহমান ওরফে পাচপাত্তু খুন হওয়ার সময় কেউ কি ভেবেছিল তিন-চার মাসের মাথায় সারা দেশে একটা ওলট–পালট ঘটে যাবে?
নানান মানদণ্ডে ও সূচকে বাংলাদেশের একটি উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। এটি বহমান থাকুক, এর গতি আরও বাড়ুক, আমরা সবাই তা চাই। একটি ভালো পরিকল্পনা বা রূপকল্প এবং নেতৃত্ব বিষয়টি অনেক সহজ করে দিতে পারে। এ জন্য দরকার শুদ্ধ রাজনীতি। এটির এখন অভাব। জিন্দাবাদ-মুর্দাবাদের গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্বসভায় জায়গা করে নিতে হলে আমাদের হতে হবে আরও আধুনিক, মননে ও কাজে।
রাজনীতি এখন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। সরকারি দল রাষ্ট্রের ওয়াচডগ নয়। বরং সরকারি দল রাষ্ট্রের কর্মসূচির সাফাই গেয়ে বেড়াচ্ছে। তাতেও সমস্যা নেই, যদি রাষ্ট্র সরকারি দলের মোসাহেবদের না হয়ে সবার হয়। এখন প্রশ্ন—রাষ্ট্র কবে সবার হবে?