পৃথিবীর আদি যুগ থেকে সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে মানুষের তিনটি মৌলিক চাহিদা উপলব্ধ হয়। মানুষ যখন গুহায় বাস করত, তখন গৃহ ছিল মাথার ওপর একটা ছাদ এবং নিরাপত্তার জন্য শক্ত বেষ্টনী। আজ যখন আমরা গৃহ বলি, তখনো কিন্তু মৌলিক চাহিদা হিসেবে এই দুটোই বিরাজমান রয়েছে। কিন্তু যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বহু রকম সুযোগ–সুবিধা এবং আরাম–আয়েশ সংযুক্ত হয়েছে। এককথায় বলতে গেলে, এখন আমরা গৃহনির্মাণকে শিল্প রূপে পরিবর্তন করতে চাইছি আর এই পেশায় সংশ্লিষ্ট স্থপতি, প্রকৌশলী, নির্মাণ কলাকুশলী এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একটি লাইফস্টাইল রচনা করার প্রয়াস চালাচ্ছি। তাই আর সব পণ্যের মতোই গৃহায়ণ একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল শিল্পে স্বীকৃত হয়েছে।
একইভাবে আমাদের পরদাদার সময়কার সহজ জীবন আদর্শে যেমন একজন কর্মজীবী বা ব্যবসায়ী বাড়ি বানিয়ে একটি নিজ গৃহের স্বপ্ন দেখতেন ৬০ বছর বয়সে অবসর গ্রহণের পর সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে, আজ কিন্তু সেই প্রেক্ষাপটেও পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তরুণ সমাজও ৩৫ বছর বয়স থেকে একটি ছোট অ্যাপার্টমেন্টের মালিক হওয়ার চিন্তা আরম্ভ করেন এবং ৪০ বছরে পা দেওয়ার আগেই তা বাস্তবায়নের সব রকম পদক্ষেপ তৈরি করে নেন। সেই দিন আর বেশি দূরে নয়, যখন পশ্চিমা জগতের মতো বাংলাদেশে একজন ৩০–এর ঘরের তরুণ একটি বসবাসযোগ্য নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টের গর্বিত মালিক হতে পারবেন।
যুগ যুগ ধরে মানুষ নিজ গৃহে, যার স্বত্ব মালিকানা আছে সেখানেই বসবাস করতে চায়। গত পাঁচ দশকে মানুষ শহরমুখী হয়ে উঠেছে, যেখানে তার উপার্জন এবং লাইফস্টাইল অনেক উন্নত, সেখানেই সে চায় নিজের স্থায়ী ঠিকানা। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে যৌথ পরিবার থেকে নিউক্লিয়ার বা একক পরিবার, যা নাকি গৃহায়ণের চাহিদা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর ঢাকা শহরে অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা প্রায় ১ লাখ, যার বিপরীতে জোগান বা সাপ্লাই আছে ৮ হাজারের মতো। অবশ্য কেবল চাহিদা থাকলেই তো চলবে না, সেই সঙ্গে ক্রয়ক্ষমতাও থাকতে হবে।
এই পরিস্থিতির একটি সমাধান হচ্ছে, ব্যাংকঋণ বা নন–ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউটের (এনএফআই) ঋণ গ্রহণ।
তখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, ব্যাংক বা এনএফআইয়ের উচ্চ সুদ, ক্রেতার প্রতি মাসে কিস্তি পরিশোধের আর্থিক ক্ষমতা, ক্রেতার নিজস্ব সঞ্চয় এবং প্রস্তাবিত গৃহের দলিলপত্রের স্বচ্ছতা।
এই দীর্ঘ ভূমিকার কারণ হলো, এই স্বপ্ন কি আসলেই বাস্তবে রূপ নিতে পারে, পারলে তা কীভাবে? আমরা এখানে একজন ত্রিশের ঘরের কাল্পনিক ব্যক্তি, যাঁকে ক্রেতা বলে সম্বোধন করছি, তাঁর ওপর একটা পরীক্ষামূলক প্রতিবেদন তুলে ধরব।
ক্রেতার মাসিক আয় ১ লাখ টাকা এবং বাড়ি ভাড়ায় তিনি সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ খরচ করলে তাঁর প্রাসঙ্গিক অন্যান্য খরচ চালিয়ে তিনি একটি সচ্ছল জীবন যাপন করতে পারেন। উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যের মান অনুযায়ী একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশের বেশি গৃহায়ণবাবদ খরচ করা উচিত নয়। যা হোক, আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ ধরলেও ক্রেতা ৩০ হাজার টাকা খরচ করলেও তিনি একটি সচ্ছল জীবন যাপন করতে পারবেন বলে ধরে নেওয়া যাক।
বর্তমান বাজারে সর্বনিম্ন ৬০ লাখ টাকা দিয়ে ঢাকা শহরের আশপাশে হলেও একটি দুই বেডরুমের সুন্দর অ্যাপার্টমেন্ট পাওয়া যেতে পারে।
ক্রেতা এই পরিমাণ টাকা অবশ্যই তাঁর নিজস্ব সঞ্চয় থেকে দিতে পারবেন না। তাহলে তাঁকে কোনো অর্থ সংস্থানকারী ব্যাংক বা এনএফআই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে গৃহায়ণ ঋণ নিতে হবে। বর্তমান বাজারে ঋণ ২০ বছর মেয়াদি হলে সুদের হার ১২ শতাংশ প্রচলিত আছে। ক্রেতার ভবিষ্যৎ উন্নতি এবং সামঞ্জস্য আয় নির্ণয় করে ব্যাংক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত আর্থিক ঋণ দিতে পারে। উল্লেখ্য, ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান দুটি জিনিস যাচাই করে। প্রথমটি, যে সম্পত্তির ওপর ঋণ নেওয়া হয়েছে তার সব রকম আইনানুগ কাগজপত্র গ্রহণযোগ্য কি না আর দ্বিতীয়ত ক্রেতা সময়মতো মাসিক কিস্তি দিতে পারবেন কি না। বাস্তব ক্ষেত্রে এই মাসিক কিস্তি পরিশোধের ওপরই ব্যাংকগুলো বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
আমাদের উল্লেখিত ক্রেতা ৭৫ শতাংশ ঋণ পেতে পারেন, যা কিনা তাঁর ক্ষেত্রে ৪৫ লাখ টাকা দাঁড়ায়, যা ২০ বছরে পরিশোধযোগ্য।
এই ক্ষেত্রে মাসিক কিস্তি বা ইএমআই দাঁড়ায় প্রায় ২৫ হাজার টাকা, যা কিনা ক্রেতার আয়ের ২৫ শতাংশ এবং সহজে পরিশোধযোগ্য।
একজন ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়সের ক্রেতার পক্ষে স্বাভাবিক পটভূমিকায় ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার বেশি বাড়ি কেনার জন্য দিতে পারার কথা নয়, তাহলে বাকি ১০ লাখ টাকা আসবে কোন খাত থেকে?
গৃহায়ণশিল্পকে ডায়নামিক করার জন্য সরকারের বিভিন্ন স্কিম নেওয়া যেতে পারে, যেখানে ক্রেতা সরাসরি এর সুবিধা উপভোগ করতে পারেন।
যুক্তরাজ্যে ‘হেল্প টু বাই’ নামের এমন একটি স্কিম খুব ভালোভাবে কাজ করছে। এটি হলো, সরকার কোনো গৃহ ক্রয়ের ২০ শতাংশ ইকুইটি ইনভেস্টমেন্ট করে, যা নির্দিষ্ট সময় বাজারমূল্যে ফেরতযোগ্য। এটা দিয়ে ক্রেতাকে সাহায্য করতে পারে সরকার। অর্থাৎ এই ২০ শতাংশের সরকারও মালিক। ক্রেতা যেকোনো সময় এই টাকা আগের বাজারমূল্যে সরকারের কাছ থেকে কিনে নিজে সম্পূর্ণ মালিকানা পেতে পারেন। সাধারণভাবেই ক্রেতা যত শিগিগর সম্ভব পূর্ণ মালিকানা গ্রহণ করে নিতে চান।
এ ছাড়া ব্যাংকঋণের সুদ যত দূর সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে, একই সঙ্গে নির্মাণসামগ্রী এবং খরচ যত দূর সম্ভব কম রাখলে গৃহ ক্রয় আরও সহজ ও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে।
তাহলে সারমর্ম করলে আমরা যা দেখতে পাই তা নিচে তুলে ধরা গেল:
১. গৃহায়ণের জন্য ব্যাংকঋণসুবিধা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কাম্য।
২. সুদের হার বর্তমানে ১২ শতাংশ বা ১ ডিজিটের ওপর হওয়ায় ক্রেতা মাসিক কিস্তি দিতে অপারগ। এটি একটি কঠিন প্রস্তাব। অন্য দিকে ব্যাংক ডিপোজিটের হার ন্যূনতম না রাখলে ব্যাংক ব্যবসা করতে পারবে না, কারণ টাকা জমা কম হবে। কাজেই অর্থ–বাণিজ্য বিবেচনায় রেখে সুদের হার সমন্বয় করতে হবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর।
৩. ক্রেতা প্রতি মাসে ফেরত দিতে পারেন (ইএমই), এমন হিসাব মিলিয়েই টাকা ঋণের যোগ্য হবেন এবং তাঁর জীবন স্বচ্ছন্দে থাকবে।
৪. তাহলে ক্রেতার দেয় অংশ এবং ব্যাংকঋণের মধ্যে রয়ে যাওয়া বাকি অংশ সরকারি নির্ভরশীল সহযোগিতার মাধ্যমে পূরণ হলে সব পক্ষের জন্য সমাধান বয়ে আনতে পারে।
৫. ব্যাংকঋণ সাধারণত ফ্লোটিং চার্জ বা পরিবর্তনশীল সুদের হারে দেওয়া হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে হঠাৎ হার অনেক বেড়ে গেলে ঋণগ্রহীতার সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তা পরিশোধ করতে অপারগ হয়ে যান। এই পরিস্থিতি যত কম হবে, খেলাপির সংখ্যাও তত কমে আসবে। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক গভর্ন্যান্স শক্তিশালী হলে আর সমস্যা ততটা হয় না। এ বিষয় পর্যালোচনা করা এই প্রতিবেদনের পরিধির বাইরে।
সুখের বিষয় হলো, ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করলে দেখা যায়, গৃহায়ণ অর্থায়নে নাকি ঋণখেলাপির হার সবচেয়ে কম।
গৃহায়ণের সঙ্গে ৩০ লাখ কর্মজীবী এবং শ্রমিকের পেশা জড়িত আছে। আরও আছে পরোক্ষ শিল্পায়ন এবং অবকাঠামোর উন্নতি। কাজেই, গৃহায়ণ অর্থায়ন একটি দেশের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর এবং এটির প্রতি সুনজর দিয়ে দেশের পরিপূর্ণ উন্নয়নে সহায়ক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এই লেখা কেবল বর্তমান গৃহায়ণ অর্থায়নের একটি দিকনির্দেশনা মাত্র। আরও বিশদ পর্যালোচনা করে এই সামাজিক সমস্যার দ্রুত সমাধান বাঞ্ছনীয়।
এফ আর খান ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিটিআই