যেকোনো স্থানে অবিচার সর্বত্রই ন্যায়বিচারের জন্য হুমকি

>

মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করেছেন অনেক। কর্নেল তাহেরের বিচার নিয়ে প্রথম আলোর জন্য অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করেন এই সাংবাদিক। ধারাবাহিকভাবে সেটি প্রকাশিত হয় ২০১১ সালের ২২ থেকে ২৪ জুলাই।

.

৩৫ বছর আগে আজকের দিনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এমন একজন মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল, যাঁকে আমাদের অনেকেই চিনতেন, শ্রদ্ধা করতেন, অনেকে যাঁর গুণগ্রাহী ছিলেন। অতীতের বছরগুলোর মতো আমরা এখানে সমবেত হয়েছি—কেউ এসেছেন প্রথম বারের মতো, অন্যরা আগেও স্মরণসভায় যোগ দিয়েছেন—আমরা এসেছি আবু তাহের ও তাঁর আদর্শকে স্মরণ করতে। এবং এ কথা স্মরণ করতে যে, কীভাবে ক্ষমতাসীন শক্তি আইনের শাসনকে পরিণত করেছিল একগুচ্ছ স্বেচ্ছাচারী ও বিশেষ কায়দাতে। অপরাধ সংঘটিত করে হলেও শাসন চালিয়ে যেতে তারা ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
তবে এ বছর আমরা শুধু মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছি না, আমরা একদল দৃঢ়সংকল্প মানুষের সারা জীবনের লক্ষ্যপূরণও উদ্যাপন করছি। তাঁদের অভীষ্ট ছিল ন্যায়বিচার অন্বেষণ—তাঁদের অধরা আশা ছিল একদিন ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে। আমরা সবাই বেঁচে থাকি আশা ও স্বপ্ন নিয়ে। আজকের দিনটি সত্যিই এক বিরল দিন; কারণ ‘ন্যায়বিচার পাওয়ার স্বপ্ন’ এমনভাবে সত্যি হয়েছে, যা হওয়া একেবারেই অসম্ভব বলে মানুষের মনে হতো।
চলতি বছরের ২২ মার্চ এমনই এক স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। দেশের জন্য এটা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আর তাহেরের পরিবারের কাছে অত্যন্ত আবেগঘন ব্যাপার। তাঁরা ভাবতেও পারেননি এমন দিন আসবে। যা ঘটেছে তার তাৎপর্য আমার দৃষ্টিতে এ দেশের সমাজের জন্যও বিরাট। অন্যায়-অবিচারে পরিপূর্ণ পৃথিবী ও সমাজে ন্যায়বিচারের দিকে একটি পদক্ষেপের মানে আশার দিকে একটি পদক্ষেপ।
কোনো দেশের সর্বোচ্চ আদালত যেসব আদর্শের পক্ষাবলম্বন করবে বলে প্রত্যাশা করা হয়, তার সমতুল্য কোনো অবস্থান নেওয়ার ঘটনা বিরল। সর্বোচ্চ আদালত কতবার আমাদের হতাশায় ডুবিয়েছেন; প্রতিটি বাঁকে ন্যায়বিচারকে বিপথে চালিত করতে অব্যাহত রাজনৈতিক চাপ আর হুমকি-ধমকির কারণে তেমন ঘটেছে।
এবার তেমন ঘটেনি। তাহেরের মামলা পুনর্বিচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ, বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি জাকির হোসেনের নেতৃত্বে ঘোষণা দেন, আবু তাহেরের বিচার অবৈধ ও অসাংবিধানিক ছিল। বিচারপতি শামসুদ্দিন তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেন, তথাকথিত বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল নম্বর ১ এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর যে বিচার অনুষ্ঠিত হয়, সেটা বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না।

বিচারকাজটি বেআইনি পদ্ধতিতে সম্পাদিত হয়—কোনো আদালতে নয়, জেলখানার ভেতরে। বিচারিক কার্যক্রমের ওপর এ দেশের সংবাদপত্রে কোনো একটি শব্দও লেখা যাবে না—নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল সে সময়। একজন সম্পাদক—দৈনিক ইত্তেফাক-এর আনোয়ার হোসেন মঞ্জু—তাহেরের বিচারের বিষয়টি সংক্ষেপে প্রকাশ করেছিলেন। তৎক্ষণাৎ তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়, তাঁর পত্রিকায় এ মামলার ব্যাপারে আর কোনো শব্দ প্রকাশিত হলে ভীষণ পরিণতি ভোগ করতে হবে।

১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে ট্রাইব্যুনালের কাছে তাহের যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তা সত্যিই দূরদর্শী: ‘১৯৭৬ সালের ১৫ জুন যে অধ্যাদেশ ঘোষণা করা হয়েছে, তা একটি কালো আইন। সরকারের মতলব চরিতার্থ করতেই এই অধ্যাদেশ ঘোষিত হয়েছে। অধ্যাদেশটি অবৈধ। তাই এই ট্রাইব্যুনালের আইনগত অথবা নৈতিক কোনো অধিকার নাই আমার বিচার করার।...সময়ের শুরু থেকে আজ অবধি নিরন্তর চেষ্টার ফলে মানবসভ্যতার যা কিছু ভালো অর্জন, সেসবকেই লজ্জায় ফেলে দিয়েছে এই ট্রাইব্যুনালের কর্মকাণ্ড।’

৩৫ বছর পর বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তাহেরের সঙ্গে একমত হয়েছেন। আদালত ঘোষণা করেছেন, তাহের ও তাঁর সহযোগীদের বিচার ছিল ‘একটি ধাপ্পাবাজি, বিচারের ভান ও অলীক কাহিনী।’ ‘জোচ্চুরির ট্রাইব্যুনাল’ যে রায় দিয়েছিলেন তা ‘খারিজ ও বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল...যেন...এমন প্রহসনমূলক বিচার কোনো দিন ঘটেইনি।’

আদালত তাহেরকে শহীদ ও দেশপ্রেমিক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আরও বলেছেন, আজ যদি জেনারেল জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকতেন, তাহলে তাঁকে তাহেরের মৃত্যুর জন্য ‘হত্যাকাণ্ডের বিচারের’ সম্মুখীন হতে হতো। আদালত আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ঘোষণা করেছেন, ‘কর্নেল আবু তাহেরের তথাকথিত বিচার ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনাটি ঠান্ডা মাথায় হত্যা। এবং এর পরিকল্পনাকারী আর কেউ নন, জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজেই।’

সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার কয়েক দিন আগে আদালতে বসে আমি শাহ্দীন মালিকের মুখে শুনছিলাম ১৯৭৬-এর জুলাইয়ের ঘটনাবলির বর্ণনা। তিনি তাহের-পরিবারের আইনজীবী। তিনি যে সময়ের কথা বলছিলেন তখন বাংলাদেশি সমাজ অবিশ্বাস্য রকম নিচে নেমে গিয়েছিল। দেশের পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছিল যে হত্যাকাণ্ডের পরপরই গঠন করা হয়েছিল গোপন সামরিক ট্রাইব্যুনাল আর বিচারের রায় ছিল পূর্বনির্ধারিত—মৃত্যুদণ্ড।

তারপর, কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৭৭ সালের শরৎকালে গণহারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো। জেলখানার ভেতর সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের ভানও করা হলো না এবার। উল্টো আইনসংগত সব সামরিক পদ্ধতি লঙ্ঘন করে সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের জোরপূর্বক ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো হয় অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়।

শাহ্দীন মালিক চমৎকার ভাষায় আদালতের কাছে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী মামলায় আদালতের প্রদত্ত রায়ের যৌক্তিক ফলাফল হিসেবে তাহেরের মামলার রায় উল্টে দেওয়ার মাধ্যমে ‘আইনের শাসন’ বাঁচানোর আহ্বান জানান। চলতি বছরের ২২ মার্চ বিচারপতি শামসুদ্দিন ও বিচারপতি জাকির বিরাট সাহস দেখিয়েছেন আর বাঁচিয়েছেন আইনের শাসনকে। তা করার মধ্য দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশের সমাজকে তাহেরের জবানবন্দিতে বর্ণিত আধুনিক সভ্যতার পথে ফিরিয়ে আনতে প্রচণ্ড সহায়তা করেছেন।

তাহের উল্লেখ করেছিলেন যে ‘নিরন্তর চেষ্টার ফলে মানবসভ্যতার যা কিছু ভালো অর্জন, সেসবকেই লজ্জায় ফেলে দিয়েছে’ জিয়ার বিশেষ সামরিক আদালত নম্বর-১। ৩৫ বছর আগে জেনারেলদের কৃত দুষ্কর্মের কারণে এ দেশকে যে লজ্জা বরণ করতে হয়েছিল, তা মোচনের জন্য জিয়ার ট্রাইব্যুনালকে বেআইনি ও অপরাধমূলক হিসেবে সমালোচনা করে সুপ্রিম কোর্ট একটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ কাজের জন্য বিচারপতি শামসুদ্দিন ও বিচারপতি জাকিরের প্রশংসা করতে হয়। অবশ্য তাঁদের মহান কাজ এখনো অসমাপ্ত।

আবু তাহেরের প্রতি যে অবিচার করা হয়েছিল, তার যত দূর সম্ভব বিহিত করা হয়েছে। ২২ মার্চের আগ পর্যন্ত এটুকুও ছিল স্বপ্ন। অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো অপরাধের সত্যিকারের প্রতিকার করা খুব দুঃসাধ্য; যা কিছুই করা হোক না কেন তা সব সময়ই তা অপ্রতুল হবে। জীবন তো ফিরিয়ে আনা যায় না। তিনটি ছোট শিশুর নিজেদের বাবার দৈনন্দিন উপস্থিতি ছাড়াই বেড়ে ওঠা কিংবা এক তরুণ নারী তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়ে স্বামীহারা হওয়ার অভিজ্ঞতা ‘সংশোধনের’ কোনো উপায় নেই। এ ধরনের আন্তরিক বেদনা ঠিকমতো সারানো যায় না কোনোভাবেই। কোনো আদালত সেই জগৎ কে স্পর্শ করতে পারেন না। স্বৈরতন্ত্রের ওপর গণতন্ত্রকে জয়ী করতে হলে উচ্চাভিলাষী সেনাসদস্যদের বেসামরিক শাসন রহিত করার সব প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ‘আইনের শাসন’কে সুরক্ষিত রাখতে হবে। এই রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ফলাফল মেনে নিতে পাকিস্তানের অস্বীকৃতির ফলস্বরূপ। নির্বাচনের ফল বাস্তবায়নের দাবিতে কয়েক সপ্তাহ অহিংস আইন অমান্য কর্মসূচি চলার পর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এই বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে শুরু হয়েছিল এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে সেই ঘটনা।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর ভেতরকার কিছু সদস্য কতগুলো শক্তির সঙ্গে মিলে দেশকে পিছিয়ে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানি মডেল ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে চলেছে সামরিক শাসন অথবা আধাসামরিক শাসন। জিয়া ও এরশাদের শাসনামলে মুজিবের খুনিরা ‘সুরক্ষিত ব্যক্তি’ হিসেবে জীবন যাপন করেছেন। ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনাসদস্যদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের পর এ দেশ আরেক দফা সামরিক একনায়কতন্ত্রের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। আবারও ডিজিএফআই এক ভীতিকর সংস্থায় পরিণত হয়েছিল—তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী ও অন্য নাগরিকদের তুলে নিয়ে যাওয়া শুরু করেছিল। গোপন তদন্তকক্ষে নির্যাতন চালানোর প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল।

অত্যন্ত পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খলভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী ও শিক্ষার্থীরা অহিংস বিক্ষোভ ও মোমবাতি প্রজ্বালনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ফিরিয়ে দেওয়া এবং রাজবন্দীদের মুক্তি দাবি করেন। তাঁদেরকে গভীর সাহস দেখাতে হয়েছিল। বিভক্ত সেনাবাহিনী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে পিছু হটতে হয়েছিল।

বাংলাদেশের বিশিষ্ট বন্ধুরা—যেমন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি—তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সেনাবাহিনীকে বন্দীদের মুক্তিদান এবং আটক ব্যক্তিদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কয়েক মাস আমরা শঙ্কিত ছিলাম, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর আবার হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নিরীহ মানুষের ভয়ানক হত্যাযজ্ঞের ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। সেরকম কিছু ঘটলে তার শেষ যে কোথায় হতো, তা কেবল কল্পনা করা যায়।

তাই আজ আমরা যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করছি, সেগুলো নিছক একাডেমিক প্রশ্ন নয়। এ দেশের মানুষের জীবন ও নিরাপত্তার জন্য এগুলো জরুরি প্রশ্ন। বেসামরিক গণতন্ত্র টিকে থাকতে হলে তার বৈধতার ভিত্তি হতে হবে এমন কর্মসূচি, যা দেশের জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে আসবে; সেই জনগণের জন্য যারা দারিদ্র্য ও অনুন্নয়নের বিরুদ্ধে লড়াইরত।

সেই পথ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক, সমাজতান্ত্রিক কিংবা পুঁজিবাদী যা-ই হোক না কেন, রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগ ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল ‘আইনের শাসন’, বিনা বিচারে আটক না থাকার অধিকার এবং নিরপেক্ষ বিচার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে পারে। ফরাসি দার্শনিক ও গণিতবিদ ব্লেস পাসকাল একদা লিখেছিলেন, ‘ন্যায়বিচার ও ক্ষমতাকে একসঙ্গে আনা আবশ্যক, যাতে যা কিছু ন্যায়সম্মত তা-ই ক্ষমতাশালী হতে পারে আর যা কিছু শক্তিশালী তাই ন্যায়সম্মত হতে পারে।’

এটাই আগামীর চ্যালেঞ্জ। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি জাকির হোসেনের দেওয়া ২২ মার্চের রায় আমার মতে একটি সন্ধিক্ষণ ছিল। যদিও আদালতের রায় সামনের দিকে বিরাট এক পদক্ষেপ, তবু আরও অনেকগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়ে গেছে; সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা দরকার, যাতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেন টিকে থাকে, স্বৈরতন্ত্রের স্বপ্ন লালনকারী শক্তিগুলোর দ্বারা যেন আবারও আক্রান্ত না হয়।

আবু তাহেরকে স্মরণের এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র কেন্দ্রে এবার আমি দ্বিতীয়বারের মতো বক্তৃতা করার সুযোগ পেলাম। আমার কথাগুলো কীভাবে সাজাই, তা যখন ভাবছিলাম, তখন আমার মাথায় ঘোরাফেরা করছিল একজন মহান আমেরিকানের কিছু কথা। আমার বেড়ে ওঠার সময়ে, তরুণ বয়সে মার্টিন লুথার কিং বেঁচে ছিলেন।

যে রাতে তিনি মারা গেলেন, মনে পড়ছে সেই রাতের কথা। মনে পড়ছে, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কীভাবে হোস্টেল ছেড়ে গিয়ে হাজির হয়েছিল নাগরিক অধিকার আন্দোলনে মার্টিন লুথার কিংয়ের সহযোদ্ধা ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু রেভারেন্ড উইলিয়াম শ্লোয়ান কফিনের বাড়িতে। বিল কফিন ইয়েলের ধর্মযাজক ছিলেন। ড. লুথার কিংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ইয়েলের ব্যাটেলি চ্যাপেলে আয়োজিত স্মরণসভায় রেভারেন্ড কফিন আলাবামা অঙ্গরাজ্যের বার্মিংহাম জেল থেকে লেখা লুথার কিংয়ের বিখ্যাত চিঠিটির কথা বলেছিলেন। লুথার কিংকে সেখানে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি অহিংস প্রতিবাদের নেতৃত্ব দেওয়ার সময়।

যখন আমি এই মহান বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা ভাবি, যে বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য এ দেশের সংগ্রামের ইতিহাসে সমৃদ্ধ, তখন বারবার মনে পড়তে থাকে ১৯৬৩ সালে বার্মিংহাম কারাগার থেকে মার্টিন লুথার কিংয়ের লেখা এ কথাগুলো, ‘যেকোনো জায়গায় অবিচার সর্বত্রই ন্যায়বিচারের জন্য হুমকি’।

মার্টিন লুথার কিং যা বলেছিলেন সে কথা আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসের চোরাপথে আমাদের দিশা দিচ্ছে, তাহেরের মামলার মতোই যার সুরাহা করতে দরকার জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার। তাহেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ১৫ মাস পর এ দেশের কারাগারগুলোতে মৃত্যুর ঝড় বয়ে গিয়েছিল। আজ আমরা এ বিষয় নিয়ে কথা বলব।

সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণার আগে গত ১৪ মার্চ আমি আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছি। জানুয়ারি মাসে যখন বুঝতে পারলাম আমার পক্ষে সে সময় সাক্ষ্য দিতে আসা সম্ভব হবে না, তখন হলফনামা পাঠিয়েছিলাম। হলফনামায় আমি বলেছিলাম, কীভাবে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মোহাম্মদ মঞ্জুর, যাঁর সঙ্গে আমার কয়েক বছরের জানাশোনা ছিল, আমাকে জানিয়েছিলেন যে, তিনি নিশ্চিতভাবে জানতেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১ নম্বর বিশেষ ট্রাইব্যুনালে সাংঘাতিক বিচার-প্রক্রিয়া শুরুর আগেই তাহেরকে প্রাণদণ্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান।

এই তথ্যের আলোকে স্পষ্ট যে শুরু থেকেই ট্রাইব্যুনালের কর্মকাণ্ড শুধু জেনারেল জিয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে মঞ্জুরের দেওয়া তথ্যটির সত্যতা সম্পর্কে আমি সেই সময়ে জিয়ার ঘনিষ্ঠ দুই সেনাসূত্রে নিশ্চিত হয়েছি।

আমার হলফনামা দাখিল করা ও সাক্ষ্য দেওয়ার পর বিএনপির কয়েকজন নেতা আমাকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করেন। তাঁরা দাবি করেন, জেনারেল জিয়ার ওপর কালিমা লেপনের জন্য সরকার আমাকে নিযুক্ত করেছে। আমি বিএনপির সমালোচনা করে একটি কথাও বলিনি। দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার অভিযোগ করেছেন যে, মরহুম জিয়াউর রহমানের চরিত্র হননের উদ্দেশ্যে সরকার একজন বিদেশি সাংবাদিককে [লিফশুলজ] ভাড়া করেছে।’ এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার কয়েক দিন পর আমি এম কে আনোয়ারকে ফোন করে তাঁর সঙ্গে আলাপ করি।

আমি তাঁকে বলি, আমি সাংবাদিক। জেনারেল জিয়ার মর্যাদাহানির জন্য বর্তমান সরকার একজন বিদেশি সাংবাদিককে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর কাছে যে প্রমাণ রয়েছে, সে বিষয়ে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিতে চাই। আমি বলি, এ সম্পর্কে তাঁর কাছে যে প্রমাণ ও তথ্য আছে আমি সেগুলোর ব্যাপারে আগ্রহী। আমি তখনো ঢাকাতেই ছিলাম। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চাইলাম। তিনি সময় দিতে অস্বীকৃতি জানালেন।

তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি তথ্যগুলো আমাকে টেলিফোনে জানাতে পারেন কি না। আমি তাঁর টেলিফোন-সাক্ষাৎকার নেওয়ার প্রস্তাব দিই। এমনকি আমি এও বলি যে, যাতে স্পষ্ট রেকর্ড থাকে সে জন্য কথোপকথন রেকর্ড করা হবে। আমাকে ভাড়া করা হয়েছে—এ অভিযোগের কী প্রমাণ তাঁর কাছে আছে, সে কথা আমাকে বলতে এম কে আনোয়ার সাহেব অস্বীকৃতি জানান। আমি বললাম, এটা তো খুব গুরুতর অভিযোগ; এটা আমাদের খতিয়ে দেখা উচিত। তিনি আলাপ চালিয়ে যেতে কিংবা আমার সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি ফোন রেখে দিলেন।

মিনিট দশেক পর এম কে আনোয়ার সাহেব আমাকে ফোন করলেন। আমি বললাম, তাঁর ফোন পেয়ে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি ভেবেছি, তিনি তাঁর মত পাল্টেছেন আর আমাকে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু তাঁর ফোনের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল আমার সঙ্গে প্রথম দফা আলাপের পর তিনি মাঝের ১০ মিনিট কোনো আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছেন। আনোয়ার সাহেব বললেন, তিনি স্পষ্ট করতে চান যে, তিনি যখন সরকারের বিরুদ্ধে একজন বিদেশি সাংবাদিক ‘ভাড়া’ করার অভিযোগ করেন, তখন তিনি কারও নাম উল্লেখ করেননি। যদিও ১৬ মার্চের দ্য ডেইলি স্টার লিখেছে, আনোয়ার সাহেব তাঁর ১৫ মার্চের সংবাদ সম্মেলনে ‘লিফশুলজ’ সম্পর্কেই বলছিলেন, তবু এম কে আনোয়ার আমার কাছে দাবি করলেন, তিনি কারও নাম নির্দিষ্ট করে বলেননি।

আমি আনোয়ার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, আগের দিন, ১৪ তারিখে সুপ্রিম কোর্টে আমার সাক্ষ্য প্রদান আর পরের দিন সরকার এক অনুল্লিখিত সাংবাদিককে ভাড়া করার ব্যাপারে তাঁর দাবি—এই দুইয়ের মধ্যেকার যোগসূত্রটা কি নিতান্তই আকস্মিক? আমি তাঁকে বললাম, বিদেশি সাংবাদিকটি যদি লিফশুলজ না হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি কার কথা বলেছেন? আমি বললাম, বিদেশি সাংবাদিকদের সরকার অর্থ দিচ্ছে, এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালাতে আমি খুবই আগ্রহী। এখন তিনি যদি বলতে না চান যে, আমিই সেই সাংবাদিক, তাহলে ভালো হয় যদি তিনি প্রকাশ করেন যে কে সেই বিদেশি সাংবাদিক। কিন্তু এবারও তিনি আমাকে তা বললেন না। তিনি বেশ কয়েকবার একই কথা বললেন, ‘আমি কারও নাম বলিনি।’ [চলবে]

২১ জুলাই কর্নেল তাহেরের ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আয়োজিত আলোচনা সভায় পঠিত প্রবন্ধ

লরেন্স লিফশুলজ: মার্কিনঅনুসন্ধানীসাংবাদিক।

আরও পড়ুন :