১৯৫৪–৫৫

যুক্তফ্রন্টে বঙ্গবন্ধু

মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কাছে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার অন্যতম মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন শেখ মুজিব। ১০ মে ১৯৫৪
মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কাছে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার অন্যতম মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন শেখ মুজিব। ১০ মে ১৯৫৪

১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই এ কে ফজলুল হক কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি) গঠন করেন। এ কে ফজলুল হককে সভাপতি এবং আবদুল লতিফ বিশ্বাসকে সম্পাদক করে কেএসপি গঠিত হয়।

মুসলিম লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম খেলাফতে রাব্বানী পার্টি গঠন করেন। ১৯৫৩ সালের শেষে কিশোরগঞ্জের মাওলানা আতাহার আলী গঠন করেন নেজামে ইসলাম পার্টি। এ ছাড়া ছিল কংগ্রেস, তফসিলি ফেডারেশন, সোশ্যালিস্ট পার্টি ও গণতন্ত্রী দল। মুসলিম লীগ সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে ১৯৪৮ সালে বেআইনি ঘোষণা করে।

১৯৫৩ সালের ১৪-১৫ নভেম্বর ময়মনসিংহে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন বসে। এ সভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। সরকার ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করে। মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে যুক্তফ্রন্ট গঠনের পক্ষে ছিলেন না। ছাত্রসমাজের চাপে সব বিরোধী দল একত্র হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানী ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুল মনসুর আহমদের প্রণীত ২১ দফায় বিভিন্ন নেতা স্বাক্ষর করেন। ১৯৫৩ সালের ৫ ডিসেম্বর ২১ দফা প্রকাশিত হয়।

২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। যুক্তফ্রন্টের প্রতীক ছিল নৌকা এবং মুসলিম লীগের প্রতীক ছিল হারিকেন।

১৯৫৪ সালের ৭-১২ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মোট আসন ছিল ৩০৯টি। তার মধ্যে ৭২টি হিন্দু ও তফসিলি। ২৩৭টি মুসলমান আসন। ৯টি বাদে সব আসনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে।

পূর্ব বাংলায় ভোটের বিপ্লব হলো। জাতীয়তাবাদের জয় হলো। ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল সরকারিভাবে ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হয়।

শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ আসন থেকে মুসলিম লীগ প্রার্থী ওহিদুজ্জামান ঠাণ্ডা মিয়াকে পরাজিত করে প্রাদেশিক আইনসভার এমএলএ নির্বাচিত হন। গোপালগঞ্জ নির্বাচন সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচনে দেখা গেল ওহিদুজ্জামান সাহেব প্রায় ১০ হাজার ভোটে পরাজিত হয়েছেন। জনসাধারণ আমাকে শুধু ভোটই দেয়নি, প্রায় ৫ হাজার টাকা নজরানা হিসেবে দিয়েছিল নির্বাচন খরচ চালানোর জন্য। আমার ধারণা হয়েছিল, মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালোবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে।’

শেরেবাংলা যুক্তফ্রন্টের নেতা নির্বাচিত হন। মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে যুক্তফ্রন্টে মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল এ কে ফজলুল হক চার সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১৯৫৪ সালের ১৫ মে পূর্ণাঙ্গ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়।

মন্ত্রিসভার সদস্যরা হলেন: এ কে ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপন; আবু হোসেন সরকার অর্থ; আতাউর রহমান খান বেসামরিক সরবরাহ; আবুল মনসুর আহমদ জনস্বাস্থ্য; কফিল উদ্দিন চৌধুরী বিচার ও আইন; সৈয়দ আজিজুল হক শিক্ষা ও রেজিস্ট্রেশন; আবদুস সালাম খান শিল্প ও পূর্ত; শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি, ঋণ, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন; আবদুল লতিফ বিশ্বাস রাজস্ব ও ভূমি সংস্কার; আশরাফ আলী চৌধুরী সড়ক ও গৃহ নির্মাণ; হাশিম উদ্দিন আহমদ বাণিজ্য ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন; রাজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী স্বাস্থ্য ও কারা; ইউসুফ আলী চৌধুরী কৃষি, বন ও পাট এবং মোয়াজ্জেম উদ্দিন হোসেন জমিদারি অধিগ্রহণ।

মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শুরুর আগে অবাঙালিদের ষড়যন্ত্রে আদমজী জুট মিলে দাঙ্গা শুরু হয়। দাঙ্গায় ১ হাজার ৫০০ নিরপরাধ শ্রমিক নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর ভাষ্যে জানা যায়, সামান্য একটা ঘটনা নিয়ে এই দাঙ্গা শুরু হয়। তিনি বলেন, ‘এই দাঙ্গা যে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য এবং দুনিয়াকে নতুন সরকারের অদক্ষতা দেখাবার জন্য বিরাট এক ষড়যন্ত্রের অংশ সে সম্বন্ধে আমার মনে কোনো সন্দেহ নাই। ষড়যন্ত্র করাচি থেকে করা হয়েছে।’

যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও ছুটি পালন, শহীদ মিনার নির্মাণ, বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমিতে রূপান্তর করা হবে।

এ সময় নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে ওই পত্রিকার সাংবাদিক কালাহান লিখেছিলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক বলেছেন, বাংলাকে স্বাধীন করা তাঁর প্রথম কাজ।’ এই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৪ সালের ৩১ মে দেশদ্রোহের অভিযোগে এ কে ফজলুল হকের যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ৯২ক ধারা জারি করেন।

৯২ক ধারা জারির পর শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ তাঁর বাসায় যায়। সে সময় তিনি বাসায় ছিলেন না। তিনি বাসায় এসে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইয়াহিয়া খান চৌধুরীকে ফোন করে বলেন, ‘আমার বাড়িতে পুলিশ এসেছিল, বোধ হয় আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য। আমি এখন ঘরেই আছি, গাড়ি পাঠিয়ে দেন।’ পুলিশ এলে তাদের গাড়িতে তিনি ঢাকা জেলে চলে যান।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানী দেশের বাইরে, শেখ মুজিব কারাগারে, কোনো প্রতিবাদ হলো না। ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝতে পারল যতই হইচই বাঙালিরা করুক না কেন, তাদের দাবিয়ে রাখতে কষ্ট হবে না। বন্দুক, লাঠি দেখলে তারা গর্তে ঢুকবে। এ সময় যদি বাধা পেত, তবে হাজারবার চিন্তা করত বাঙালিদের ওপর ভবিষ্যতে অত্যাচার করতে। যুক্তফ্রন্টের রাজনীতির কাপুরুষতা দেখে তিনি (বঙ্গবন্ধু) তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘এই দিন থেকে বাঙালীদের দুঃখের দিন শুরু হলো। অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কাজ করতে নামতে নেই, তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশ বেশি হয়।’

১৯৫৪ সালের ২৩ অক্টোবর গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ পাকিস্তান গণপরিষদ ভেঙে দেন। বগুড়ার মোহাম্মদ আলী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চেষ্টায় শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর মুক্তি লাভ করেন।

প্রায় ৭ মাস বন্দী জীবন যাপন করে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হন। তাঁর পরিবার মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবন ত্যাগ করে একটি ভাড়া বাড়িতে বাস করছিল। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দলের নির্দেশে শেখ মুজিবুর রহমান করাচি গমন করেন। দলের সঙ্গে আলাপ না করে সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ায় তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন:

আমি তাঁর (সোহরাওয়ার্দী) সঙ্গে বেয়াদবি করে বসতে পারি। পরের দিন সকাল নয়টায় আমি হোটেল মেট্রোপোলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন।…তিনি আমার দিকে চেয়ে বললেন, “বুঝেছি, আর বলতে হবে না, বেলা তিনটায় এসো, অনেক কথা আছে।”

আমি বেলা তিনটায় গিয়ে দেখি, তিনি একলা শুয়ে বিশ্রাম করছেন।…আমি তাঁর কাছে বসলাম। তিনি আলাপ করতে আরম্ভ করলেন। অনেকক্ষণ আলাপ করলেন, তার সারাংশ হলো গোলাম মোহাম্মদ জানিয়ে দিয়েছেন যে মন্ত্রিসভায় যোগ না দিলে তিনি মিলিটারিকে শাসনভার দিয়ে দেবেন। আমি বললাম, পূর্ব বাংলায় গিয়ে সবার সঙ্গে পরামর্শ করে অন্য কাউকেও তো মন্ত্রিত্ব দিতে পারতেন। আমার মনে হয়, আপনাকে ট্র্যাপ করেছে। ফল খুব ভালো হবে না, কিছুই করতে পারবেন না। যে জনপ্রিয়তা আপনি অর্জন করেছিলেন, তা শেষ করতে চলেছেন।

>২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। যুক্তফ্রন্টের প্রতীক ছিল নৌকা এবং মুসলিম লীগের প্রতীক ছিল হারিকেন। ১৯৫৪ সালের ৭-১২ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মোট আসন ছিল ৩০৯টি। তার মধ্যে ৭২টি হিন্দু ও তফসিলি। ২৩৭টি মুসলমান আসন। ৯টি বাদে সব আসনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে।

‘সোহরাওয়ার্দী কয়েকটি শর্তে মন্ত্রিসভায় যোগদানে সম্মত হন। ১৯৫৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি আইনমন্ত্রী হিসেবে মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। সোহরাওয়ার্দীর নিকট দেশ বড় ছিল, তাই মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন। মাওলানা ভাসানী ইউরোপ থেকে ফিরে কলকাতায় একটি হোটেলে অবস্থান করছিলেন। তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ নেই। যুক্তফ্রন্ট নিষ্ক্রিয়প্রায়। এদিকে গোলাম মুহাম্মদ সোহরাওয়ার্দীকে জিজ্ঞেস না করে কেএসপি নেতা আবু হোসেন সরকারকে কেন্দ্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। গভর্নর মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা মাওলানা ভাসানীর দেশে ফিরে আসার প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সোহরাওয়ার্দীর চেষ্টায় ভাসানী ১৯৫৫ সালের ২৬ এপ্রিল কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন।’

শেরেবাংলার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব

শেরেবাংলার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান নিম্নলিখিত বিবরণ দেন:

হক সাহেব লাহোরে এক খবরের কাগজের প্রতিনিধির কাছে বলেছেন, সোহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্টের কেউই নন, আমি তো নেতা। অথচ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ যুক্তফ্রন্টের। হক সাহেব কেএসপি দলের নেতা। কেএসপি, নেজামে ইসলাম মিলেও আওয়ামী লীগের সমান হবে না। সোহরাওয়ার্দী সাহেব আওয়ামী লীগের নেতা, হক সাহেব এ কথা কী করে বলতে পারেন!...কেএসপির নেতারা তখন অনেকেই করাচিতে, কেউই শহীদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আসেন না। আমার সঙ্গে কেএসপির নেতাদের দু–একজনের দেখা হলে আমি তাঁদের জানালাম, আপনারা অনেক কিছুই করেছেন। কথা ছিল, শহীদ সাহেবকে আপনারা পাকিস্তানের নেতা মানবেন, আর আমরা হক সাহেবকে পূর্ব বাংলার নেতা মানব, এখন আপনারা করাচি এসে মুসলিম লীগ নেতা বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে নেতা মানছেন এবং তাঁকেই সমর্থন করছেন। শহীদ সাহেব যাতে প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন, তার চেষ্টা করছেন। আমরাও বাধ্য হব হক সাহেবকে নেতা না মানতে, দরকার হলে যুক্তফ্রন্টের সভায় অনাস্থা প্রস্তাব দেব তাঁর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। আমরা হক সাহেবকে ক্ষমতা দিইনি যে তিনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে মোহাম্মদ আলী সাহেবকে সমর্থন দেবেন এবং মুসলিম লীগ নেতাকে নেতা মানবেন।…আমি শহীদ সাহেবকে বললাম, “যখন হক সাহেব প্রকাশ্যে বলে দিয়েছেন আপনি যুক্তফ্রন্টের কেউ–ই নন, তখন বাধ্য হয়ে প্রমাণ করতে হবে আপনিও যুক্তফ্রন্টের কেউ। কেএসপি ও নেজামে ইসলাম যুক্তফ্রন্টে থাকে থাকুক। আমরা অনাস্থা দেব হক সাহেবের বিরুদ্ধে। তাতে অন্ততপক্ষে আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে তো কথা বলতে পারবেন এবং আওয়ামী লীগ পার্টি পূর্ব বাংলার আইনসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠ। আওয়ামী লীগ ছাড়া কারও পূর্ব বাংলায় সরকার চালানোর ক্ষমতা নেই।”…

আমি ঢাকায় ফিরে এসে আতাউর রহমান সাহেব, আবুল মনসুর আহমদ ও মানিক ভাইকে নিয়ে বৈঠকে বসলাম এবং সব কথা তাঁদের বললাম।…শহীদ সাহেবের মতামতও জানালাম। শহীদ সাহেব এন এম খান চিফ সেক্রেটারি সাহেবকে টেলিফোন করেছেন রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে। অনেক কর্মীই আস্তে আস্তে মুক্তি পেতে লাগলেন। কেএসপি দলের নেতারা রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য একটা কথাও বলেননি। কারণ, তাঁদের দলের কেউই জেলে নেই।…আতাউর রহমান সাহেব, আবুল মনসুর আহমদ, মানিক ভাই ও আমি অনেকক্ষণ আলাপ-আলোচনা করলাম। হক সাহেবের নেতৃত্বে অনাস্থা দেওয়া হবে কি হবে না এ বিষয়ে। হক সাহেবের চেয়েও তাঁর কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গই বেশি তৎপর মুসলিম লীগের সঙ্গে কোনো নীতি, আদর্শ ছাড়াই মিটমাট করার। কোথায় গেল একুশ দফা, আর কোথায় গেল জনতার রায়। তিনজনই প্রথমে একটু একটু অনিচ্ছা প্রকাশ করছিলেন। অনাস্থা সম্বন্ধে কোনো আপত্তি নেই, তবে পারা যাবে কি যাবে না, এ প্রশ্ন তুলেছিলেন। আমি বললাম, না পারার কোনো কারণ নেই। নীতি বলেও তো একটা কথা আছে। শেষ পর্যন্ত সবাই রাজি হলে আমি ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহ্বান করলাম। ওয়ার্কিং কমিটির প্রায় সব সদস্যই একমত, কেবল সালাম সাহেব ও হাশিমউদ্দিন সাহেব একমত হতে পারলেন না। তবে এ কথা জানালেন যে তাঁরা ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই মানতে বাধ্য।

আমি ও আতাউর রহমান সাহেব বের হয়ে পড়লাম এমএলএদের দস্তখত নিতে। সতেরো দফা চার্জ গঠন করলাম। হক সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে কে অনাস্থা প্রস্তাব প্রথমে পেশ করবে, সে প্রশ্ন হলো। অনেকেই আপত্তি করতে লাগলেন, আমার নিজেরও লজ্জা করতে লাগল। তাঁকে তো আমিও সম্মান ও ভক্তি করি। কিন্তু এখন কয়েকজন তথাকথিত নেতা তাঁকে ঘিরে রেখেছেন। তাঁকে তাঁদের কাছ থেকে শত চেষ্টা করেও বের করতে পারলাম না। তাঁদের অনেকেই নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে মুসলিম লীগ ত্যাগ করে এসেই ক্ষমতার লড়াইয়ে পরাজিত হন। ঠিক হলো আমিই প্রস্তাব আনব আর আবদুল গণি বার অ্যাট ল সমর্থন করবেন। আমরা তাঁর কাছে সভা ডেকে অনাস্থা প্রস্তাব মোকাবিলা করার জন্য অনুরোধ করলাম। তিনিও সভা ডাকতে রাজি হলেন। আমরা আওয়ামী লীগের প্রায় ১১৩ জন সদস্যের দস্তখত নিলাম। তাতেই আমাদের হয়ে গেল।

আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আতাউর রহমান, মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, শেখ মুজিবুর রহমান শেরেবাংলার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। উভয় দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দাবি করে। পরিশেষে ১৯৫৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আইন পরিষদে অনাস্থার পক্ষে–বিপক্ষে ভোট গ্রহণ করা হয়। এ কে ফজলুল হক ১৯৯ জন এবং আতাউর রহমান খান ১০৫ জন সদস্যের সমর্থন পান। অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল হলো। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গেল। যুক্তফ্রন্ট ভাঙার জন্য শেখ মুজিবকে বেশি দায়ী করা হয়। প্রকৃতপক্ষে বাংলার নেতৃবৃন্দ কেন্দ্রীয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। কেন্দ্রের ষড়যন্ত্রের ফলে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়। ১৯৫৫ সালের ৩ জুন ৯২ক ধারা প্রত্যাহার করা হয়। কেএসপি নেতা আবু হোসেন সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

সংক্ষেপিত ও ঈষৎ পরিমার্জিত
সূত্র: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভাস্বর প্রকাশনী, ২০১৭
সিরাজ উদ্‌দীন আহমেদ: বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গত বছর ‘ঐ মহামানব আসে’ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল প্রথম আলো। ক্রোড়পত্রের সেই লেখাগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরা হলো।