শিক্ষাজীবনে অনেক অসাধারণ শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছি। তবে তাঁদের মধ্যে আলাদা করে বলতে গেলে অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমানের কথা বলতে হয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে আমার শুধু সরাসরি শিক্ষকই না, গবেষণা তত্ত্বাবধায়কও ছিলেন। তাই তাঁর একান্ত সান্নিধ্য আমি পেয়েছি। তাঁকে কাছ থেকে দেখার, তাঁর কাছ থেকে শেখার সুযোগ পেয়েছি। তিনি কত বড় মাপের শিক্ষক ছিলেন, কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন, তা তাঁকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেননি, তাঁরা বুঝতে পারবেন না। তাঁর ক্লাস যাঁরা করেছেন, তাঁরা তাঁকে চেনেন কিছু অংশ। যাঁরা ক্লাসের বাইরে তাঁর চালচলন, আচার-ব্যবহার এবং অন্যের সঙ্গে কথোপকথন দেখেছেন, শুনেছেন, তাঁরা জানেন শিক্ষা শুধু ক্লাসে দেওয়ার বিষয় না, বরং ক্লাসের বাইরের শিক্ষাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্যই তিনি শিক্ষকদেরও শিক্ষক হতে পেরেছিলেন।
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অন্যতম সেরা অর্জন ড. মুস্তাফিজুর রহমানের একান্ত সান্নিধ্য পাওয়া। আমার আজকের আমির পেছনে, একজন মানবিক সজ্জন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। পিতৃতুল্য সদাহাস্যোজ্জ্বল ইতিবাচক এ মানুষটির কাছে যিনিই গেছেন, কাউকে তিনি বঞ্চিত করেননি। তাঁর হতাশা ভুলিয়ে দিয়ে আশার বাণী শুনিয়েছেন, আশাবাদী করে তুলেছেন।
একদিন ল্যাবরেটরিতে কাজ করছিলাম। স্যার তাঁর রুম থেকে ল্যাবরেটরির মধ্য দিয়ে বাইরে বের হচ্ছিলেন। কিন্তু মাঝখানে একটি টেবিল থাকায় এবং তাঁর একপাশে টুলে বসে আমি কাজ করতে থাকায় স্যার অপর পাশের সামান্য ফাঁকা জায়গা দিয়ে বের হতে চেষ্টা করছিলেন। আমি দেখে তৎক্ষণাৎ টুলে ছেড়ে স্যারকে যাওয়ার রাস্তা করে দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু স্যার আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘যখন কাজ করবা তখন মনে করবা তুমিই বস।’ এ কথা বলে তিনি পায়ের আঙুলে ভর করে সেই সামান্য ফাঁকা জায়গাটুকু দিতেই বের হয়ে গেলেন। স্যারের সেই কথা আমি কখনোই ভুলিনি।
আমার প্রথম চাকরি ছিল একটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে। চাকরি শুরুর মাস তিনেক পরই যেদিন প্রথম HPLC মেশিনে কাজ করতে গেলাম, দেখলাম সেদিনের প্রডাক্টটির একটি পরীক্ষার ফলাফল রেফারেন্সের সঙ্গে মিলছে না। আমি সর্বোচ্চ সতর্কতা দিয়েই আমার কাজ করেছি, আমার কাজে ভুল হয়নি বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। ফলে তা যাচাইয়ের জন্য সিনিয়র সহকর্মীদের দায়িত্ব দেওয়া হলো, ম্যানেজারকে জানানো হলো। শেষ পর্যন্ত ফলাফল বের হলো যে প্রডাক্টেই সমস্যা, আমার কাজে কোনো ভুল ছিল না। শেষে সেই প্রডাক্টটির চালানই বাতিল করা হলো। একজন নবীন কর্মকর্তার জন্য তা এক অসাধারণ অনুভূতি। সেই দিনের সেই আত্মবিশ্বাসই নিজের পক্ষে ফলাফল এনে দিয়েছিল। হয়তো এর বীজ প্রোথিত হয়েছিল মুস্তাফিজ স্যারের সেই দিনের সেই কথায়। গত ৫ জুন আমাদের সেই প্রিয় মুস্তাফিজ স্যার যুক্তরাজ্যে কোলন ক্যানসারের চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। তবে তাঁর শিক্ষা মরে যায়নি। অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর মাঝেই তিনি বেঁচে আছেন। শিক্ষক দিবসে স্যারের জন্য রইল অসীম শ্রদ্ধা।
লেখক: সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত