ছোটবেলা থেকে মেয়েদের এড়িয়ে চলতেন গোলাম রব্বানী ছোটন। বিয়ের প্রতিও ছিল রাজ্যের অনীহা! অথচ সেই ছোটনের হাত ধরেই একটু একটু করে বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবলের রং বদলাচ্ছে। বদলে গেছেন নিজেও। একটার পর একটা টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের মেয়েরা চ্যাম্পিয়ন হয়, ঘোরলাগা বিস্ময়ে ট্রফিগুলোর দিকে চেয়ে আনমনে ছোটন বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমারও বিশ্বাস হয় না, মেয়েদের ফুটবল কোথায় চলে গেছে!’
‘আপনি তো মেয়েদের দলের কোচ!’ পথ চলতে কথাগুলো কানে কেমন যেন বেসুরো লাগত। বছর দশেক আগে এই একই কথা এখন গর্বের সপ্তসুরে কানে বাজে। মেয়েদের ফুটবলে বাংলাদেশের যত রূপকথা, সব তো কোচ ছোটনের হাতেই রচিত।
জাতীয় কিংবা বয়সভিত্তিক—বাংলাদেশের মেয়েদের সব রকমের ফুটবলে একের পর এক সাফল্য আসছে। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ টানা দুবার চ্যাম্পিয়ন। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টের বাছাইপর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে। সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ও অনূর্ধ্ব-১৮ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। দুই বছর আগে ভারতে প্রথমবারের মতো সিনিয়র সাফের ফাইনালে সাবিনা-কৃষ্ণাদের ওঠাও এই কোচ ছোটনের অধীনে।
স্বপ্না, মারিয়া, আঁখিদের খেলার সৌন্দর্য মনরাঙানো। অথচ ২০০৫ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ কোরিয়ায় যেবার এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম খেলতে যায় বাংলাদেশ, গ্রুপ পর্বে জাপানের কাছে হেরেছিল ২৪-০ গোলে! সেই বাংলাদেশ দল উঠে গেছে অন্য উচ্চতায়। দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, আসিয়ান অঞ্চল, এশিয়ার মধ্যাঞ্চলের দলগুলোকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে ভয় পায় না তারা। ভুটানে গত ৭ অক্টোবর শেষ হওয়া সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ টুর্নামেন্টে পাকিস্তানের জালে যখন ১৭ গোল দেয় বাংলাদেশ, চায়ের কাপে ঝড় ওঠে মারিয়াদের নিয়ে। সসম্ভ্রমে উচ্চারিত হয় কোচ ছোটনের নাম।
ফুটবল যদি খেলতেই হয়, ফুটবলের মতো খেলতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। ২০০৯ সালের জুনে ফুটবল ফেডারেশনের ওই সময়ের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর শহিদুর রহমান যেদিন মেয়েদের কোচ হওয়ার প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন, একটু অবাকই হয়েছিলেন ছোটন। তখন মেয়েরা খেলত ফিফা আর এএফসির বাধ্যবাধকতায়। অভিভাবকেরা মেয়েদের ফুটবল খেলতে পাঠাতে চাইতেন না। বাফুফের কৃত্রিম টার্ফে বসে শুরুর ওই দিনগুলোর কথা মনে করে বলছিলেন, ‘পথচলা মোটেও সহজ ছিল না। সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা ছিল প্রতিকূলে। অভিভাবকদের ছিল চরম অনীহা। বলা যায় ৯৯ ভাগ পরিবেশ আমাদের পক্ষে ছিল না।’
তারপরও যাঁরা ফুটবলকে ভালোবেসে খেলাটা আঁকড়ে ধরে ছিলেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানান ছোটন, ‘আমি ধন্যবাদ দেব ওই মেয়েদের, যারা সাহস দেখিয়ে এখানে এগিয়ে এসেছে। ওদের স্যালুট। ওরা শুরু না করলে মেয়েদের ফুটবল এতদূর আসতই না।’
ফুটবল যদি খেলতেই হয়, ফুটবলের মতো খেলতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।
তখন ভলিবল, কাবাডি, হ্যান্ডবল থেকে খেলোয়াড় নিয়ে দল গড়তে হতো। মাত্র ৪০ জন ফুটবলার নিয়ে শুরু ছোটনের। শুধু যশোর, নারায়ণগঞ্জ, রাঙামাটি আর সাতক্ষীরা থেকে মেয়েরা আসত ফুটবল খেলতে। ঠিকমতো দৌড়াতেই পারত না মেয়েরা। ছোটনই ওই সময়টার নাম দিয়েছিলেন ‘হাঁটা-ফুটবলের যুগ’। নতুন করে নির্মাণ শুরু করেন দলটাকে। কতটা পরিশ্রম করতেন, তা বলতে দ্বিধাহীন ছোটন, ‘তখন আমি মেয়েদের বললাম, ফুটবল যদি খেলতেই হয়, ফুটবলের মতো খেলতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। পেশাদার ফুটবলারের যে গুণাবলি, তার সব আয়ত্ত করতে হবে।’
মেয়েদের ফুটবলের সবচেয়ে বড় অভ্যুত্থানটা ঘটেছে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে। এই একটা টুর্নামেন্ট বাংলাদেশের মেয়েদের পথ চলতে এগিয়ে যাওয়ায় কতখানি সাহায্য করেছে সেটা বললেন ছোটন, ‘এই টুর্নামেন্টে খেলা স্কুলগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক। ওখান থেকে ভালো ভালো ফুটবলার বেরিয়ে আসছে। এখন যারা আসছে তারা ফুটবলের স্কিলে উন্নতি করেই আসছে। এটা আমাদের জন্য বাড়তি সুবিধার।’
সারা দেশ থেকে বাছাই করা এই মেয়েদেরই বাফুফে ভবনে দীর্ঘমেয়াদি আবাসিক ক্যাম্পে রেখেছে ফেডারেশন। দুই বেলা প্রতিদিন ছোটন অনুশীলন করাচ্ছেন। একটু একটু করে বদলে গেছে মণিকা, ঋতুপর্ণাদের খেলার ধরন। তহুরা, সাজেদাদের ড্রিবলিং, গতি, পাসিং, শুটিং, ম্যাচ পরিস্থিতি পড়ার সামর্থ্য—সবই শেখাচ্ছেন কোচ। এশিয়ার দেশগুলো যখন বয়সভিত্তিক ফুটবলে বাংলাদেশের মেয়েদের কাছে হারছে, তখন নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করেন ছোটন, ‘সত্যিই কি সাফল্য এভাবে ধরা দিচ্ছে? ২০০৯ সালে যখন দায়িত্ব নিই, তখন ভারত, নেপালের সঙ্গে খেলতে গেলে ভাবতাম, কত কম গোলে হারা যায়। পুরোপুরি ধন্যবাদ দেব এই মেয়েদের। কঠোর অনুশীলন আর একাগ্রতায় তারা নিজেদের উপযোগী করে নিতে পেরেছে। এজন্যই সাফল্য আসছে।’
ছোটনের কোচিং পেশায় আসার গল্পটা বেশ মজার। ১৯৯৩ সাল। ওয়ারী ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগে খেলেন। থাকেন মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে। এলাকার বড় ভাইয়েরা এসে অনুরোধ করলেন পাইওনিয়ারে খেলা টিঅ্যান্ডটি ক্লাবের দায়িত্ব নিতে। ছোটন না করতে পারেননি। একই সঙ্গে ফুটবলার, আবার কোচ হিসেবেও অভিষেক হয়ে গেল তাঁর।
টাঙ্গাইলের গোপালপুরের বর্ণি গ্রামে পৈতৃক বাড়ি হলেও ছোটনের জন্ম বগুড়ায়। বাবা ফরহাদ হোসেন তালুকদার সরকারি চাকরি করতেন। বগুড়ার ঠনঠনিয়ায় মালতিনগর সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারের মাঠে ফুটবল খেলে বেড়ে ওঠা ছোটনের। দশ ভাই-বোনের সংসারে চতুর্থ ছেলে ছোটনকে একটু বেশিই আদর করতেন বাবা। পিঠাপিঠি ছোট ভাই গোলাম রায়হান পাবনের সঙ্গে সারাক্ষণ চলত ফুটবল নিয়ে খুনসুটি।
সাংগঠনিক দক্ষতাটা অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই ছোটনের। ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলেছেন শৈশবে। বগুড়ার মিউনিসিপাল স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় আন্তস্কুল ফুটবলে শুরু। এলাকার ক্লাবগুলোর জন্য দল গড়া, ঢাকা থেকে ক্রিকেটার নিয়ে দলকে জেতানো—এগুলো ছিল ছোটনের নিত্যদিনের কাজ। নিজের কাজটা সব সময় ভীষণ গুরুত্ব দিয়ে করেন। আরামবাগ ক্লাবে খেলার সময় ঠোঁট কেটে ৩৬টি সেলাই লেগেছিল। ওই অবস্থায়ও নাকি খেলার চেষ্টা করতেন!
চার বছর আগে বিয়ে করেছেন। এখনো সন্তান-সন্ততি আসেনি। মারিয়া-মণিকাদের নিজের সন্তানের চেয়েই বেশি মনে হয় ছোটনের, ‘আমার ছেলে-মেয়ে নেই। কিন্তু আমার মনে হয় এরাই আমার মেয়ে।’
বাংলাদেশকে নিয়ে ছোটনের স্বপ্ন এখন দূর, ‘২০১৪ সালে আমরা ছিলাম অনূর্ধ্ব-১৪ পর্যায়ে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। ২০১৮ সালেও সেরা। মেয়েরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ অনেক দূরে যাবে।’
একনজরে
নাম: গোলাম রব্বানী
জন্ম: ২ জুলাই, ১৯৬৮
পজিশন: স্টপার
ফুটবল ক্যারিয়ার: ১৯৮৩-২০০২ সাল
ক্লাব: ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুল, আরামবাগ, ওয়ারী, বিআরটিসি, মোহামেডান
কোচিং ক্যারিয়ার: ১৯৯৯ থেকে
কোচ হিসেবে সাফল্য
চ্যাম্পিয়ন: এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা (২০১৫ ও ২০১৬)
চ্যাম্পিয়ন: এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাইপর্ব (২০১৬)
চ্যাম্পিয়ন: সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ (২০১৭)
রানার্সআপ: সিনিয়র সাফ (২০১৭)
চ্যাম্পিয়ন: এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাইপর্ব, প্রথম রাউন্ড (২০১৮)
রানার্সআপ: সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ (২০১৮)
চ্যাম্পিয়ন: সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ (২০১৮)
চ্যাম্পিয়ন: আন্তর্জাতিক জকি কাপ (২০১৮)
বদিউজ্জামান, প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক