২০০০ সালের কথা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৮ বছরের এক প্রাণবন্ত তরুণী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ডিআইসি নামের এক ভীষণ জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে হতে সবার চোখের সামনেই মারা গেলেন। এই অভাগা দেশে এ তো আর নতুন কিছু নয়। প্রতিবছর সাড়ে ৫ হাজার নারী এখানে মারা যান প্রসবকালীন জটিলতায়, আর এর ৩১ শতাংশের কারণই হলো প্রসবকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। চিকিৎসক হিসেবে এহেন দৃশ্য তাই নতুন বা অপরিচিত নয় ডা. সাঈবা আক্তারের কাছে। কিন্তু সাঈবার সে রাতে একটুও ঘুম হয়নি। সারা রাত চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ওই তরুণীর মুখ, এ পৃথিবীর রং–রূপ–রস উপভোগ করার আগেই যাঁর জীবনপ্রদীপ অকালে নিভে গেল।
প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য এর আগে বিদেশ থেকে একটি বেলুন নিয়ে এসেছিলেন সাঈবা, প্রয়োগ করেছিলেন অনেক নারীর ওপর সফলভাবে। বেলুনটির দাম ৩০০ ডলারের বেশি, সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। তাই যদিও বিদেশে এটা ‘ওয়ান টাইম ইউজ’ হিসেবে ব্যবহৃত, খুব দরকার পড়লে সাঈবা সেটা জীবাণুমুক্ত করে একের পর এক নারীর ওপর ব্যবহার করছিলেন। কিন্তু এর কয়েক দিন পর সেই মহা মূল্যবান বেলুনটিও গেল হারিয়ে। এ ঘটনায় সাঈবা হতাশ ও বিমর্ষ হয়েছিলেন খুব। আহা, বেলুনটা থাকলে আজ এই অল্পবয়সী মেয়েটিকে হয়তো বাঁচানো যেত। এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎই একটা আইডিয়া এল তাঁর মাথায়।
রাস্তাঘাটে ছোট শিশুদের কনডম ফুলিয়ে খেলা করতে দেখেছেন আগে; দেখে বিব্রত হয়েছেন, ক্রুদ্ধও হয়েছেন কখনো কখনো। এখন এই সাধারণ দুষ্টুমি খেলাটার কথা ভেবে উজ্জ্বল হয়ে উঠল এই চিকিৎসকের মুখ। পরদিন একটা নতুন কেনা কনডমের ভেতর স্যালাইন ভরে দেখলেন তিনি, অনেকখানি ফোলানোর পরও সেটা ফাটল না। এবার একটা ক্যাথেটারের সঙ্গে আটকে নিলেন ওটা। বাহ্, একেবারে সেই বেলুনের মতোই মনে হচ্ছে এবার। সেদিনই একটি মৃত শিশুকে জন্ম দিয়ে ভয়াবহ রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে আরেক নারীর। রক্তপাত থামানোর সব রকমের চেষ্টা বিফল হলে ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকেরা শেষ পর্যন্ত মেয়েটির জরায়ু কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ডা. সাঈবা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘একটু থামো। একবার চেষ্টা করে দেখি।’ সেই মেয়েটির ওপর প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করা হলো সাঈবা’স মেথড। ক্যাথেটারের আগায় লাগানো কনডমটি জরায়ুর ভেতর ধীরে ধীরে স্যালাইন দিয়ে ফোলানো হলো। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মাথায় বন্ধ হলো রক্তক্ষরণ। আনন্দে আত্মহারা তখন সবাই। পরপর বেশ কয়েকজন নারীর ওপর প্রয়োগ করা হলো এই পদ্ধতি। সফলতাও মিলল। ডা. সাঈবা ও তাঁর দল এবার এই পদ্ধতি নিয়ে শুরু করল প্রায়োগিক গবেষণা। ২০০১ সালের জুলাই থেকে ২০০২–এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রসবকালীন রক্তক্ষরণে আক্রান্ত রোগীদের ওপর চলল এই গবেষণা।
২০০৩ সালে গবেষণার ফলাফল মেডিসিন অনলাইন জার্নালে (মেডস্কেপ) প্রকাশিত হলো। রীতিমতো হইচই পড়ে গেছে তত দিনে। ২০০৪–এ ব্যাংককে প্রসবকালীন রক্তক্ষরণের ওপর একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালায় বিষয়টি নিয়ে বলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলো ডা. সাঈবাকে। তিনি সেখানে দেখালেন কীভাবে সামান্য একটা পদ্ধতি দিয়ে এই দরিদ্র নারীদের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। আর এতে তাঁর খরচ পড়েছে ১০০ টাকার কম!
এর পরের ইতিহাস অন্য রকম। এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার প্রসূতি–মৃত্যু ঠেকাতে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে সাঈবার আবিষ্কৃত এই পদ্ধতি। অনেক দেশে এটা সরকারি স্বাস্থ্য কর্মসূচির অংশ হিসেবে গৃহীত।
বাংলাদেশের সাঈবা আক্তারের উদ্ভাবিত এই সামান্য ও সহজ পদ্ধতি বাঁচিয়ে দিচ্ছে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের হাজার হাজার নারীর জীবন। তাঁর উদ্ভাবিত এই ব্যবস্থা সারা বিশ্বে খ্যাত হয়েছে ‘সাঈবাস মেথড’ নামে।
কয়েক দিন আগে সাঈবাস মেথডের উদ্ভাবক অধ্যাপক ডা. সাঈবা আক্তারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল তাঁর চেম্বারে বসে। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি গড়ে তুলেছেন মামস ইনস্টিটিউট অব ফিস্টুলা অ্যান্ড উইমেনস হেলথ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বিলম্বিত প্রসবের একটা জটিলতা হলো ফিস্টুলা, যার ফলে একজন নারীর যোনিপথ, প্রস্রাব ও মল ত্যাগের পথ মিলেমিশে একাকার হয়ে পড়ে। তারপর শুরু হয় দুর্বিষহ এক জীবন। এই দুর্ভাগা নারীরা অচ্ছুত হয়ে পড়েন সংসারে। তাই সবাই ঘৃণা করতে শুরু করে এ ধরনের রোগীকে।
একবার এক নারী সাঈবাকে জানিয়ে ছিলেন যে বাড়িতে তাঁকে থাকতে দেওয়া হয় গোয়ালঘরে, গরু–বাছুরের সঙ্গে। কেননা সারাক্ষণ তাঁর কাপড় ও শরীরে লেগে থাকে প্রস্রাব–পায়খানার দুর্গন্ধ।
আরেকবার এ রকম এক নারী হাসপাতালে ছুরি দিয়ে নিজের গলা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। ফিস্টুলায় আক্রান্ত নারীদের জীবনের গল্পগুলো এমনই করুণ ও মর্মন্তুদ।
এই অসহায় ও নিগৃহীত নারীদের জন্য মামস ইনস্টিটিউট অব ফিস্টুলা অ্যান্ড উইমেনস হেলথ নামের প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলতে পেরে আনন্দিত ডা. সাঈবা। এখানে দরিদ্র নারীদের ফিস্টুলা অস্ত্রোপচার করা হয় বিনা মূল্যে। এর–ওর দানে, নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে আর একদল চিকিৎসক, সার্জন, অ্যানেসথেসিস্টসহ সবার বিনামূল্যে ও পরিশ্রমে বর্তমানে চলছে প্রতিষ্ঠানটির কাজ। সাঈবা এখন স্বপ্ন দেখেন এই প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘ মেয়াদে দাঁড় করানোর। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে এ দেশের কত নারী যে কত ভয়ংকর পরিণতি বরণ করে নিতে বাধ্য হন, আর তারপর আবার তাঁকেই এই পরিণতির জন্য দোষারোপ করা হয়, নিগ্রহ করা হয়—এই বিষয়টি মেনে নিতে পারেন না তিনি। দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, সম্পদের অসমবণ্টন আর নারীর প্রতি অবহেলা ও অবজ্ঞাসূচক মনোভাব কমাতে না পারলে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ হবে না—এমনটাই মনে করেন সাঈবা আক্তার। আর এই পরিস্থিতির উত্তরণে চাই সমাজের সব শ্রেণির সচেতনতা ও সহযোগিতা। সাঈবা প্রত্যাশা করেন, একদিন নিশ্চয়ই এ দেশে প্রত্যেক নারীর প্রসব নিরাপদ ও জটিলতাহীন হবে, নতুন প্রজন্ম উপহার দিতে গিয়ে কোনো নারীর জীবন আর দুর্বিষহ হয়ে উঠবে না।
এই চিকিৎসকের চেম্বার থেকে যখন ফিরে আসব, সেই মুহূর্তে সাঈবা বললেন চূড়ান্ত কথাটি, এবং এটি তাঁর শেষ কথাও, ‘আমার বা আমাদের প্রাপ্তি ও সাফল্যের চেয়ে আমার নিজের কাছে যেটা বেশি আনন্দের ব্যাপার তা হলো, খুব সহজ আর সাশ্রয়ী এই পদ্ধতি আজ কেবল বাংলাদেশের নয়, তৃতীয় বিশ্বের কোটি কোটি অন্তঃসত্ত্বা নারীর অকালমৃত্যু প্রতিরাধ করছে। এটাই সবচেয়ে বড় সার্থকতা।’
একনজরে
১৯৭৫: এমবিবিএস, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
২০০০: সাঈবা মেথড আবিষ্কার
২০০৯: ফিগোর গাইডলাইনে সাঈবা মেথড
২০১১: যুক্তরাজ্যের রয়েল কলেজ অব অবসটেট্রিকস অ্যান্ড গাইনোকলজিস্টসের সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ
২০১২: নাইস গাইডলাইনে সাঈবা মেথড
২০১৩: সাঈবা মেথডের পেটেন্ট নিবন্ধন
সাঈবা মেথড অনুসরণকারী দেশ
ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া, দক্ষিণ সুদান, সিয়েরালিওন, ঘানা, তানজানিয়া, সেনেগাল, উগান্ডা, জাম্বিয়া, পেরু, হন্ডুরাস, ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব তিমুর
জানা যাবে, দেখা যাবে
উইকিপিডিয়া, ইউটিউব (সাঈবাস মেথড)
তানজিনা হোসেন, চিকিৎসক