একবিংশ শতাব্দীতে নারী শুধু বধূ, মাতা, কন্যা নয়; পরিবার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে নারীও অংশীদার—পুরুষের পাশাপাশি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারিগর।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রেই বাংলাদেশের নারীর সংগ্রামী পথচলার আখ্যান। তবে নব্বইয়ের দশকের পর থেকে নারীর অগ্রযাত্রা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হতে থাকে। দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের ধারার সূচনাই এর বড় কারণ।
এ সময়কালে নারীর অগ্রযাত্রার নানাবিধ দৃশ্য দেখেছি। নারীর হাত ধরে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির যাত্রা শুরু হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যতই আলোচনা–সমালোচনা হোক, এর সুযোগ–সুবিধা বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীকে এক মর্যাদার অবস্থানে এনে দিয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জনেও সহায়ক হয়েছিল।
অগ্রযাত্রার কথা বলতে গেলে শিক্ষায় নারী, বিশেষ করে মেয়েশিশুর অংশগ্রহণের বিষয়টি উঠে আসে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের আগেই আমরা প্রাথমিকে ছেলে-মেয়ের সমতা অর্জন করেছি। মাধ্যমিকেও মেয়েরা এগিয়ে গেছে। নারী শিক্ষকের হারও বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। শিক্ষা প্রশাসনেও এখন অনেক নারী কর্মরত আছেন।
দেশে মাতৃমৃত্যু হ্রাসে মায়েদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। সরকারের ইতিবাচক নীতিমালা ছিল, সহায়ক হয়েছে। মায়েরা উজ্জীবিত, অনুপ্রাণিত হয়ে শিশুদের টিকাদান কর্মসূচিতে যোগদান করেছেন, তাই এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অর্জন আজ বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে।
আর্থসামাজিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় যেখানে আমরা সাধারণত নারীকে দেখে অভ্যস্ত নই, সেখানেও তাঁরা এগিয়ে এসেছেন, হিমালয় জয় করেছেন। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনেও তাঁরা অংশ নিচ্ছেন। একসময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চিকিৎসক বা এ রকম পদেই নারীকে দেখা যেত। এখন সেখানে নারী প্যারাট্রুপার, এমনকি মেজর জেনারেলও আছেন।
কৃষিক্ষেত্রে নারীর পদচারণ বহুকালের। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, খাদ্যশস্য উৎপাদনে যে ২১ ধরনের কাজ থাকে, তার মধ্যে ১৭ ধরনের কাজই নারীর দ্বারা সম্পাদিত হয়। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের যতগুলো খাত, সবগুলোতে নারীর অবদান রয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প সারা বিশ্বে স্বীকৃত। সেখানে প্রধানত নারীর মাধ্যমেই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পুরো ধারা সূচিত হয়েছে। চা–শিল্প, চামড়াশিল্প, ওষুধশিল্প, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা—কোথায় নেই নারী? ফুটবল ও ক্রিকেটে নারীরা সাফল্য নিয়ে আসছে। এমনকি আর্চারি, কারাতে, কাবাডি, ভারোত্তোলনের মতো ব্যতিক্রমধর্মী খেলায়ও মেয়েরা এগিয়ে এসেছে।
রাজনীতিতে নারীর পদচারণ স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই।পারিবারিক ঐতিহ্য বা যে কারণেই হোক না কেন, নারীনেতৃত্ব বিকশিত হয়েছে। দেশ নারী প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার পেয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে অর্থাৎ স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও নারীরা এগিয়ে এসেছেন। সরাসরি নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদে অংশ নিচ্ছেন।
সামাজিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক—সব ক্ষেত্রেই নারীর অগ্রযাত্রা আজ দৃশ্যমান। তবে সব পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও অংশীদারত্ব বাড়েনি। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এক–তৃতীয়াংশ নারীকে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রেও তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি। দলগুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে বিভিন্ন স্তর আছে, সেখানেও নারী সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণ চোখে পড়ে না। সংসদে সংরক্ষিত আসনে নারীরা শুধু মনোনীত হয়ে আসছেন। নারী আন্দোলন বহুদিন ধরে সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন চেয়ে এসেছে। কিন্তু তা আজ পর্যন্ত হয়নি। পেশিশক্তি, অর্থের আস্ফালনের যে রাজনীতি বাংলাদেশে, সেখানে নারী নিজের জন্য তেমন স্থান করে নিতে পারছেন না।
ক্ষুদ্র উদ্যোগের ক্ষেত্রেও নারীর অবদান দৃশ্যমান হচ্ছে। সারা বাংলাদেশে তিন লাখের বেশি নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রয়েছেন। তাঁদের কারণে পরিবারগুলোও উন্নত হচ্ছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে নারী পুলিশ প্রশাসনে আছেন, সচিব আছেন, উপাচার্য আছেন। সংস্কৃতির বিশাল অঙ্গনে যে উজ্জ্বল তারকারা আছেন, সেটা চিত্রগ্রাহক, নাটক, সিনেমা বা পরিচালনা—সর্বক্ষেত্রেই নারীরা আছেন।
স্বীকার করতে হবে সরকারের ইতিবাচক মনোভাব আছে, সহায়ক নীতিমালা আছে। বেসরকারি অনেক উদ্যোগও আছে। কিন্তু এত কিছুর পরও মাঝেমধ্যেই নারীকে হোঁচট খেতে হয়। এর একটা বড় কারণ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, পারিবারিক আচরণ। নারীকে এখনো দেখা হয় ঘর–সংসারের ভার বহনকারী একজন মানুষ হিসেবে। তিনি আয়রোজগার করতে পারেন ওই জায়গায় গ্রহণযোগ্যতা এসেছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ঘর–সংসারের দায়িত্বও সমানভাবে পালন করতে হচ্ছে। এই দ্বৈত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রায়ই নারী শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেক চাপের মুখে পড়েন। সংসারের দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার মানসিকতা এখনো আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে গড়ে ওঠেনি। এটা বড় একটি চ্যালেঞ্জ।
পরিসংখ্যান বলছে, কর্মজীবী নারীর জন্য অনিরাপদ রাস্তাঘাট, প্রতিকূল কর্মপরিবেশ, পরিবহনব্যবস্থা প্রতিনিয়ত বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। বাস ও অন্যান্য সাধারণ পরিবহনে যেভাবে নারীকে হেনস্তা করার প্রবৃত্তি দেখতে পাই, তা রীতিমতো ভয়ংকর। সাধারণ মানুষের মধ্যে তা প্রতিহত করার মনমানসিকতাও দেখা যায় না। বিশেষ করে শ্রমজীবী নারীর ওপর রাস্তাঘাটে যে নির্যাতনের চিত্র গণমাধ্যমে আসে, তা আরও ভয়াবহ।
আর্থসামাজিক কারণে পরিবারগুলো মেয়েদের পেছনে ব্যয় করে কম। শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে, অথচ সেই হারে বাল্যবিবাহ কমছে না। নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকে অভিভাবকেরা অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। আবার পরিসংখ্যান বলছে, ঘরেই নারীরা বেশি নির্যাতিত হচ্ছেন।
পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে নারীকে অধস্তন হিসেবে দেখার ইচ্ছা থেকেই নির্যাতন হয়ে থাকে। অনেক সময় নিরুপায় হয়ে হয়তো ঘরে-বাইরে নারী নেতৃত্ব মেনে নিতে হচ্ছে। সরকার নীতি নির্ধারণ করে দিলেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নারীকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। ঋণ এবং আনুষঙ্গিক সুবিধা পেতে নারীকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়।বিচারে দীর্ঘসূত্রতা বা বিচারহীনতার সংস্কৃতির যে নজির প্রায়ই দেখা যায়, তা নারীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আশার বিষয় হলো ইদানীং কিছু নারী নির্যাতন মামলার রায় দ্রুত হচ্ছে।
নারীর অগ্রযাত্রা সহজ করতে সরকারের অনেক উদ্যোগ, নীতিমালা আইনকানুন আছে। নারী এগিয়ে চলেছে, চলবে। কিন্তু চ্যালেঞ্জ অসীম। নারীর অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে হলে ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করে হ্রাস করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন নীতিমালার বাস্তবায়ন, যথাযথ কৌশল ও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। না হলে কেবল নারীর নয়, সমগ্র দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে।
একবিংশ শতাব্দীতে নারী শুধু বধূ, মাতা, কন্যা নয়; পরিবার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে নারীও অংশীদার—পুরুষের পাশাপাশি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারিগর।
রাশেদা কে চৌধূরী গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা