১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কয়েকজন বাঙালি তরুণ বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে জীবন দান করেন।
মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির এই আত্মাহুতিকে পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়।
২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার প্রশ্নে চূড়ান্ত ফয়সালা হয়েছিল বটে, কিন্তু ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল পাকিস্তান জন্মলাভের পরপরই, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের অব্যবহিত পর থেকে।
তারপর ধাপে ধাপে আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি পায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।
১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে প্রাদেশিক ভাষা নিয়ে আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এরই জের ধরে ডিসেম্বর মাসের শুরুতে বাংলাদেশে দফায় দফায় ক্ষোভ আর উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
ছাত্র-জনতা ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে বাংলা ভাষার সপক্ষে সমাবেশে তাঁদের মতামত প্রকাশ করেন। স্বার্থান্বেষী মহল বাংলা ভাষার বিপক্ষে উর্দুভাষী ও সরকারের অন্ধ অনুসারীদের দাঁড় করায়।
এর ফলে ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। এতে ওই দিন বাঙালি ছাত্র-জনতা একত্র হয়ে বাংলা ভাষার পক্ষে সচিবালয় ও মন্ত্রীদের ঘেরাও করে এবং ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করেন।
এই আন্দোলন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। তখনকার সব বড় শহরে এমনকি কিছু ছোট শহরেও সভা, সমিতি ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
এ কারণে মাতৃভাষার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের আন্দোলনে ১৯৪৭ সালের ১২ ডিসেম্বরের অবদান ঐতিহাসিক।
এই দিনের আন্দোলন সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় বেশ কিছু তথ্য প্রকাশিত হলেও সরকারি কোনো দলিল জনসমক্ষে আসেনি। ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা করে তদানীন্তন ঢাকা শহরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট এম গাফুর একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। নিচে এর বাংলা অনুবাদ ছাপা হলো।
১৯৪৭ সালের ১২ ডিসেম্বর চক এলাকার উর্দুভাষী মুসলমান ১৩ ডিসেম্বর বিকেল চারটায় উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সরকারি ভাষা ঘোষণার দাবিতে চক মসজিদের সামনে একটি সভার আয়োজন করে।
প্রস্তাবিত সভার প্রচারের জন্য উর্দুভাষীরা একটি হ্যান্ডবিল ছাপায় এবং একটি বাসে মাইক লাগিয়ে সভার দিন ও সময় প্রচার এবং উর্দু ভাষার সমর্থনে স্লোগান দিতে বের হয়।
সকাল ১০টায় বাসটি চক থেকে যাত্রা শুরু করে এবং শহরের বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে [এ সময় শহর বলতে পুরান ঢাকা, গেন্ডারিয়া, নারিন্দা, পল্টনকে বোঝাত।
রমনা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরে তখনো ঢাকা শহর গড়ে ওঠেনি]। দিনের মাঝামাঝি বাসটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এসে পৌঁছায়।
সেখানে প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে বাসের আরোহীরা উর্দু ভাষার সপক্ষে স্লোগান দেওয়া শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র বাসের আরোহীদের বাধা দেন এবং উর্দু ভাষার সমর্থনে স্লোগান না দিয়ে বরং বাংলা ভাষাকে সমর্থন করার জন্য চাপ দেন।
এতে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয় এবং জানা যায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের সঙ্গে বাসের আরোহীরা দুর্ব্যবহার করে।
এরপর প্রচারকারী বাসটি পলাশী ব্যারাকের দিকে অগ্রসর হয় এবং এটি যখন উর্দু ভাষার পক্ষে স্লোগান দিয়ে পলাশী ব্যারাক এলাকার সামনের সড়ক অতিক্রম করছিল, তখন পলাশী ব্যারাকের কিছু বাসিন্দা, যাদের বেশির ভাগই ছাত্র ছিল, বেরিয়ে এসে বাসটিকে থামায় এবং বাসের আরোহীদের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হয় এই বলে যে তাদের উচিত উর্দুর বদলে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে সমর্থন করা।
এতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় এবং পলাশী ব্যারাকের কিছু বাসিন্দা বাসের কয়েকজন আরোহীকে টেনে নামানোর চেষ্টা করাতে সেখানে এক ধরনের চেঁচামেচি ও ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায়।
ফলে বাসের কয়েকজন আরোহী পলাশী ব্যারাকের বাসিন্দাদের দ্বারা নিগৃহীত হয়। এরপর বাসটি তার আরোহীদের নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যায় এবং জানা যায় যে প্রায় আধা ঘণ্টা পরে একই বাস অধিকসংখ্যক আরোহী নিয়ে পলাশী ব্যারাকে ফিরে আসে।
এদের পেছনে পেছনে আরও বড় একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা সেখানে হাজির হয়ে সবাই মিলে পূর্বদিক থেকে পলাশী ব্যারাকের বাসিন্দাদের ওপর হামলা চালায়।
জানা যায় যে বেশ কিছুক্ষণ ইটপাটকেল ও অন্যান্য জিনিস ছোড়াছুড়ির পর বহিরাগত হামলাকারীর দল ফিরে যায়।
এ ঘটনার সংবাদ পুলিশ বেলা দেড়টার আগে জানতে পারেনি, যতক্ষণ না পলাশী ব্যারাকে হামলা হয়েছে মর্মে একটি খবর এসে লালবাগ থানায় পৌঁছায়।
তৎক্ষণাৎ একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর ও একজন সার্জেন্টের নেতৃত্বে একদল পুলিশকে ট্রাকে করে পাঠানো হয়, কিন্তু ঘটনাস্থলে পৌঁছে পুলিশের দল গোলযোগ দেখতে পায়নি, তবে পলাশী ব্যারাকের একদল বাসিন্দাকে ব্যারাকের পূর্ব ফটকের সামনে খুব উত্তেজিত অবস্থায় লক্ষ করে।
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একদল ছাত্রকেও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেলের সামনের রেললাইন ধরে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখা যায়।
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেলের ছেলেদের পক্ষ থেকেও অভিযোগ আসে যে শহর থেকে আসা বিশৃঙ্খল জনতা তাঁদের ওপরও হামলা করেছে, এতে ডাইনিং হল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কিছু হামলাকারী থালা-বাসন ও তৈজসপত্র নিয়ে গেছে। দুষ্কৃতকারীদের ঠেলাঠেলির কারণে হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্টের স্ত্রীসহ ইঞ্জিনিয়ারিং হোস্টেলের কিছু ছাত্র সামান্য আঘাতপ্রাপ্ত হন।
পলাশী ব্যারাকের বাসিন্দারাও অভিযোগ করে যে হামলাকারীরা তাদেরও বেশ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে গেছে।
আমি বেলা দুইটায় এই গোলযোগের বিষয়টি জানতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘটনাস্থলে ছুটে যাই এবং সেখানে পৌঁছে পূর্ব ব্যারাকের পূর্ব ফটকের সামনে একদল উত্তেজিত জনতা দেখতে পাই, যারা সবাই পলাশী ব্যারাকের বাসিন্দা ছিল।
আমি আরও দেখতে পাই যে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্ররা তাঁদের হোস্টেলের সামনে রেললাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি পলাশী ব্যারাকের সামনের জনতা ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেলের সামনে জমায়েত ছাত্রদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাঁদের নিজেদের এলাকায় পাঠিয়ে দিই।
এ ছাড়া আমি ময়দানের দক্ষিণ দিকের জনতাকেও সরিয়ে দিই।
পলাশী ব্যারাক এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রাবাস ও মেডিকেল কলেজের বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারি যে ১৩ জন সামান্য আহত হয়েছে এবং পলাশী ব্যারাকের একজন দারোয়ানের নাক ভেঙে গেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কিছু ছাত্রও সামান্য আহত হয়েছেন।
ঘটনার পরপরই ছাত্র ও পলাশী ব্যারাকের করণিকেরা পলাশী ব্যারাক এলাকায় একটি সভা করে সিদ্ধান্ত নেন যে পলাশী ব্যারাকে গুন্ডাদের আক্রমণের প্রতিবাদ জানাতে তাঁরা মিছিলসহ সচিবালয়ে যাবেন।
মিছিল বিকেল চারটায় পলাশী ব্যারাক থেকে যাত্রা শুরু করে এবং সচিবালয় অভিমুখে যাত্রা করে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছাত্রাবাস, বিশ্ববিদ্যালয় ভবন ও অন্যান্য এলাকা থেকেও ছাত্ররা মিছিলে এসে যোগ দেন।
মিছিল বিকেল সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে মন্ত্রী এ হামিদের [আবদুল হামিদ, শিক্ষামন্ত্রী] বাসার সামনে এসে পৌঁছায়।
মন্ত্রীকে নিচে নেমে আসতে এবং বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সরকারি ভাষা হিসেবে কার্যকর না করলে মন্ত্রীপদ থেকে তিনি পদত্যাগ করবেন বলে বিক্ষোভকারীদের নিশ্চয়তা দিতে বাধ্য করেন।
এই নিশ্চয়তা পাওয়ার পরে মন্ত্রীকে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে বিক্ষোভকারীরা সচিবালয়ের দিকে এগোতে থাকেন।
মিছিলকারীরা ততক্ষণে উচ্ছৃঙ্খল হতে শুরু করেছেন। বিক্ষোভকারীদের প্রবেশ ঠেকানোর জন্য ইতিমধ্যে সচিবালয়ের ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তাঁরা সচিবালয় এলাকায় ঢুকে ঝামেলা করতে না পারেন।
মিছিলকারীরা সচিবালয়ের উত্তরের কেন্দ্রীয় ফটকে পৌঁছে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকেন। সেখানে চিৎকার করে স্লোগান আর বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ ও পুলিশের বিরুদ্ধে গালাগালের বর্ষণ হতে থাকে।
বিক্ষোভকারীরা যখন টের পান যে বলপ্রয়োগে ফটক খোলা সম্ভব নয়, তখন তাঁরা সবাই সীমানাপ্রাচীর টপকে সচিবালয়ে প্রবেশ করেন।
তাঁরা মন্ত্রী আফজালকে [সৈয়দ মুহাম্মদ আফজাল, কৃষিমন্ত্রী] ঘিরে ধরেন এবং তাঁকে টেনেহিঁচড়ে সচিবালয় এলাকার মধ্যে বারান্দার এক জায়গা থেকে অপর জায়গায় নিয়ে যান।
দেখে মনে হচ্ছিল যে বিক্ষোভকারীরা মন্ত্রীদের অপদস্থ করার জন্য বন্ধপরিকর এবং পুলিশের হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছিল।
কিন্তু কৃষিমন্ত্রী পুলিশের হস্তক্ষেপ চাইছিলেন না বলে পুলিশ দলকে নীরব দর্শক হয়ে থাকতে হয়।
এরপর বিক্ষোভকারীরা ইটের টুকরা ও অন্যান্য বস্তু সচিবালয়ের ভেতরে থাকা পুলিশ অফিসার ও কনস্টেবলদের ছুড়ে মারতে শুরু করেন।
ইটের টুকরা কয়েকজন কর্মকর্তা ও পুলিশের সদস্যকে আঘাত করে এবং তাঁরা সামান্য আহত হন।
বিক্ষোভকারীরা সচিবালয়ের দারোয়ানের ওপরও চড়াও হন এবং তাঁকেও আহত করেন।
এই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মিছিলকারীরা দাঙ্গা এবং মন্ত্রীদের অন্যায়ভাবে আটকে রাখা ও সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনকালে তাঁদের ওপর চড়াও হওয়ার মতো অপরাধ সংঘটন করেছেন।
তাই সচিবালয়ের সীমানায় এসব অপরাধ সংঘটনের জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়।
এখানে উল্লেখ করতে চাই, অপরাহ্নে সচিবালয়ে বিক্ষোভকারীদের ছোড়া ইটে আমি দুবার আঘাতপ্রাপ্ত হই, অতিরিক্ত এসপি (অপরাধ) এল রহমান তাঁর মাথার পেছন দিকে এবং হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হন।
পরের আঘাতটির ফলে আহত জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ হয়। আমার রক্ষী কনস্টেবল মো. সাব্বির খানের পেছন দিকে ইটের আঘাত লাগে।
আরও কিছু কনস্টেবলেরও ইটের টুকরা লাগে, তবে তাঁরা আহত হননি। সহকারী এসপি (ওয়্যারলেস) মিস্টার ম্যাকহারসান তাঁর দিকে ছোড়া একটি ইটের আঘাত থেকে তাঁর মুখ অল্পের জন্য রক্ষা করতে সক্ষম হন।
লালবাগ থানায় ইতিমধ্যে পলাশী ব্যারাক ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেলে আক্রমণ চালানোর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়েছে এবং তদন্তাধীন আছে।
স্বাক্ষর/ এ গাফুর
অতিরিক্ত সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ
ঢাকা সিটি