শৈশবে সারা দিন কেটে যেত আড্ডাবাজি করেই। খেলার নামে স্কুল ফাঁকি দেওয়ার বাতিক ছিল। মনে আছে, সেই সময়ে আমাদের ক্রীড়া শিক্ষক মানস স্যার প্রথম লাল বুট কিনে দিয়েছিলেন, স্কুলের হয়ে খেলব বলে। ফুটবলার হয়ে ওঠার স্বপ্নে আমি বিভোর তখন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা সামনে, আর এদিকে–ওদিক থেকে ‘খ্যাপের’ তাড়া, রাতে পড়ার টেবিলে ঝিমুনি। জীবনের প্রথম রোজগার চণ্ডীগড় বাগানে খেলে পাওয়া ১০০ টাকা। সেকি আনন্দ! সিলেটে লিগ পর্যায়ের খেলায় তারকা খেলোয়াড় সালাউদ্দিন ভাইয়ের স্ট্যান্ডবাই হিসেবে মাঠের বাইরে থাকাটা ছিল আমার জন্য গর্বের। কল্পনায় ছক আঁকি, পরিবার যা–ই বলুক—ফুটবলারই হব। শেষ অবধি হলো না।
১৪ বছর বয়সে পড়াশোনা করতে পাড়ি জমাই এই লন্ডনে। বাবাকে ‘যাব না’ বলার সাহস ছিল না, বুকের ভেতর নাড়ি ছেঁড়ার যন্ত্রণা, চেনা অলিগলি ফেলে আমি কোথায় যাব! বিলেতে এসে তীরহারা নাবিকের দশা হলো। ভিনদেশ, অচেনা পরিবেশ আর ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভেবে কাতর, সুযোগ পেলেই পার্কে বসে বুক ভাসাতাম। ইংরেজিতে কথা বলা ছিল আরেক ভয়, পরিস্থিতি এমন যে না খেয়ে বাঁচি, তবু কঠিন ভাষাটি যেন বলতে না হয়! মামা ছিলেন চিকিৎসক, আত্মীয়স্বজনও নেহাত কম নয়। বোর্নমাউথ কলেজ, এখন যেটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়, শর্ত সাপেক্ষে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলাম। তবে মূল কোর্সে যাওয়ার আগে ফাউন্ডেশন কোর্স করতে হবে। এক বছর পর শিক্ষকেরা হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টে স্নাতক কোর্স নিতে বললেন। একেবারে নতুন কোর্স, আর ছাত্রছাত্রীও হাতে গোনা। ভর্তি শেষ হলো, এদিকে আয়–রোজগারও দরকার। সপ্তাহে তিন দিন পাঁচ পাউন্ড বেতনে আমার আত্মীয়ের তাজমহল গ্রুপের রেস্তোরাঁয় কাজ শুরু করি। ধীরে ধীরে টের পাচ্ছিলাম, ফুটবলের প্রেম থেকে আমি দূরে সরে যাচ্ছি। ক্লাস শেষে সন্ধ্যায় রেস্তোরাঁয় এসে আঁকিবুঁকি করতাম, শিখে আসা কিছু দিয়ে নতুন কিছু করা যায় কি না। ভেতরে নাড়া দেয়, ভালোবাসা বেড়ে যায় যখন দেখি রেস্তোরাঁর গ্রাহকেরা আমার ছোটখাটো সংযোজনে বাহবা দেয়। দিন দিন বুঝতে পারি, আমাদের পরিবেশন রীতি আর কলেজ থেকে ব্যবহারিক শিক্ষার মধ্যে বিস্তর ফারাক।
রেস্টুরেন্ট বিষয়ে পড়ছি আর আত্মীয়ের রেস্তোরাঁ হওয়ার সুবাদে খাবার তালিকার কোনো পদ সংযোজন কিংবা পরিবেশনে নতুনত্ব আনার চেষ্টায় আমার ছিল পূর্ণ স্বাধীনতা। মনে আছে, তখন দ্বিতীয় বর্ষে ‘কিং প্রন পুরি’ নামে চিংড়ির একটি ডিশ ছিল, যেটি পরিবেশন করা হতো স্টিলের থালায়। নিয়ে এলাম ডিম্বাকৃতির থালা। একই খাবার পরিবেশন বৈচিত্র্যের কারণে সুনাম কুড়াল। আমার আগ্রহ বেড়ে চলে। ১৯৭৮ সালে শেষ হয় স্নাতকের পড়াশোনা। যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তের বোর্নমাউথ কলেজ থেকে ১৯৮০ সালে হোটেল ব্যবস্থাপনায় ডিগ্রি নিয়ে বের হই। এরপর ১৯৯০ সালে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টস থেকে ফেলোশিপ অর্জন করি। ব্যবসার শুরুটা অবশ্য তার আগেই, ১৯৮২ সালে।
যুক্তরাজ্যের এপসম সারেতে ১৯৮৯ সালে প্রথম রেস্তোরাঁ দিয়েছিলাম ‘লে রাজ রেস্টুরেন্ট’ নামে। রেস্তোরাঁর সাজসজ্জায় আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল, হয়তো সে কারণেই সবাই সেখানে খাওয়ার জন্য যেতেন। ২০১২ সালের ঘটনা, লন্ডনে তখন অলিম্পিক গেমস চলছে। একমাত্র অফিশিয়াল খাবার সরবরাহকারী হিসেবে মনোনীত হলো লে রাজ রেস্টুরেন্ট। সারা বিশ্ব থেকে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করা বিভিন্ন দেশ ও খেলোয়াড়দের কাছে বেশ সমাদৃত হয় আমাদের খাবার। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কিছুদিনের মাঝেই অন্যতম ‘কারি রেস্টুরেন্ট’ হিসেবে যুক্তরাজ্যে পরিচিতি পেয়েছে লে রাজ। মিশেলিন রেটিংয়ে ১৯ বছর ধরে আমরা শীর্ষে অবস্থান করছি।
রেস্তোরাঁর বেশ রমরমা অবস্থা। এমনই সময়ে ঝুঁকেছিলাম পত্রিকা প্রকাশে। ১৯৯৮ সালে যাত্রা শুরু করে আমার ব্যবসা খাতের সাময়িকী স্পাইস বিজনেস। এরই মধ্যে অন্য কিছু ব্যবসায় জড়িয়ে পড়লেও কারি শিল্পে বিনিয়োগ ও অবদানের সুবাদে একটি পরিচিতি গড়ে ওঠে। রেস্তোরাঁর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে আরেকটি কারণ দেশ-বিদেশের নামীদামি সব লোক এখানে খেতে আসতেন—অভিনেতা, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী এবং অনেক তারকা। জনপ্রিয় খেলোয়াড়দের পছন্দের তালিকায় প্রথম ছিল রেস্তোরাঁটি। লে রাজ রেস্টুরেন্টের সাফল্যে বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি জোটে আমার কপালে। তবে এটিই শেষ নয়, আরও কয়েকটি রেস্তোরাঁ আছে আমার। ব্রিটেনে এমন রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠার সুবাদে পাই Confrerie de la Chaine des Rotisseurs-এর স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি আমাকে কারি শিল্পে একটা অবস্থানে নিয়ে যায়। কোনো এশীয় রেস্তোরাঁর মধ্যে এমন স্বীকৃতি আমরাই প্রথম পাই।
মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন স্বনামধন্য গণমাধ্যম থেকে আমন্ত্রণ আসতে শুরু করে। তারা বেশ জোরেশোরেই আমাদের রেস্তোরাঁর প্রচার করে। এই সময়ে বাংলাদেশেও রেস্তোরাঁটি প্রচার পেয়েছে। আমার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের খাবারেরও ভাবমূর্তি বাড়তে থাকে। ব্রিটেনে ভারতীয় রেস্তোরাঁর চেয়ে বাংলাদেশি রেস্তোরাঁয় মানুষের আগ্রহ বাড়তে শুরু করে। রেস্তোরাঁর জনপ্রিয়তা বাড়াতে মাথায় নানা ভাবনা ঘুরপাক খেত। ১৯৯২ সালের মাঝামাঝি ৫০ থেকে ৬০ জন অতিথি নিয়ে লন্ডন সিটি এয়ারপোর্ট থেকে দুই ঘণ্টার জন্য আকাশে উড়ল ‘লে রাজ এভিয়ন’—বিশ্বের প্রথম উড়ন্ত রেস্টুরেন্ট। সপ্তাহের প্রতি রোববার ইংলিশ চ্যানেলের ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে চিতল মাছের কোপ্তা, কাচ্চি বিরিয়ানি বা এ রকম ব্যতিক্রমী খাবার খেতেন অতিথিরা। বিশ্বের খ্যাতনামা মানুষজনও ছিলেন। সংবাদমাধ্যমগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ল, জোরেশোরে প্রচার পেল লে রাজ এভিয়ন রহস্য। স্কাই টিভি পাঁচ হাজার পাউন্ড দিল তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য। রেক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান তার ছবি বিক্রি করতে শুরু করল। ভালো চাহিদা থাকলেও একসময় লে রাজের এই কার্যক্রম বন্ধ করে দিই।
শুধু ক্ষুধার্ত হলেই মানুষ খাবার খায় না, খাবার যদি সুস্বাদু হয়, পরিবেশনা যদি মানসম্পন্ন হয়, তবে এটিও অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে একই কাতারে থাকতে পারে। মানুষ যেমন বারবার সেই রেস্তোরাঁয় ফিরে আসে, তেমনই সঙ্গে নিয়ে আসে অতিথিকে।
নিজ দেশের কথা আমি কখনো ভুলিনি। যেকোনো দুর্যোগের মুহূর্তে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করেছি। এই এগিয়ে আসা মানবতার খাতিরে এগিয়ে আসা, কোনো দেশের জন্য নয়। নানা ব্রিটিশ সংগঠনেও আমরা নিয়মিত সহযোগিতা করে আসছি। ব্রিটিশ রাজনীতিতেও সক্রিয় থেকেছি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন আমার কাছের একজন মানুষ। কনজারভেটিভ পার্টিতেও আছে সক্রিয় ভূমিকা।
২০০৮ সালে ব্রিটেনের রানি হসপিটালিটি শিল্পে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘মেম্বার অব দ্য মোস্ট এক্সিলেন্ট অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ (এমবিই) পদকে ভূষিত করেন আমাকে। এরপর থেকেই নামে শেষে ‘এমবিই’ যোগ করি। ২০১১ সালে সিটি অব লন্ডন থেকে পেয়েছি ফ্রিম্যান স্বীকৃতি। আমিই প্রথম কোনো মুসলিম যে ১২৩৭ সাল থেকে নিয়মিত দেওয়া এই পদক পেয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে এই স্বীকৃতি আমাকে আরও অনুপ্রাণিত করে। কারি শিল্পের উন্নতিতে নিজের সবটুকু দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আর এর সবকিছুর পেছনেই আছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলের চেষ্টা। এখন বিদেশিরা অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি বাংলাদেশি খাবার বেশ পছন্দ করছে। রাষ্ট্রীয় অনেক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশি খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে।
২০১১ সালে সারে কাউন্টি কাউন্সিল আমাকে ‘পারসোনালিটি অব দ্য ইয়ার’ পদকে ভূষিত করে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ‘এনআরবি পারসন অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত করা হয়েছে।
২০০৫ সালে শুরু করি ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড। পরে এটি কারি অস্কার হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের দেওয়া নাম এটি। কারি অ্যাওয়ার্ডের এক অনুষ্ঠানে এসে তিনি বলেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় এই শিল্পের শুরু হলেও ব্রিটেনে বেশি বিকশিত হয়েছে। এখন ব্রিটেনের জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ এটি।
ব্রিটেনে প্রবাসী বাঙালির সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ। ব্রিটেনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। তবে ব্যবসা যে একটি কমিউনিটিকে স্বতন্ত্র পরিচয় এনে দেয়, তা প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশিরা। একরকম নীরব বিপ্লবের মাঝে তাঁরা বদলে দিয়েছেন ব্রিটিশ খাদ্যাভ্যাস। কারি শিল্প ব্রিটেনে এক বিশাল স্থান দখল করে রেখেছে। আগে সামর্থ্যবান বাঙালিরা বিদেশি রেস্তোরাঁ খুঁজে নিতেন। এখন বিদেশিরা খোঁজেন বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ। তাঁরা অনুষ্ঠানকে বর্ণাঢ্য করতে খাবারে কারি রাখেন। যুক্তরাজ্যের আনাচকানাচে এখন চিকেন টিক্কা মাসালার জয়জয়কার। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশরা এখন নিজেদের রেস্তোরাঁর নামের আগে ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ না লিখে লিখছেন বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ।
লেখক পরিচিতি
এনাম আলী এমবিই যুক্তরাজ্যের কারিশিল্পের একজন পথিকৃৎ। জন্ম ১৯৬০ সালে, সিলেটে। ১৯৭৪ সালে যান লন্ডনে। সেখানে হোটেল ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ডিগ্রি শেষে চালু করেন লে রাজ রেস্টুরেন্ট। ২০০৮ সালে ব্রিটেনের রানি হসপিটালিটি শিল্পে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে মোস্ট এক্সিলেন্ট অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (এমবিই) পদকে ভূষিত করেন তাঁকে। ২০১১ সালে সারে কাউন্টি কাউন্সিল তাঁকে ‘পারসোনালিটি অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে ঘোষণা করে।
সেসব কীর্তিগাথা শোনাচ্ছেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করা কয়েকজন প্রবাসী: