বাঙালি রান্নায় বৈচিত্র্য এবং একটি হারিয়ে যাওয়া রেসিপি

প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন। চাঁদ সওদাগরের বাড়িতে সানাই বাজছে। তার বাড়িতে পুত্রবধূ হয়ে এসেছে বেহুলা। সওদাগর বাড়ির বিয়ের অনুষ্ঠানে বড় বড় কটাহ বা কড়াইয়ে, হাঁড়িতে কাঠের আগুনে রান্না হচ্ছে দেদার। রান্না হয়েছে ১৮ ধরনের মাছের পদ—বেসন দিয়ে চিতল মাছের কোল ভাজা, মাগুর মাছ দিয়ে মরিচের ঝোল, বড় বড় কৈ মাছে কাটার দাগ দিয়ে জিরা-লবঙ্গ মেখে তেলে ভাজা, মহাশোলের অম্বল, ইচা (চিংড়ি) মাছের রসলাস, রোহিত (রুই) মাছের মাথা দিয়ে মাষকলাইয়ের ডাল, আম দিয়ে কাতলা মাছ, পাবদা মাছ ও আদা দিয়ে শুকতুনি, আমচুর দিয়ে শোল মাছের পোনা, তেঁতুল–মরিচসহ বোয়াল মাছের ঝাঁটি, ইলিশ মাছ ভাজা, বাচা, ইচা, শোল, শোলপোনা, ভাঙ্গনা, রিঠা ও পুঠা (পুঁটি) মাছ ভাজা। বাঙালি বাড়ি, অতিথিদের মাংস না খাওয়ালে চলে? তাই খাসি, হরিণ, মেষ, কবুতর, কাউঠা (ছোট কচ্ছপ) প্রভৃতির মাংস দিয়ে রান্না হয়েছে নানাবিধ ব্যঞ্জন ও অম্বল।

চাঁদ সওদাগরের বাড়ির এই বিবরণ থেকে উচ্চবিত্ত বাঙালির খাবারের কিছুটা হদিস পাওয়া যায়। সময়রেখা ধরে আর একটু পিছিয়ে গেলে প্রাকৃতপৈঙ্গল থেকে জানা যায়, ফেনা ওঠা ভাত, যা খাওয়া হতো কলাপাতায়, তাতে থাকত গাওয়া ঘি, পাটশাক, ময়না বা মৌরলা মাছ আর সঙ্গে দুধ। মোটামুটি এই হলো সাধারণ মানুষের খাবারের প্রাচীনতম নমুনা।

ভাত তর্কাতিতভাবে বাঙালির আদি ও অকৃত্রিম খাবার। সঙ্গে বিভিন্ন শাকসবজি আর মাছ। মাংস খাওয়ার প্রচলনও ছিল। মুড়ি–মুড়কি, দই, চিড়া, বিভিন্ন রকম পিঠা, মিষ্টি, ফল, বিভিন্ন ধরনের কাসুন্দি, তৈলাম্র বা আমের আচার ইত্যাদি তো ছিলই।

নদীমাতৃক প্রাচীন বাংলার জীবনব্যবস্থা ছিল কৃষিপ্রধান, ফলে সাধারণত যূথবদ্ধ। স্বাভাবিকভাবে তার রান্নাঘর ছিল আয়তনে বড়। আয়োজন ছিল বিশাল। গ্রামীণ জনপদে রান্নার পরিবর্তন তেমন একটা হয়নি। তবে বিভিন্ন কারণে বাঙালি রান্নার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে মূলত নগরে।

স্থুলভাবে ১২০০–১৮৫৮ সাল, এই প্রায় সাড়ে ৬০০ বছর কালপর্বে ভারতবর্ষে দুটি মোটাদাগের পরিবর্তন ঘটে। তার একটি হলো সেলাই করা বস্ত্রের আমদানি আর অন্যটি নতুন ধরনের খাবার। পার্সি, তুর্কি, আফগান, আরবরা তখন প্রায় পুরো ভরতের দখল নিয়ে রাজ্যবিস্তারের পাশাপাশি ধর্ম, পোশাক আর খাদ্যেরও বিস্তার করে চলেছে। এরই মধ্যে ১৫১৬ সালে বাংলায় আসে পর্তুগিজরা, ১৬০৮ সালে আসে ইংরেজরা, ১৬৩০ সালে ওলন্দাজরা আর ১৬৭৪ সালে ফরাসিরা। মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রায় সাড়ে আট দশকের মাথায়, ১৬১০ (মতান্তরে ১৬০৮) সালে ঢাকা সুবা বাংলার রাজধানীর মর্যাদা পায়। এ ঘটনা বাংলার রান্নার ভূগোল পাল্টে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। 

উল্লিখিত সময়ে পুরো বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠে ভিনদেশি মানুষের নতুন নতুন জনপদ। আর সেই সব জনপদ থেকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে নতুন নতুন খাবারের খোশবাই। স্থানীয় ও বিদেশিরা পরস্পরের সঙ্গে বিনিময় করতে থাকে তাদের বিভিন্ন খাবার। শুরু হয় বাঙালির ভাতের বদলে কোফতা, বিরিয়ানির স্বাদ নেওয়ার পালা, মাংসের তরকারিতে ডুমো ডুমো আলু মিশিয়ে কাঁচা মরিচ দিয়ে ঝাল ঝাল ঝোল খাওয়া, বেকারির রুটি আর কেক-পেস্ট্রি খাওয়া, আম আর বেল ‘পানা’র পরিবর্তে গোলাপজল মেশানো ‘শরবত’ পান করা। 

‘রান্নাঘর’ বা ‘পাকশালা’ শব্দের যে ব্যাপ্তি তা সংকুচিত হয়ে ঢুকে পড়ে শহুরে মধ্যবিত্তর ফ্ল্যাটবাড়ির ‘কিচেনে’। বাজারসদাই ভাঁড়ার ঘরের পরিবর্তে ঢুকতে থাকে রেফ্রিজারেটরের শীতলতায়।রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে রাজধানী হিসেবে ঢাকার আত্মপ্রকাশের ফলে নগর ঢাকা অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বাড়তে থাকে ঢাকার এবং নগর হিসেবে ঢাকা ধারণ করতে থাকে ‘কসমোপলিটন’ বৈশিষ্ট্য। এই কসমোপলিটন নগরের মানুষ এক মিশ্র জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে ধীরে ধীরে। ফলে মোগল রান্নার মসলাদার খাবারের সুঘ্রাণ যেমন যেতে থাকে পর্তুগিজ হেঁশেলে, তেমনি পর্তুগিজদের হাত ধরে বাঙালি রান্নায় ঢুকে যায় মরিচ আর আলু, বেকারির রুটি, কেক-পেস্ট্রি, জ্যাম-জেলি আর চাটনি। আনারস, পেয়ারা, আতা, লিচু, টমেটো ইত্যাদি সুস্বাদু ফল ও সবজি জায়গা করে নেয় আম-কাঁঠাল-জাম-জামরুলের পাশে। ধীরপায়ে বাংলায় আসে বিলেতি সাহেবরা। তাদের সঙ্গে আসে তাদের পছন্দসই খাবারদাবার, আদবকেতা। তবে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে রাজনৈতিক মেরুকরণে যেহেতু ইংরেজরা শেষ পর্যন্ত টিকে যায়, তাই খাদ্যসংস্কৃতিতে তাদের প্রভাবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে পরবর্তী সময়ে। আবার দীর্ঘদিনের চর্চিত মোগল, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ ইত্যাদি জাতির খাবারের প্রভাবও ছিল বাঙালি হেঁশেলে, তাই সেগুলোও একেবারে বাদ পড়ল না।

ঢাকার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে প্রথম দিকে বাঙালি খাবারে মোগলদের খাদ্যসংস্কৃতির প্রভাবের বিষয়টি আমাদের চোখে পড়ে। এখনো পুরান ঢাকার মোগলাই খাবারের বৈচিত্র্য আমাদের সে কথা মনে করিয়ে দেয়। এ ছাড়া পর্তুগিজসহ ফরাসি-ইংরেজ ইত্যাদি জাতির খাবারের ভগ্নাবশেষ খুঁজলেই পাওয়া যায় বাঙালির রান্নাঘরে।

আমরা আগেই বলেছি, বাংলার কৃষিপ্রধান ও যূথবদ্ধ জীবনব্যবস্থায় রান্নাঘর ছিল আয়তনে বড়। তাতে রান্না হতো দুমুখো, তিনমুখো কখনোবা একমুখো মাটির উনুনে, শুকনো বাঁশ-কাঠ, গাছের শুকনো পাতা অথবা পাঠকাঠির আগুনে। সাধারণ মানুষ রান্না ও খাওয়ার কাজে ব্যবহার করত মাটির বাসনকোসন। এ কাজে কাঁসা–পিতলের তৈজস ব্যবহৃত হতো উচ্চবিত্তের ঘরে। এই সব বাসনকোসনে বা তৈজসে রান্না হতো বিভিন্ন ব্যঞ্জনসহযোগে শ্বেত–শুভ্র সুসেদ্ধ ভাত। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অর্থনৈতিক কারণে সারা পৃথিবীর মতো বাঙালির পারিবারিক জীবনেও বাজতে থাকে ভাঙনের সুর। যৌথ পরিবার ভেঙে গড়ে উঠতে থাকে ‘একক’ পরিবার। ফলে রান্নাঘর হয়ে পড়ে সংকুচিত, কমতে থাকে রান্না করা পদের সংখ্যা। ফলে ‘রান্নাঘর’ বা ‘পাকশালা’ শব্দের যে ব্যাপ্তি, তা সংকুচিত হয়ে ঢুকে পড়ে শহুরে মধ্যবিত্তর ফ্ল্যাটবাড়ির ‘কিচেনে’। বাজারসদাই ভাঁড়ার ঘরের পরিবর্তে ঢুকতে থাকে রেফ্রিজারেটরের শীতলতায়। ‘সময় নেই’–এর অজুহাতে বাড়িতে মুড়িভাজা, চিড়ে কোটা, মোয়া বানানো, দই পাতা বন্ধ হয়ে বাঙালির ডাইনিং টেবিলে উঠে আসে বাটার টোস্ট, ডিমের ‘মামলেটে’র জায়গায় সানি সাইটআপ কিংবা হানি ব্রেড, বানানা। এরপর থেকে বাঙালি মধ্যাহ্নে আর ভোজ সারে না, লাঞ্চ করে; রাতে খায় ডিনার।

উনিশ-বিশ শতক থেকে বাঙালি খাবারদাবারে আরও ‘আধুনিক’ হতে থাকে ইংরেজদের হাত ধরে। একুশ শতকে ইউরোপীয় স্বাস্থ্যসচেতনতার প্রবণতা প্রবেশ করে তাদের মননে। এ ছাড়া এ সময় বিশ্বায়নের অভিঘাতে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া বাঙালির হাত ধরে ভারতীয় ও ইউরোপীয় খাবারের সঙ্গে সঙ্গে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের খাবারও ঢুকে যায় বাঙালি হেঁশেলে এবং শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের রান্নায় তার উপস্থিতি হয়ে পড়ে অবশ্যম্ভাবী। এ কারণে বার্গার-পিৎজা-স্যুপ-পারিজ-পুডিং ইত্যাদির সঙ্গে টোপিওকা পার্ল দিয়ে বানানো ফিলিপিনো ডেজার্ট বুকো পানদানের খোঁজও মেলে বাঙালির রান্নাঘরে।

তথ্যঋণ:

১. রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল ও অনার্য তাপস সম্পাদিত, নুনেতে ভাতেতে, ১ম খণ্ড, দ্য কাফে টেবল, ব্যান্ডেল, হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ, ২০১৬।

২. মিলন দত্ত, বাঙালির খাদ্যকোষ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ২০১৫।

অনার্য তাপস : লোক সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক ও লেখক