বাংলাদেশ বিশ্বে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত

টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের পেছনে তৃণমূলের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম কার্যকরী ভূমিকা পালন করে
টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের পেছনে তৃণমূলের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম কার্যকরী ভূমিকা পালন করে

নানা ব্যর্থতা ও হতাশাজনক সংবাদের ভিড়ে বাংলাদেশের গৌরব করার মতো যে কয়টি অর্জন রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো স্বাস্থ্য খাতের অর্জন। ১৯৮৫ সালে একদল জনস্বাস্থ্যবিজ্ঞানী বিশ্বের তিনটি রাষ্ট্র ও ভারতের একটি রাজ্যকে ‘গুড হেলথ অ্যাট লো কস্ট’ বা স্বল্প ব্যয়ে সুস্বাস্থ্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করে। এগুলো হলো চীন, কোস্টারিকা, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের কেরালা। এই দেশগুলো ও একটি দেশের রাজ্যকে বেছে নেওয়ার কারণ হচ্ছে, এগুলো অর্থনৈতিকভাবে তাদের আশপাশের রাষ্ট্র ও রাজ্যগুলোর সমতুল্য হলেও স্বাস্থ্যের সূচকগুলো ছিল উন্নততর।

এ প্রকাশনার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের আরেক দল জনস্বাস্থ্যবিজ্ঞানী দেখতে চাইলেন এই দেশগুলো ও ভারতের কেরালা রাজ্য তাদের স্বাস্থ্য খাতের অর্জন ধরে রাখতে পেরেছে কি না। এর সঙ্গে তাঁরা আরও চারটি রাষ্ট্র বা রাজ্যকে বেছে নিলেন, যারা সাম্প্রতিক সময়ে ২৫ বছর আগের চীন, কোস্টারিকা, শ্রীলঙ্কা, কেরালার মতো স্বাস্থ্য খাতে সম্ভাবনার স্বাক্ষর রাখছে। এর মধ্যে একটি দেশ ছিল বাংলাদেশ। কিছু পরিসংখ্যান উল্লেখ করলেই দৃষ্টান্তমূলক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নাম যুক্ত হওয়ার সপক্ষে জ্বলন্ত প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯৭১ সাল থেকে মাত্র ৪৫ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ২৫ বছর বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কল্পনাকেও হার মানায়। শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২২২ দশমিক ৭ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩২ দশমিক ৪-এ।

২০১০ সালে প্রকাশিত গুড হেলথ অ্যাট লো কস্ট: ২৫ ইয়ারস অন্থ নামের বইটিতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতির যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়, তার অন্যতম হলো বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচির অতুলনীয় সাফল্য। টিকাদানের ক্ষেত্রে যে সূচকগুলো গুরুত্বপূর্ণ, তার মধ্যে অন্যতম হলো ১২-২৩ মাস বয়সী শিশুদের হামের টিকা গ্রহণের হার (শতাংশে), যা বাংলাদেশে ৯৪ শতাংশ। আরেকটি সূচক হলো, ১২-২৩ মাস বয়সী শিশুদের ডিপিটি টিকা গ্রহণের হার (শতাংশে), যা বাংলাদেশে ৯৭ শতাংশ। বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক এগিয়ে।

সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বা সংক্ষেপে ইপিআই নামক কর্মসূচির মাধ্যমে সারা দেশে বিনা মূল্যে শিশুদের এ টিকাগুলো দেওয়া হয়। হাম ও ডিপিটি ছাড়াও বিসিজি তথা যক্ষ্মার যে টিকা দেওয়া হয়, তার হার ১৯৮৫ সালে ছিল মাত্র ২ শতাংশ, যা পরবর্তী সময়ে বেড়ে দাঁড়ায় ৯৯ শতাংশে।

টিকা গ্রহণের হার বাড়লেই সেটিকে সাফল্য বলা যাবে না, যদি না তা শিশুমৃত্যুর হার রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। সুখের বিষয় হলো, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহারের (প্রতি হাজারে) নিরিখেও বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় এগিয়ে আছে।

প্রশ্ন হলো, টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশের এ সাফল্যের পেছনে রহস্য কী? বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট ২০১৩ সালে শুধু বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি সিরিজ প্রকাশ করে। সেখানে টিকাদান কর্মসূচিতে এই সাফল্যের পেছনে কমিউনিটি তথা তৃণমূলের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রমকে সাফল্যের প্রধান নিয়ামক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয় ১৯৭৯ সালে এবং এর সেবাদান কার্যক্রম তখন কেবল সরকারি পর্যায় থেকে জেলা ও উপজেলার স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল। টিকা গ্রহণের হারও তখন ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। ১৯৮৫ সালে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিকে নতুন করে ঢেলে সাজানো হয় এবং ১৯৯০ সালের মধ্যে সর্বজনীন টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৮৫-১৯৯০) মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য খাতে টিকাদানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং টিকাদানকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠকর্মীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে টিকাদান কার্যক্রমকে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, এ পুরো প্রক্রিয়ায় তৃণমূলের সার্বিক অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া হবে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্যাটেলাইট ক্লিনিকগুলোতে গ্রামের স্থানীয় জনগণকে জায়গা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। টিকাদান কর্মসূচির নানা স্তরে গ্রামের সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করা হয় ও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তাঁদের নানা কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়।

এ কার্যক্রম শুরু করার মাত্র চার বছরের মধ্যে প্রায় সর্বজনীন টিকা গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়ে যায়। ১৯৮৫ সালে যেখানে টিকা গ্রহণের হার ছিল ৫ শতাংশের নিচে, ১৯৮৯ সালের জরিপমতে, টিকা গ্রহণের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৮২ শতাংশে। এ কার্যক্রমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এনজিওগুলোকে এ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা। যদিও টিকাদানের মূল কাজটি সরকারই করে, কিন্তু এর জন্য ব্যাপক কমিউনিটি জনসংযোগ ও এ কাজের প্রতি তৃণমূলের সংহতি সৃষ্টির কাজটি করে বিভিন্ন এনজিও।

এসবের বাইরেও বাংলাদেশ সরকার বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান ও সুশীল সমাজের সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ইপিআইয়ের গ্রহণযোগ্যতা ও ব্যবহার বাড়াতে ভূমিকা গ্রহণ করে। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর জাতীয় টিকাদান দিবস পালন করা হচ্ছে, যেখানে সংবাদমাধ্যমসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট দিনে ছয় লাখ স্বেচ্ছাসেবক সারা দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ শিশুকে পোলিও টিকা ও ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ায়।

বাংলাদেশের ইপিআই কার্যক্রম বিশ্বে অনুকরণীয় একটি দৃষ্টান্ত। এই সাফল্যের অংশীদার কোনো ব্যক্তি বা সরকারবিশেষ নয়, এই সাফল্যের মূল কুশীলব বাংলাদেশের জনসাধারণ।

 ড. তৌফিক জোয়ার্দার: জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ