তাঁর নাম রুনু ভেরোনিকা কস্তা। ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স। এই হাসপাতালে বা দেশের অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে আরও অনেক সিনিয়র স্টাফ নার্স কাজ করছেন। রুনু অন্য সবার চেয়ে আলাদা।
আপনি কি জানেন, কত বড় কাজ করেছেন? টিকা নেওয়ার আগে কি জানতেন, আপনি ইতিহাসের অংশ হতে যাচ্ছেন? দেড় মাসে এই প্রশ্নগুলো রুনু ভেরোনিকা কস্তার কাছে পুরোনো হয়ে গেছে। বললেন, ‘টিকা দেওয়ার সময় এটা ভাবিনি। এখন বুঝতে পারি ঘটনা বড় ছিল।’
মহামারির সময় হাসপাতালে করোনা রোগীদের সেবা করেছেন রুনু। করোনার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে ২৭ জানুয়ারি দেশে সবার আগে তিনিই টিকা নিয়েছিলেন। তাঁর টিকা নেওয়ার মধ্য দিয়ে মহামারি নিয়ন্ত্রণে নতুন অধ্যায় শুরু করে বাংলাদেশ।
সেদিন রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতালে মহামারি নিয়ন্ত্রণে টিকাদান অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর উপস্থিতিতে পাঁচজনকে টিকা দেওয়া হয়। টিকা দেওয়ার শুরুতে প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করেন, ‘ভয় পাচ্ছ না তো?’ টিকাদান শেষেও তিনি এই জ্যেষ্ঠ নার্সকে শুভেচ্ছা জানান।
রুনু কি ভয় পেয়েছিলেন? উত্তর—‘একদমই না।’ যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে ৪ মার্চ রুনু ভেরোনিকার সঙ্গে কথা হয় তাঁর কর্মস্থলে বসে। হাসপাতালের নার্সিং সুপারিনটেনডেন্টসহ আরও পাঁচজন আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। তাঁরা বলছেন, নার্সিং পেশাকে সমাজ এখনো প্রাপ্য সম্মান দেয়নি।
গাজীপুর জেলার পুবাইল থানার পদহারবাইদ গ্রামে ‘টানাটানির’ সংসারে রুনু ভেরোনিকার জন্ম। বাবা ছিলেন কৃষক। মা ছোট চাকরি করতেন, বাড়ি বাড়ি জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী পৌঁছে দিতেন। এলাকার ভাদুন ফাতিমা রানী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। পরিবারের পক্ষে খরচ চালানো সম্ভব ছিল না। সাভারের ধরেন্ডা এলাকায় ফুফুর বাড়িতে থেকে সেন্ট যোসেফ স্কুলে মাধ্যমিক শেষ করেন। ১৯৯৮ সালে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের কুমুদিনী নার্সিং কলেজে ভর্তি হয়ে ২০০২ সালে ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেন।
ছেলেটাকে আমি নিজেই পড়াই। কোনো প্রাইভেট টিচার নেই। মেয়েটাকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত নিজে পড়িয়েছি। তখনো প্রাইভেট টিচার রাখিনি,’ বললেন রুনু। হাসপাতালের ডিউটি সেরে বাসায় ফিরে পড়াতে পারতেন? তাঁর উত্তর, ‘আমরা সব পারি।’
রুনু ভেরোনিকার বর্ণনা, ‘কলেজে পড়ার সময় মা বিদেশে চাকরি করতেন। তখন মুঠোফোন ছিল না। মা তাঁর কথা রেকর্ড করে টেপ পাঠাতেন। বলতেন, “বিয়ে কইরো না।” মা চাকরি করতে বলতেন।’
২০০৫ সালে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চাকরিতে ঢোকেন। একই বছরে বিয়ে। স্বামী পবন গোমেজ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে প্রশাসন বিভাগে চাকরি করেন। মেয়ে প্রথা গোমেজ নবম ও ছেলে প্রয়াস গোমেজ তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করেন। ঘরও সামলান দুজন মিলে।
‘ছেলেটাকে আমি নিজেই পড়াই। কোনো প্রাইভেট টিচার নেই। মেয়েটাকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত নিজে পড়িয়েছি। তখনো প্রাইভেট টিচার রাখিনি,’ বললেন রুনু। হাসপাতালের ডিউটি সেরে বাসায় ফিরে পড়াতে পারতেন? তাঁর উত্তর, ‘আমরা সব পারি।’
নারীরা কি সমাজে সম্মান, মর্যাদা পাচ্ছেন? রুনু ভেরোনিকা বলেন, ‘আমাদের যতটা সম্মান, মর্যাদা পাওয়ার কথা, ততটা পাই না।’
স্বামী ও ছেলে-মেয়ে নিয়ে উত্তরায় থাকেন এই সিনিয়র স্টাফ নার্স। উত্তরা থেকে কর্মস্থলে বাসে যাওয়া-আসা করেন। রাস্তার সমস্যা তুলে ধরে বলেন, ‘নারীদের নির্ধারিত সিটে পুরুষ বসে থাকে। বাসের হেলপাররা ওই তালেই তাল দেয়।’
প্রথমে টিকা নেওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট তেরেজা বাড়ৈয়ের কাছ থেকে, মুঠোফোনে। ভাবার জন্য রুনু সময় নিয়েছেন। নার্সিং পেশায় থাকা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এক বোনের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। সবশেষে জানতে চেয়েছিলেন স্বামী পবন গোমেজের মতামত। স্বামী বলেছিলেন, ‘টিকা হবে তোমার বেঁচে থাকার আলো।’