শাড়ি বাঙালি নারীর প্রধান পরিধেয় বস্ত্র, তা সুপ্রাচীনকাল থেকেই। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও শাড়ির প্রচলন আছে। তবে বঙ্গদেশে শাড়ির সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্ন-প্রমাণ পাওয়া গেছে চন্দ্রকেতুগড় (খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয়-প্রথম শতক) থেকে প্রাপ্ত একাধিক পোড়ামাটির ফলকে। পাহাড়পুরের (অষ্টম শতক) কিছু পোড়ামাটির ফলকেও শাড়ি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে প্রাচীনকালে এসব শাড়ি পরার ধরন এখনকার মতো ছিল বলে মনে হয় না। তখন অনেকটা ধুতির মতো শরীরের নিচের অংশে শাড়ি পরা হতো।
অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব বইয়ে লিখেছেন, ‘আজিকার দিনের বাঙালী নারীরা যেভাবে কোমরে এক বা একাধিক প্যাঁচ দিয়া আধোবাস রচনা করেন প্রাচীন পদ্ধতিও তদনুরূপ, তবে আজিকার মতন প্রাচীন বাঙালী নারী শাড়ির সাহায্যে উত্তরবাস রচনা করিয়া দেহ আবৃত করিতেন না; তাঁহাদের উত্তর-দেহাংশ অনাবৃত রাখাই ছিল সাধারণ নিয়ম।’
অঞ্চলভেদে শাড়ি পরিধানের ধরন ও পদ্ধতিতে ভিন্নতা আছে। কালের বিবর্তনে, বিভিন্ন সংস্কৃতির পারস্পরিক সংমিশ্রণে এবং সম্ভবত সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রয়োজনে বাঙালি নারীর শাড়ি পরার ধরনেও নানা পরিবর্তন ঘটেছে। পরিবর্তন ঘটেছে শাড়ি বয়নের কৃৎকৌশল, রঞ্জনপদ্ধতি ও নকশায়।
২.
সংস্কৃত ‘তন্তু’ থেকে বাংলা ‘তাঁত’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত তাঁতযন্ত্রের নানা রকম প্রকারভেদ আছে। যেমনপিট লুম বা গর্ত তাঁত, ফ্রেম লুম, চিত্তরঞ্জন বা জাপানি তাঁত, কোমর তাঁত ইত্যাদি। প্রাচীনতার দিক দিয়ে পিট লুম বা গর্ত তাঁতকে বাংলা অঞ্চলের আদি তাঁত বলা যেতে পারে। বাংলার বিখ্যাত মসলিন ও অন্যান্য বস্ত্র এই পিটলুম বা গর্ত তাঁতেই তৈরি হতো। সাধারণ বাঁশ, কাঠ ইত্যাদি সহজলভ্য জিনিস দিয়েই এই তাঁত তৈরি হতো। ঢাকার কাছে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে রূপগঞ্জ-সোনারগাঁ অঞ্চলে এখনো সাধারণ গর্ত তাঁতেই নকশাদার জামদানি শাড়ি বয়ন করা হয়।
বাংলাদেশে ফ্রেম লুম, চিত্তরঞ্জন বা জাপানি তাঁত এবং সেই সঙ্গে ফ্লাই সাটল, ডবি বা জ্যার্কাড মেশিন ইত্যাদির প্রচলন ঘটেছে অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালে।মোটামুটি বিশ শতকের প্রথমার্ধে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে বঙ্গীয় শিল্প ও কৃষি বিভাগের নানা তৎপরতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁতযন্ত্রের আধুনিকায়ন ঘটেছে। শাড়ি তৈরির কৃৎকৌশলেও এই আধুনিকতার প্রভাব পড়েছে। বর্তমানে নরসিংদী, টাঙ্গাইল কিংবা সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব শাড়ি ও অন্যান্য বস্ত্র বয়ন করা হয়, তা এই সব ভিনদেশি কৃৎকৌশল রপ্ত ও আত্মস্থ করে বাংলাদেশের তাঁতিরা তাঁদের কাজের ধারা অব্যাহত রেখেছেন।
পিট লুম বা গর্ত তাঁত আমাদের দেশে প্রচলিত সবচেয়ে পুরোনো তাঁতযন্ত্র, যা দিয়ে এখনো ঐতিহ্যবাহী জামদানি তৈরি হয়। এই তাঁতের সঙ্গে পরে যুক্ত হয়েছে ‘ফ্লাই সাটল’, অর্থাৎ যেখানে মাকুকে আর হাত দিয়ে ছুড়তে হয় না, বরং মাকুটি একটি টানেলের মধ্যে থাকে এবং একটি দড়ির হাতলের সাহায্যে তাঁতি কম সময়ে এবং দ্রুতগতিতে টানা সুতোর ভেতর দিয়ে মাকুটি চালিয়ে দিতে পারেন। এর ফলে কাপড় বোনা দ্রুততর হয়। এটা ‘ঠকঠকি তাঁত’ নামেও পরিচিত। এই ‘ফ্লাই সাটল’ অবশ্য ফ্রেম লুমের সঙ্গেও যুক্ত করা যায়। টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শাড়ি বুনতে এই ঠকঠকি তাঁত বা ফ্লাইসাটল লুম ব্যবহার করা হয়। তবে বর্তমানে শাড়ি বয়নে প্রচুর পরিমাণে চিত্তরঞ্জন বা জাপানি তাঁত ব্যবহৃত হচ্ছে। এই তাঁতযন্ত্রকে ‘সেমি-অটোমেটিক’ বলা যেতে পারে। এর উৎপাদনক্ষমতা অপেক্ষাকৃত বেশি।
এইসব তাঁতযন্ত্রের সঙ্গে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে আরও যুক্ত হয়েছে নকশার জন্য ডবি ও জ্যাকার্ড মেশিন। এই দুটি মেশিনের সাহায্যে দ্রুত ও সহজে বিভিন্ন ধরনের জটিল ডিজাইন বয়ন করা সম্ভব হয়। সাধারণ নকশার জন্য ডবি এবং অপেক্ষাকৃত জটিল নকশার জন্য জ্যাকার্ড মেশিন ব্যবহৃত হয়। জ্যাকার্ড মেশিনকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ‘জ্যাকেট’ বা ‘মালা’।
৩.
তাঁতের শাড়ি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অবধারিতভাবে ঢাকাই শাড়ির কথা এসে পড়ে। ঢাকাই শাড়ির উদাহরণ হিসেবে আমরা জামদানির উল্লেখ করতে পারি, যা ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এখনো টিকে আছে। যদিও জামদানি ছাড়াও ঢাকায় আরও বহু ধরনের শাড়ি তৈরি হতো। বুননকৌশলের দক্ষতা ও মিহি বস্ত্রের জন্য ঢাকাই শাড়ির খ্যাতি সর্বজনবিদিত।
আঠারো শতকের শেষার্ধে পশ্চিমবাংলার মুর্শিদাবাদে জিয়াগঞ্জ এলাকার একাংশে বিশেষ ধরনের নকশাযুক্ত রেশমি কাপড়ের উদ্ভব ঘটেছিল। এই বিশেষ রীতির বস্ত্র ‘বালুচরি’ নামে খ্যাতি অর্জন করে। বালুচরির মূল বৈশিষ্ট্য এর নকশা। সে সময় তাঁতে ইচ্ছেমতো নকশা করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু বালুচরির বয়নশিল্পীরা দেশীয় তাঁত ব্যবহার করেই এমন একটি পদ্ধতি বা কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন যে অনেক জটিল ডিজাইনও তাঁতে বোনা সম্ভব হয়েছিল। উনিশ শতকের মধ্যেই, বড়জোর বিশ শতকের প্রথমার্ধে প্রকৃত বালুচরি শাড়ি বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে এখনো বালুচরি শাড়ি তৈরি হয়, তবে তা জ্যাকার্ড মেশিনের সাহায্যে।
মূলত বিভিন্ন প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ—বিভিন্ন ধরনের ফুল, লতাপাতা, পাখি, প্রজাপতি, ময়ূর ইত্যাদি। এই ধারা আজও অব্যাহত। উন্নত বয়নকৌশলের পাশাপাশি, নকশার নানামুখী আত্তীকরণ ও সংযোজন টাঙ্গাইলের শাড়ির বিশেষ বৈশিষ্ট্য।জামদানি ও বালুচরি ছাড়া নকশার নিরিখে টাঙ্গাইলের শাড়ি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির প্রাথমিক খ্যাতি এর বুননকৌশল ও কাপড়ের সূক্ষ্মতার জন্য এবং এজন্য বসাক তাঁতিরা বিশেষ কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। টাঙ্গাইলের বসাক তাঁতিরা আসলে দেশান্তরি তাঁতি, যাঁদের আদিবাস ঢাকা ও ধামরাই। সম্ভবত উনিশ শতকে ঢাকাই মসলিনের দুর্দিন শুরু হলে তাঁরা টাঙ্গাইলে দেশান্তরি হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৪৭–এর দেশভাগের অভিঘাতে এই টাঙ্গাইলের তাঁতিদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পশ্চিমবাংলার ফুলিয়া, সমুদ্রগড়, ধাত্রীগ্রাম ইত্যাদি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং নতুন উপনিবেশ গড়ে তোলে। এভাবে টাঙ্গাইল শাড়ির নতুন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে পশ্চিমবাংলায়।
টাঙ্গাইলের শাড়ির বর্তমান খ্যাতি সূক্ষ্ম বুনটের পাশাপাশি এর বিচিত্র ও আকর্ষণীয় নকশার জন্য। এই বৈচিত্র্যময় নকশার সূত্রপাত বিশ শতকের প্রথমার্ধে, যখন ডবি ও জ্যাকার্ড মেশিনের প্রচলন ঘটেছে। এই নতুন প্রযুক্তি আয়ত্ত করে নান্দনিক নকশাসমৃদ্ধ শাড়ি বয়নের জন্য বসাক তাঁতিদের বিশেষ কৃতিত্ব দিতে হবে। পরবর্তীকালে স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের তাঁতিরাও বসাক তাঁতিদের পথ অনুসরণ করেছেন। এই প্রযুক্তিগত উন্নতির আগে টাঙ্গাইলের শাড়ির নকশা ছিল সরল, অনেকটা জ্যামিতিক ধরনের। সঙ্গে ছিল বুটির কাজ। কিন্তু পরবর্তীকালে ডবি ও জ্যাকার্ড মেশিনের প্রচলন ঘটার পর জটিল ও কঠিন ডিজাইন শাড়িতে ফুটিয়ে তোলায় আর কোনো অসুবিধা রইল না। ফলে বিভিন্ন বিষয়বস্তু ও মোটিফ নকশায় চলে এল, যা মূলত বিভিন্ন প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ—বিভিন্ন ধরনের ফুল, লতাপাতা, পাখি, প্রজাপতি, ময়ূর ইত্যাদি। এই ধারা আজও অব্যাহত। উন্নত বয়নকৌশলের পাশাপাশি, নকশার নানামুখী আত্তীকরণ ও সংযোজন টাঙ্গাইলের শাড়ির বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
এ ছাড়া পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চল তাঁতের শাড়ির জন্য বিখ্যাত। এগুলো ‘পাবনা শাড়ি’ নামে পরিচিত। পাবনা শাড়ি তৈরি করতেন (এবং এখনো করা হয়) মূলত মুসলমান তাঁতিরা। এই শাড়ি অপেক্ষাকৃত কম দামি এবং নকশার কাজও টাঙ্গাইল শাড়ির তুলনায় কম। নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের মধ্যে এই শাড়ি বেশি জনপ্রিয়। বর্তমানে পাবনা-সিরাজগঞ্জ আঞ্চলের শাড়ির নকশাও ডবি ও জ্যাকার্ড মেশিনের সাহায্যে তৈরি হয়।
আরেক ধরনের তাঁতের শাড়ি বাংলাদেশে নকশার কারণে বিশেষ বিখ্যাত, সেটা হলো বেনারসি বা ঢাকাই কাতান। বিশ শতকের চল্লিশের দশকের গোড়ায় ভারতের বেনারস থেকে কিছু মোহাজির ঢাকায় এসে বাস করতে শুরু করেন এবং বেনারসি কাতান বয়ন আরম্ভ করেন। দেশভাগের পর বেনারস থেকে এসে আরও কিছু তাঁতি তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন।পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় এই মোহাজির তাঁতিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় পুরান ঢাকায় স্থানসংকুলান না হওয়ায় এই বেনারসি তাঁতিরা প্রথমে মোহাম্মদপুর ও পরে মিরপুর অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। ঢাকার মিরপুরে এখন বাঙালি ও বিহারি—উভয় সম্প্রদায়ই বেনারসি বয়নের কাজে যুক্ত। ইতিমধ্যে ঢাকা ছাড়াও আরও কয়েকটি স্থানে বেনরসি বয়ন শুরু হয়েছে। যেমন রংপুরের গঙ্গাচরা, টঙ্গীর কাছে গুটিয়া গ্রাম ইত্যাদি। বেনারসি বয়নে পিট লুমের সঙ্গে জ্যাকার্ড মেশিন ব্যবহার করা হয়। ভারতের আদি বেনারসি শাড়িতে বিভিন্ন দেবদেবী, পশুপাখি, ফুল-লতাপাতা ইত্যাদি দেখা গেলেও সম্ভবত ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশের বেনারসি শাড়িতে শুধু ফুল-লতাপাতা ও জ্যামিতিক নকশা দেখা যায়।
তবে বেনারসি ছাড়াও বাংলাদেশে রাজশাহী অঞ্চলে গরদের শাড়ি তৈরির ঐতিহ্য ছিল, যা এখন বিলুপ্তপ্রায়। গরদের শাড়িতে হালকা ঘিয়ে বা গজদন্ত বর্ণের জমিন এবং পাড়ে লাল, সবুজ কিংবা অন্য কোনো রঙের নকশা থাকত। কখনো কখনো পাড়ে জরির কাজও থাকত।
৪.
বাংলাদেশের তাঁতের শাড়ি বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রতীক। ষাট ও সত্তরের দশকে, স্বাধীনতা আন্দোলনের আগে ও পরে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিশেষভাবে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। এর সূত্র ধরে বাংলাদেশে তাঁতের শাড়ি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও এলিট শ্রেণি—এই শহুরে নাগরিক পরিসরে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়ে ওঠে। ঢাকায় আশির দশকের গোড়ায় টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির এবং পরবর্তীকালে আরও অনেক বুটিক হাউস বা ফ্যাশন হাউসের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে। শহরের মানুষের রুচি ও নান্দনিকবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তাঁতের শাড়ি তৈরি ও বিপণনে এই সব ফ্যাশন হাউসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। উৎসবে-পার্বণে, বিশেষ কোনো উপলক্ষে বাঙালি নারীরা এখনো তাঁতের শাড়ি পছন্দ করেন। তাঁতের শাড়ি বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
শাওন আকন্দ : চারুশিল্পী ও গবেষক