বাংলাদেশি হাতে আল-জাজিরার লোগো

নুরুল হক l ছবি: লেখকের সৌজন্যে
নুরুল হক l ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ছোটবেলা থেকে আঁকাআঁকি এবং হাতের লেখার প্রতি আমার আকর্ষণ অনুভব করি। বাংলা, আরবি, উর্দু, ফারসিসহ নানা ভাষার অক্ষরগুলো কতভাবে লেখা যায়, কীভাবে সুন্দর করে সেসব পরস্পরে সাজানো যায়, এ নিয়ে আমি ভাবতাম। খ্যাতিমান ক্যালিগ্রাফারদের লেখাগুলো দেখে সেভাবে লেখার চেষ্টা করতাম। এই বীজ সৃষ্টিগতভাবেই হয়তো আমার মধ্যে বোনা পরম সৃষ্টিকর্তার হাতে।
গত দেড় যুগের বেশি সময় ধরে কাতারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার লোগো, নামফলকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমার হাতের লেখা কাতার ও অন্যান্য দেশের লোকদের ভালো লেগেছে, এটা আমার প্রাপ্তি। তবে এসব নিয়ে খুব বেশি আত্মতৃপ্তি নেই আমার। একজন হস্তাক্ষরশিল্পী বা ক্যালিগ্রাফার হিসেবে নীরবে কাজ করে যাওয়াই আমার সাধনা। কাতারে যেসব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের জন্য আমি এ যাবৎ কাজ করেছি, সেসবের অনেক নমুনাও এতদিন আমার কাছে ছিল না। তবে এখন ভাবছি, কিছু নমুনা ও উদাহরণ নিজের কাছেও রাখব।
কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থিত বিশ্বখ্যাত টিভি চ্যানেল আল-জাজিরার বর্তমান যে লোগো, এটির সর্বশেষ আকার ও আকৃতির সঙ্গে আমার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। চ্যানেলটি প্রতিষ্ঠার পর এর লোগোটি এমন গোছালো, দৃষ্টিনন্দন ও নিখুঁত ছিল না। আল-জাজিরা কতৃর্পক্ষ ২০০২ সালে এই লোগোকে আরও সুন্দর করার জন্য আমি যে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলাম, সেখানে একটি প্রস্তাব পাঠায়। ওই প্রতিষ্ঠানের শিল্প ও চিত্রকলার প্রধান হিসেবে দায়িত্বটি এসে পড়ে আমার ওপরে। একজন বাংলাদেশি হস্তাক্ষরশিল্পী হয়েও এভাবে আমি জড়িয়ে গেলাম একটি আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেলের লোগো তৈরির কাজে।
সেই থেকে আজও আমি আল-জাজিরার সঙ্গে জড়িয়ে হয়ে আছি। তাদের প্রযোজনে নিয়মিত করে দিচ্ছি নানা রকম ক্যালিগ্রাফির কাজ। শুধু তা-ই তো নয়, শিশু-কিশোরদের জন্য আল-জাজিরার চ্যানেল ‘জিম’-এ আরবি ক্যালিগ্রাফির প্রশিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে চলেছি। কাতার ও আরববিশ্বের শিশুদের আরবিতে হাতের লেখা শেখানো থেকে শুরু করে ক্যালিগ্রাফির নানা রীতিনীতি আমার কাছে তারা শিখছে। সেসব অনুষ্ঠান নিয়মিত প্রচারিতও হচ্ছে জিম চ্যানেলে। বিশেষ করে পবিত্র রমজান মাসজুড়ে এসব নিয়ে ব্যস্ততায় অন্য কিছু করার মতো অবসর আর হয়ে ওঠে না।

আল–জাজিরার এই লোগোর নকশাকার নুরুল হক

আল-জাজিরা নেটওয়ার্কের অধীনে প্রতিষ্ঠানের গোণাগুনতি নেই। তাদের যেকোনো আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান হলেই আমাকে তারা আমন্ত্রণ জানায়। অনুষ্ঠানের জন্য প্রতিপাদ্য লেখা, লোগো তৈরি, মূল ব্যানারে আরবিতে শিরোনাম লেখাসহ নানা বিষয়ে আমি তাদের সহযোগিতা করি। এ ছাড়া আল-জাজিরার পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বদের যেসব উপহার দেওয়া হয়, সেসবে তাঁদের নাম আরবিতে নকশাদার হস্তাক্ষর রচনার দায়িত্বও পড়ে আমার ওপর। বছরজুড়ে অনুষ্ঠিত আল-জাজিরা নেটওয়ার্কের নানা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে যে চেক তুলে দেওয়া হয়, তাতেও বিজয়ীদের নাম ও বিভিন্ন তথ্য আমি লিখে থাকি।
দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে আমি কাজ করেছি কাতারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পর্যটন মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন অফিসের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে আমার হাতে আঁকা আরবি ক্যালিগ্রাফি। কাতার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত ভ্রমণগাইডের বিভিন্ন আলপনা ও ক্যালিগ্রাফি আমার হাতেই করিয়েছে তারা।
কাতার ফাউন্ডেশনে অবস্থিত ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারু ও শিল্পকলার ছাত্ররা কয়েক বছর ধরে আমার কাছ থেকে পাঠ নিচ্ছে। আরবি অক্ষরের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে যে শিল্পরীতিগুলো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, সেসব শেখাতে আমি তাঁদের সহযোগিতা করছি।
ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জার্মান অধ্যাপক আমার কাজের খুবই অনুরাগী। প্রায়ই তিনি তাঁর ছাত্রছাত্রীদের তাঁদের নানা প্রকল্পে সহায়তার জন্য আমার কাছে পাঠান। বিশেষ করে আরবি খত্তে সুলুস রীতির জন্য আমার কাছে তাঁরা আসেন। মাঝেমধ্যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি শিল্পকলা বিষয়ে বিভিন্ন কোর্সেও আমি অতিথি প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। সেখানে বলার চেষ্টা করেছি, কীভাবে এই শিল্পে নিজের মানবিক সৌন্দর্য আরও গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়।
আরবি অক্ষর লেখা ও অঙ্কনের নানা মাধ্যমে আমি কাজ করছি। রুকআ, সুলুস, কুফিসহ আরবি শিল্পকলার নানা ধারায় নিজেকে শাণিত করার চেষ্টা করছি কয়েক দশক ধরে। কাতারের বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত গোত্রের বিয়েসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র তারা আমাকে দিয়ে লেখাতে চায়। এ ছাড়া কাতারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মানপত্র ও সনদও লিখেছি। এঁকে দিয়েছি কাতার বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক দিবসগুলোয় লোগো ও প্রতিপাদ্য।

একজন বাংলাদেশি হস্তাক্ষরশিল্পী হয়েও এভাবে আমি জড়িয়ে গেলাম একটি আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেলের লোগো তৈরির কাজে

আরবি শিল্পকলার বিভিন্ন বিষয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ যাঁর কাছ থেকে তালিম নিয়েছি, কাকতালীয়ভাবে তাঁর নামও মাওলানা নুরুল হক। বর্তমানে কাতারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে উপদেষ্টা ও পরামর্শক হিসেবে তিনি অবদান রেখে চলেছেন। শুধু তা-ই নয়, নিজের হাতে তিনবার তিনি পুরো পবিত্র কোরআন শরিফ লিখেছেন। এর মধ্যে দুটো ছাপা হয়েছে বাংলাদেশের দুটি লাইব্রেরির পক্ষ থেকে। আরেকটি তিনি লিখেছিলেন কাতারের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্তী ও ধর্মমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ বিন খালেদ আলথানির অনুরোধে।
এখানেই শেষ নয়, কাতারজুড়ে আরব শিশুরা যে কায়দার মাধ্যমে বর্ণমালা শেখার সূচনা করে, এটি তাঁর হাতের লেখা। বাংলাদেশের নুরানি পদ্ধতিকে তিনি কাতারে প্রবর্তন করেছেন। সরকারিভাবে এটি এখন কাতারে অনুমোদিত ও সমাদৃত। তবে এত গুরুত্বপূর্ণ কর্ম ও অবদানের পরও তিনি শখের বশেই আরবি ক্যালিগ্রাফি চর্চা করেছেন, পেশা হিসেবে নয়।
এ পর্যন্ত বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। তার পরও আমি নির্দ্বিধায় বলব, আরবি শিল্পকলার এই সুবিশাল অঙ্গনে আমি অতি নগণ্য একজন শিল্পী। আমি আজও শিখছি। যুগ যুগ ধরে যেসব আরবি শিল্পীর অসামান্য অবদানে আজ আরবি ক্যালিগ্রাফি-শিল্প এত সমৃদ্ধ, তাঁদের তুলনায় নিজেকে অতি ক্ষুদ্র বলে মনে হয়। তবু চেষ্টা করে যাচ্ছি, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের একজন হস্তাক্ষরশিল্পী হিসেবে আরবি ভাষা ও শিল্পকলার সেবায় নিজেকে নিবেদিতপ্রাণ করতে।

লেখক পরিচিতি
কাতারে হস্তাক্ষরশিল্পী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন নুরুল হক। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার লোগো এঁকেছেন কাতারপ্রবাসী এই শিল্পী। এই শিল্পরীতি শেখানোর জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর দারুণ কদর।


সেসব কীর্তিগাথা শোনাচ্ছেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করা কয়েকজন প্রবাসী: