‘পেটে ভাত পরনে কাপড়’—দুটোরই অভাব ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রায় শূন্য অর্থনীতির সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। গত প্রায় পাঁচ দশকে বাংলাদেশ অন্ন ও বস্ত্র—দুটি খাতেই সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। উন্মুক্ত বাণিজ্য এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উত্থান—এ দুই কারণে বস্ত্রশিল্প উঠেছে অনন্য উচ্চতায়। এর ফলে ‘পরনের কাপড়’–এর অভাব এখন আর নেই বললেই চলে।
জানা যায়, ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৮০০ কোটি মিটার কাপড় প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ ১৭ কোটি মানুষ প্রতিবছর ৩০–৩৫ মিটার কাপড় ব্যবহার করে থাকেন। এই বিপুল পরিমাণ কাপড়ের চাহিদা পূরণ হয় হস্তচালিত তাঁত বা হ্যান্ডলুম এবং বিদ্যুচ্চালিত তাঁত বা পাওয়ারলুম—এই দুই শিল্পে উৎপাদিত কাপড় থেকে।
চাহিদার জোগান: হস্তচালিত তাঁত
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও বস্ত্র উৎপাদনের জন্য হস্তচালিত তাঁত বা হ্যান্ডলুম হচ্ছে প্রাচীন শিল্প। এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বয়নশিল্পীরা হস্তচালিত তাঁতযন্ত্রে উৎপাদিত মোটা ও সূক্ষ্ম কাপড় দিয়ে সুদীর্ঘকাল থেকে অভ্যন্তরীণ কাপড়ের চাহিদা পূরণ করে আসছে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় তন্তুবায় সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করত এবং এখনো করে। এ সম্প্রদায়ের মূল কাজ ছিল বিভিন্ন ধরনের তাঁতযন্ত্রে মূলত সুতির কাপড় তৈরি করা। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বয়নশিল্পীরা হ্যান্ডলুমেই তৈরি করতেন এবং এখনো করেন রেশমের কাপড়। তাঁতিদের একাংশ নিজেরা বস্ত্র বিপণনের কাজে যুক্ত থাকলেও বিপণনের মূল কাজের জন্য ছিল আলাদা মানুষ। ঐতিহাসিক কাল থেকে তাঁত–অধ্যুষিত বিশাল জনপদে তাঁতশিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল মানুষের জীবনযাত্রা এবং বাণিজ্যের নিজস্ব ধরন। একসময় বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বয়নশিল্পীরা দিল্লির মোগল দরবারে যেমন জোগান দিত সূক্ষ্ম মসলিন কাপড়, তেমনি সাধারণ মানুষের জন্য জোগান দিত বিভিন্ন পরিধেয় বস্ত্র।দ্বিতীয় ধারাটি এখনো প্রবহমান। হস্তচালিত তাঁতশিল্প থেকে উৎপাদিত হয় মূলত মোটা ও সরু সুতির শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, ধুতি, থ্রিপিসের কাপড়, ওড়না, সিল্কের কাপড়, থান কাপড়।
অতীতের মতো সংখ্যায় ‘বিপুল’ না হলেও এখনো বয়নশিল্পী সম্প্রদায় শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি, গামছা, থান কাপড় এবং হোসিয়ারি পণ্য তৈরি করে অভ্যন্তরীণ কাপড়ের মোট চাহিদার একটা বড় অংশের জোগান দিয়ে চলেছে। সিরাজগঞ্জ সদর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, এনায়েতপুর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা; পাবনা সদর, চাটমোহর, হরিপুর; ঈশ্বরদী উপজেলার শত শত গ্রাম; টাঙ্গাইলের কালিহাতী, দেলদুয়ার, সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম; ঢাকা বিভাগের নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ইত্যাদি জেলার শত শত গ্রামসহ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, খুলনা, যশোর, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকায় এই যন্ত্রচালিত তাঁতশিল্পের প্রতাপের যুগেও তৈরি হয় শাড়ি, লুঙ্গি, গামছাসহ বিভিন্ন ধরনের তাঁতবস্ত্র। হ্যান্ডলুমে তৈরি এই কাপড়ই ছিল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের নিত্যব্যবহার্য। বাংলাদেশে বসবাসকারী মণিপুরি, চাকমা, মারমা, গারো, সাঁওতালসহ প্রতিটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব বস্ত্রবয়নের ইতিহাস রয়েছে। এখন সীমিত হলেও একসময় প্রতিটি আদিবাসী সম্প্রদায় নিজেদের ব্যবহারের কাপড় নিজেরাই তৈরি করত। কারিগরি উন্নয়নের এ যুগে সেই ধারা পুরোপুরি না থাকলেও একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণের কাপড় আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো নিজেরাই উৎপাদন করে চলেছে। উপরন্তু বাংলাদেশের মূল বস্ত্র খাতে বৈচিত্র্যময় ফ্যাশনের অংশ হিসেবে কোনো কোনো আদিবাসী সম্প্রদায় জোগান দিয়ে চলেছে তাদের তাঁতবস্ত্র।
ফ্যাশন হাউস থেকে বিদেশে
বাংলাদেশের তন্তুবায় সম্প্রদায় আবহমানকাল ধরে মোটামুটি সব ধরনের কাপড় তৈরি করত। এগুলোর মধ্যে নিত্যব্যবহার্য কাপড়চোপড় যেমন ছিল, তেমনি ছিল মলমলখাস, শবনম ইত্যাদির মতো বিলাসী বস্ত্র। ছিল রেশম, জামদানির মতো দামি কাপড়। ছিল শীত নিবারণের মোটা বস্ত্র। একুশ শতকে এসে তাঁতযন্ত্রে তৈরি কাপড়ের বৈচিত্র্য বেড়েছে। শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি, গামছা, থান কাপড়ে সীমাবদ্ধ না থেকে নারীদের জন্য থ্রিপিসের কাপড়, ওড়না ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার হস্তচালিত তাঁতে। ঢাকার বিভিন্ন বুটিক হাউসসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এর বড় জোগান আসে নরসিংদী, কুমিল্লা ও সিরাজগঞ্জ থেকে। সীমিত পরিমাণ আসে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে। এই ফ্যাশন হাউসগুলো বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী হস্তচালিত তাঁতশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শক্তিশালী স্তম্ভ হিসেবে কাজ করছে। অল্প কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তাদের উন্নয়ন কাঠামোয় হস্তচালিত তাঁতযন্ত্র যুক্ত করেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো চাহিদা অনুসারে তৈরি করে বিভিন্ন ধরনের কাপড়। পরিধেয় বস্ত্র বাদেও বিছানার চাদর তৈরি হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তাঁতে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অঞ্চল কুমারখালী ও নরসিংদী। তাঁতের কাপড় যে শুধু অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটায়, তা নয়। কিছু কিছু অঞ্চল থেকে তাঁতে তৈরি স্যুটের কাপড়, জাপানি নারীদের পরিধেয় কিমোনো, থান কাপড়, বিছানার চাদর ইত্যাদি সীমিত আকারে আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। নরসিংদীর কিছু অঞ্চল এবং নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া রাজশাহী, নোয়াখালীসহ দেশের কয়েকটি শহরের কিছু এনজিও এ বিষয়ে কাজ করছে।
হস্তচালিত তাঁতবস্ত্রের হাটগুলোর দিকে নজর দিলে এবং উৎপাদিত কাপড়কে টাকায় হিসাব করলে তাঁতের কাপড় অভ্যন্তরীণ কত শতাংশ চাহিদা পূরণ করে, তা মোটামুটি বোঝা যাবে। বাংলাদেশের তাঁতের কাপড়ের পুরোনো হাটগুলোর মধ্যে অন্যতম কুষ্টিয়ার পোড়াদহের হাট। প্রায় শতবর্ষী এই হাটের বর্তমানে মাসিক বাণিজ্য কমবেশি ৪০০ কোটি টাকা এবং এই টাকার ৯০ শতাংশ আসে হস্তচালিত তাঁতের কাপড়, যেমন শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ইত্যাদি থেকে। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে হস্তচালিত তাঁত ও তাঁতির সঠিক সংখ্যা এবং উৎপাদিত বস্ত্র অভ্যন্তরীণ চাহিদার কত শতাংশ পূরণ করতে পারে, তার সঠিক পরিমাণ জানা যায় না। তবে সরকারি তথ্য মেনে নিলে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায় দেশের হস্তচালিত তাঁতশিল্প এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষ ও পণ্য বিষয়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০১৮ সালের তাঁতশুমারির ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে দেশে হস্তচালিত তাঁতশিল্পে কাজ করছে ৩ লাখ ১৬ হাজার ৩১৫ জন বয়নশিল্পী। আর ২০০৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ৮৮ হাজার ১১৫ জন। তবে ১৯৯০ সালে সংখ্যাটা ছিল ১০ লাখ ২৭ হাজার ৪০৭ জন। এ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, বার্ষিক প্রায় ৮০০ কোটি মিটার অভ্যন্তরীণ চাহিদার কাপড়ের উল্লেখযোগ্য অংশের জোগান দেওয়া হস্তচালিত তাঁতশিল্পের সংখ্যা দিন দিন কমছে। এটা খুব একটা আশার কথা নয় আমাদের জন্য।
হস্তচালিত তাঁত থেকে কলের তাঁত: চাহিদা ও জোগানের রূপরেখা
১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় তৎকালীন পূর্ব বাংলায় ২৭ হাজার তাঁতসহ ১১টি তাঁতের কারখানা ছিল। পাকিস্তান আমলে কাপড়ের কারখানা বাড়েনি। অটোমেটিক তাঁতে সেসব কারখানায় তৈরি হতো কাপড়। কিন্তু মোট চাহিদার তুলনায় তা ছিল নগণ্য। বাংলাদেশ উত্তরাধিকারসূত্রে এ কারখানাগুলোর মালিকানা পেয়েছিল। এই ১১টি তাঁত কারখানা এবং লাখ লাখ হস্তচালিত তাঁতযন্ত্র সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের কাপড়ের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করেছে প্রথম পর্বে। পরবর্তীকালে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি খাতের আরও পাওয়ারলুম কারখানা।
বিভিন্ন কারণে একদিকে হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা যেমন ধীরে ধীরে কমেছে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যন্ত্রচালিত তাঁত বা পাওয়ারলুম শিল্প। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই তৈরি পোশাকশিল্প এখন দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার বড় অংশের জোগানদার। শুধু তা–ই নয়, এই শিল্প এখন দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত এবং সংগত কারণে এ খাত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় খাতগুলোর অন্যতম। বিটিএমএর তথ্য জানাচ্ছে, দেশে সবচেয়ে বেশি ৮০২টি মিল রয়েছে ওভেন কাপড় তৈরির জন্য। ৩২টি মিল ডেনিম তৈরির জন্য এবং হোম টেক্সটাইল মিলের সংখ্যা ২২। ২০১৭ সালে ৭৯৬টি মিলে ৩৫৮ কোটি মিটার কাপড় উৎপাদিত হয়েছে বাংলাদেশে, যেখানে ২০১১ সালে উৎপাদিত কাপড়ের পরিমাণ ছিল ২১৫ কোটি মিটার। নিবন্ধিত মিলগুলোর বাইরেও বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু ছোট ছোট মিল রয়েছে। যেগুলোতেও তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের কাপড়। এই মিলগুলো স্থানীয়ভাবে ওভেন, ডেনিম ও নিট কাপড় সরবরাহ করে থাকে। এই কাপড় থেকে স্থানীয়ভাবে তৈরি হয় শার্ট, প্যান্ট, দেশীয় জিনস, টি–শার্ট, নারী ও শিশুদের পোশাক। ধারণা করা যায়, গত প্রায় দুই বছরে দেশের মিলগুলোতে কাপড় উৎপাদনের পরিমাণ কিছুটা হলেও বেড়েছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০১৭ সালের উৎপাদিত সব কাপড়ই রপ্তানি হয়নি। এর একটা বড় অংশ দেশে ব্যবহৃত হয়েছে। রপ্তানিমুখী বড় মিলগুলোর বাইরে নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং ঢাকার মিরপুর, আশুলিয়া, সাভার, কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলে যে ছোট ছোট মিল রয়েছে, সেগুলো মূলত অভ্যন্তরীণ বাজারে কাপড় সরবরাহ করে থাকে। এ ছাড়া রপ্তানি পোশাকের উদ্বৃত্ত অংশ দেশের চাহিদা মেটায়। এর পরিমাণও খুব কম নয়। সুতি, সিনথেটিক ও ব্লেন্ডেড—এই তিন ধরনের কাপড় তৈরি হয় দেশে। এগুলো দিয়ে বানানো হয় শার্ট, প্যান্ট, টি–শার্ট, পোলো শার্ট, বিভিন্ন ধরনের অন্তর্বাস, শিশু ও নারীদের পোশাক।
জোগানের অদৃশ্য কারিগর
নরসিংদী–সিরাজগঞ্জ–পাবনা–মানিকগঞ্জসহ হস্তচালিত তাঁত–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে হ্যান্ডলুমের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে পাওয়ারলুম কারখানা। দেশের বড় বড় রপ্তানিমুখী পাওয়ারলুম কারখানার পাশাপাশি এসব পাওয়ারলুম কারখানাতেও এখন তৈরি হচ্ছে সুতিসহ বিভিন্ন কাপড়। চিত্তরঞ্জন বা সেমি অটোমেটিক যে হস্তচালিত তাঁতগুলো একসময় তাঁতের কাপড় তৈরি করত, স্থানীয়ভাবে সেগুলোর উন্নয়ন ঘটিয়ে এসব অঞ্চলে পাওয়ারলুম কারখানা তৈরি হয়েছে। এসব কারখানায় তৈরি হয় শাড়ি, লুঙ্গি ও গামছা। হ্যান্ডলুমে তৈরি শাড়ি–লুঙ্গির পাশাপাশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে পাওয়ারলুমে তৈরি এই শাড়ি ও লুঙ্গি দেশের মোট কাপড়ের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এখন। বলা চলে, অভ্যন্তরীণ শাড়ি ও লুঙ্গির মোট চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশের জোগানদাতা ‘সেমি আরবান’ এলাকায় স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা এসব পাওয়ারলুম কারখানা। বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী বৃহৎ পাওয়ারলুম ইন্ডাস্ট্রিতে এই কারখানাগুলোর অবস্থান নিতান্ত গৌণ হলেও দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে কাপড়ের জোগানদাতা হিসেবে এগুলোর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এবং শীতপোশাক
তৈরি পোশাকশিল্পের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বৈচিত্র্যময় শীতবস্ত্র তৈরির হার। তবে বিদ্যুচ্চালিত তাঁতের প্রসারের কারণেই শীতবস্ত্র তৈরি বেশি হয় বা হচ্ছে—ব্যাপারটা সে রকম নয়। বাংলাদেশের মানুষ প্রথাগতভাবে শীত নিবারণের জন্য ব্যবহার করে চাদর। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হস্তচালিত তাঁতে চাদর তৈরি হতো একসময়। এ ছাড়া প্রথাগত হোসিয়ারি কারখানায় বহু আগে থেকেই তৈরি হতো মাফলার, মোটা উলের সোয়েটার, হাতমোজা এবং স্টকিং বা পায়ের মোজা। তবে এর পরিমাণ ছিল কম। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারীসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সাধারণ মানুষ প্রবল শীতে পাটের তৈরি চট শীত নিবারণের জন্য ব্যবহার করে আসছে যুগ যুগ ধরে। কিছুটা নকশা করা এ চট তৈরি হতো কোমর তাঁতে। উত্তরবঙ্গের এসব এলাকায় পাটের তৈরি চটের পাশাপাশি হস্তচালিত তাঁতে কম্বল ও চাদর তৈরি হয়। গত ২০ বছরে নওগাঁয় তৈরি হয়েছে গার্মেন্টসের ‘ঝুট’ থেকে মোটা সুতা বের করে সেই সুতায় চাদর তৈরির এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শীতবস্ত্রের চাহিদা মেটায় এসব চাদর। যন্ত্রচালিত কারখানার প্রসারের সূত্র ধরে শীতবস্ত্রে ঢুকে পড়েছে বৈচিত্র্য। এখন দেশের বিভিন্ন পাওয়ারলুম কারখানায় তৈরি হচ্ছে উন্নত মানের বৈচিত্র্যময় জ্যাকেট, সোয়েটার, চাদর এবং শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার বিশেষায়িত পোশাক। প্রথাগত মাফলারের জায়গায় তৈরি হচ্ছে ফ্যাশনেবল স্কার্ফ। এ ছাড়া ফ্যাশনেবল শীতের পোশাকের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে চামড়াশিল্পের। তরুণদের কাছে ব্যাপক সমাদৃত নীল জিনসের সঙ্গে মানানসই চামড়ার জ্যাকেট, চামড়ার দস্তানা।
বাংলাদেশ মূলত আবহমানকালের সমৃদ্ধ বস্ত্রশিল্পের সার্থক উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। হস্তচালিত তাঁতশিল্প এ দেশের বস্ত্রশিল্পের বনিয়াদ মজবুত করেছে শত শত বছর ধরে। সেই মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক প্রযুক্তির বিদ্যুচ্চালিত তাঁতশিল্প। এ ঘটনা তৈরি করেছে বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের এক ধারাবাহিক ইতিহাস। এই ইতিহাসের হাত ধরে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে বিশ্ব পোশাক খাতের অন্যতম জোগানদার।
রজত কান্তি রায় সাংবাদিক ও লেখক