বন্দিজীবন, মুক্তির আলো

>
নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক শিডনি শনবার্গের সঙ্গে শেখ মুজিব। ছবি: সংগৃহীত
নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক শিডনি শনবার্গের সঙ্গে শেখ মুজিব। ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে আসার অব্যবহিত পর কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেসব সাক্ষাৎকার অবলম্বনে রচিত হয়েছে এই লেখা।

‘শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এমন ব্যক্তি, যাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা যায় না, এমনকি কল্পনাও করা যায় না। ’ এ রকম মন্তব্যই করেছিলেন ১৯৭২ সালে তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া বিদেশি সাংবাদিকেরা। 

১৯৭২ সালে পাকিস্তানের জেলখানা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে আসার অব্যবহিত পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ডব্লিউএনইউটিভির জন্য ডেভিড ফ্রস্টের নেওয়া সাক্ষাৎকারটি নানাভাবে আলোচিত হয়। এটি নেওয়া হয় ১৮ জানুয়ারি। এর আগে লন্ডনের অবজারভার পত্রিকার গ্যাভিন ইয়াং ও নিউইয়র্ক টাইমস-এর শিডনি শনবার্গকে দেওয়া দুটি সাক্ষাৎকার তেমন আলোচিত না হলেও এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য কম নয়। এই সাক্ষাৎকার দুটোতেই তিনি প্রথম তাঁর গ্রেপ্তার হওয়া ও বন্দিজীবনের নানা ঘটনা তুলে ধরেন। কথা বলেন পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়েও। 

গ্যাভিন ইয়াংকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু সরাসরি পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে চ্যালেঞ্জ করেন। ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনের উদ্দেশে পাকিস্তান ত্যাগ করেন, ভুট্টো তখন দুই দেশের মধ্যে কোনো যোগসূত্র রাখা যায় কি না সে নিয়ে তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার জনগণের সঙ্গে কথা না বলে কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে পারব না। ’ এর আগে সিহালা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনেও ‘বন্দী মুজিবের’ সঙ্গে দেখা করে একই অনুরোধ করেছিলেন ভুট্টো। 

 ১০ জানুয়ারি ঢাকায় লাখ লাখ লোকের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, পাকিস্তানের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নয়। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। তিনি আরও যোগ করেন, ‘আজ আমি বলতে চাই, ভুট্টো সাহেব, আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সঙ্গে আর না। মরে যাব, তবু বাঙালি আর স্বাধীনতা হারাতে পারে না। আমি আপনাদের মঙ্গল কামনা করি। আমরা স্বাধীন, এটা মেনে নিন। আপনারাও স্বাধীনভাবে থাকুন। ’ (সূত্র: পূর্বদেশ, দৈনিক বাংলা ও সংবাদ)

কিন্তু ভুট্টো বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেননি। তিনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকা পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। ভুট্টো কমনওয়েলথ দেশগুলোর কাছে চিঠি পাঠিয়ে বলেন, ‘পূর্বাংশ’ এখনো পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে তাঁর দূতেরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালান। ভুট্টো পাকিস্তানপন্থী বাঙালি নেতা নুরুল আমিনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং রাজা ত্রিদিব রায়কে মন্ত্রী বানিয়ে এমন একটা আভাস দেওয়ার চেষ্টা করেন যেন বাংলাদেশ এখনো পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। 

 ৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে বঙ্গবন্ধুকে শুধু অভ্যর্থনা জানান। সেটি নিছক অভ্যর্থনাই ছিল না, সেখানে তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে সহযোগিতারও আশ্বাস দেন। ব্রিটেনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। 

এই প্রেক্ষাপটে গ্যাভিন ইয়াংকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ‘যদি ভুট্টো বাংলাদেশকে কমনওয়েলথের বাইরে রাখার জন্য কোনো চালাকি করেন, তাহলে আমি পশ্চিম পাকিস্তানও অধিগ্রহণ করব এবং তা বাংলাদেশের অংশ করব। ’

১৬ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদনে গ্যাভিন লিখেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণের পরপরই ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বাঙালির বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের প্রথম সুযোগেই তাঁকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট অথবা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে বলেন। ইয়াং লিখেছেন, তাঁর সে প্রয়াস সফল হয়নি। পাকিস্তানের ভেতর থেকেও তত দিনে মুজিবের মুক্তির দাবি উঠেছে। তারা ভাবতে শুরু করেছিল, বাংলাদেশে আটক (পরে ভারতে স্থানান্তরিত) ১ লাখ ৩ হাজার পাকিস্তানিকে ফেরত আনতে হলে মুজিবকে ছেড়ে দিতে হবে। 

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ইয়াহিয়া খান প্রহসনমূলক বিচারে বন্দী মুজিবকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন। ভুট্টো সেই রায় কার্যকর না করে তাঁকে মুক্তি দিলেও বাংলাদেশের ওপর দাবি ছাড়েননি। বাংলাদেশকে করায়ত্ত করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর তিনি ‘নোংরা খেলা’ শুরু করেন। 

গ্যাভিন ইয়াংকে মুজিব বলেন, ‘যদি ভুট্টো পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে চান, ভালো কথা। আমি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন সেনাবাহিনীর অনুকম্পায়। আর গণতান্ত্রিকভাবে আমিই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। আমি আমার লোকদের সব প্রদেশে (গভর্নর পদে) নিয়োগ দেব। আশা করি, তিনি সেটি চাইবেন না।’

মুজিব পাকিস্তানের প্রসঙ্গ টেনে আরও বলেন, ‘আপনি কী মনে করছেন, আমি ভুট্টোর সঙ্গে রসিকতা করছি। মোটেই না। যদি তিনি কমনওয়েলথে বাংলাদেশের প্রবেশে বাধা দেন এবং বলেন বাংলাদেশ তাঁদের অংশ, আমি বলতে পারি, ঠিক আছে। যদি তিনি সতর্ক না হন আমি পশ্চিম পাকিস্তানকেও আমার ভূখণ্ড বলে দাবি করতে পারি।’

সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে মুজিব একটি ইংরেজি প্রবাদ আউড়ে বলেন, ‘আমেরিকানদের কাছে প্রিয় হলো ডলার, চীনাদের কাছে খাদ্য, জাপানিদের কাছে স্ত্রী, আর ব্রিটিশদের কাছে বন্ধু। ’

মুজিব আরও যোগ করেন, ‘ব্রিটিশদের সঙ্গে আমার মহান আদর্শগত মিল আছে। আমি একজন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী। ’

গ্যাভিন মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের মতো নবীন রাষ্ট্রের প্রধানের কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ খুব গরিব দেশ সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। পাকিস্তানের এই ‘নোংরা খেলা’ থেকে সরে আসা উচিত। 

গ্যাভিন ইয়াংকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়ে বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরের বাড়িতে ওঠেননি। ধানমন্ডির অন্য একটি বাড়িতে অস্থায়ীভাবে বাস করছিলেন। অস্থায়ী সেই বাড়িটিতেই তাঁর পরিবারের সদস্যরা ৯ মাস অন্তরীণ ছিলেন। ইয়াং লিখেছেন, কিছু দিন আগেও এখানে পাকিস্তানি সেনারা পাহারা দিত। এখন পাহারা দিচ্ছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনারা মুজিবকে তাঁর ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে নেওয়ার সময় সেটি তছনছ করে দেয়। জানুয়ারির মাঝামাঝি যখন ইয়াং এ সাক্ষাৎকার নেন, তখনো ওই বাড়ি মেরামতের কাজ চলছিল। 

এই সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘেরই উচিত এই বিচারের ব্যবস্থা করা।’ 

শিডনি শনবার্গকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ মধ্যরাতে তাঁর গ্রেপ্তার ও জেলখানার তিক্ত অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন। নিউইয়র্ক টাইমস পরদিন শিরোনাম করেছিল, ‘মুজিবস রিকাউন্টস অডেসি’। 

ঢাকায় গ্রেপ্তারের পর বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে লায়ালপুর জেলে রাখা হয়। ৩ ডিসেম্বর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হলে এই ভিভিআইপি বন্দীকে মিয়াওয়ালি জেলখানায় সরিয়ে নেওয়া হয়। যুদ্ধের সময়টাতে কারাগারেও নিষ্প্রদীপ মহড়া চলছিল। বঙ্গবন্ধু জেলখানায় তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর মিয়াওয়ালি কেন্দ্রীয় কারাগারে কতিপয় বন্দী বলাবলি করছিলেন, মুজিবের লোকেরা এ এ কে নিয়াজিকে হত্যা করেছে। নিয়াজি ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান।’ এসব কথাবার্তাকে বঙ্গবন্ধু হালকাভাবে নেননি। মিয়াওয়ালি ছিল নিয়াজির জন্মস্থান। বন্দীরা ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং প্রতিশোধ নেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। তাদের বলা হয়, ভোর ছয়টায় সেলের দরজা খুলে দেওয়া হবে এবং মুজিবকে হত্যা করা হবে। 

জেলখানার তত্ত্বাবধায়ক আবদুর রশীদ ছিলেন মুজিবের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। তিনি তাঁর বাড়িতে তাঁকে দুদিন লুকিয়ে রাখেন। ২০ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত তিনি গোপন স্থানেই ছিলেন। এরপর বন্দীকে জেলখানা থেকে সিহালি অতিথিশালায় নিয়ে যাওয়া হয়। 

ইরানের সাংবাদিক আমির তাহিরি ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে, সেটি দেখাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ আগস্ট মাসে তাঁকে ঢাকায়ও নিয়ে এসেছিল। কায়হান ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকায় তাহিরি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘বাড়ির বেশির ভাগ কাচ ভাঙা এবং সব দেয়ালেই বুলেটের গর্ত। অঢেল বৃষ্টির আশীর্বাদ পেয়ে বুনোলতার সবুজ প্রায় ঢেকে ফেলেছে ইটের দেয়াল। মুজিবের বাড়ির সাদামাটা ঘরে আমরা দেখতে পেয়েছিলাম বিয়ের নিমন্ত্রণ, অনুরোধপত্র ইত্যাদি নানা ধরনের না-খোলা চিঠির স্তূপ। ছিল অবোধগম্য বাংলা হস্তাক্ষরে লেখা পাতার পর পাতা। এসব চিঠি মার্চের মধ্যভাগে এসেছিল। কিন্তু ২৬ মার্চ গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত শেখ মুজিব সেসব খোলার ফুরসত পাননি। ’

তিনি আরও লিখেছেন, ‘টেবিলের ওপর দেখতে পেলাম স্যার আইভার জেনিংস: আ কনস্টিটিউশনাল প্রবলেমস অব পাকিস্তান। মুজিবের শিক্ষক জুবেরি তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন এই বই। ভেতরে লেখা ছিল, ‘রাজনীতিকে অবলম্বন করে এগিয়ে যাওয়া যায় ক্ষমতার দিকে। জ্ঞানও ক্ষমতা’। 

আমির তাহিরির শেষ মন্তব্য ছিল, ‘বলপূর্বক প্রবেশকারীরা সাজানো কোনো ভোজসভা তছনছ করে দিলে যেমন হয়, গোটা বাড়িতে সে রকম একটা ভাব।’
সূত্র: শেখ মুজিবের বন্দী জীবন, আহমেদ সেলিম, অনুবাদ: মফিদুল হক