>
বিচিত্র ঘটনাধারার এক যোগফল একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়। তাতে অবদান রেখেছেন দেশি-বিদেশি অসংখ্য মানুষ। তার মধ্যেও কারও কারও ছিল গভীরতর প্রভাব। তাঁদের মধ্য থেকে নির্বাচিত কয়েকজনের অনন্য কাহিনি
শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ১৯৩৯ সালে, ১৯ বছর বয়সে। তখন তিনি মুসলিম লীগের এবং সেই সূত্রে মুসলিম ছাত্রলীগের একজন সাধারণ কর্মী। পাকিস্তান-দাবির ঘোর সমর্থক হলেও তাঁর মনের গঠনটা ছিল অসাম্প্রদায়িক। সাম্প্রদায়িকতা ও ছুঁৎমার্গের প্রকাশ তাঁকে ক্ষুব্ধ করলেও সাম্প্রদায়িকতা থেকে তিনি আত্মরক্ষা করতে শিখেছিলেন। সোহ্রাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের উপদলভুক্ত হওয়ায় তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং একটি ন্যায়পর সমাজগঠনের চিন্তা নিজের মধ্যে লালন করতে পেরেছিলেন। দেশভাগের পরে যখন তাঁর লেখাপড়ার ক্ষেত্র কলকাতা থেকে ছেড়ে তিনি ঢাকায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন সোহ্রাওয়ার্দী তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘দেখো, ওখানে যেন সাম্প্রদায়িক ঘটনা না ঘটে। তাহলে ভারতের মুসলমানেরা বিপদ্গ্রস্ত হবে।’ সে-কথা রাখতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি শেখ মুজিব। তাঁর রাজনৈতিক গুরু সোহ্রাওয়ার্দীর সঙ্গে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতাদের দুর্ব্যবহার সত্ত্বেও মুসলিম লীগবিরোধী কোনো কাজ করতে প্রথমটায় তাঁর মন সায় দেয়নি। তাই গণতান্ত্রিক যুবলীগ-প্রতিষ্ঠার বিষয়ে গোড়ায় উৎসাহী হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধাচরণই করেছিলেন তিনি।
মুসলিম লীগের কুশাসন এবং রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে তাদের কৃত অন্যায় এই শেখ মুজিবকেই তাদের বিরোধী করে তুলল। সরকারসমর্থক ছাত্র সংগঠন ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকায় তার সূচনা, কারাবন্দী অবস্থায় আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক পদে নির্বাচিত হওয়ায় তার একধরনের পরিণতি। যে-প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন মুসলিম লীগের একটা প্রধান দাবি ছিল, পাকিস্তান-প্রতিষ্ঠার পরে মুসলিম লীগ তার কথা ভুলেই গেল। শেখ মুজিব এ-দাবিটাকেই নিজের রাজনীতিতে প্রাধান্য দিলেন। দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা নিয়ে। জিন্নাহ যা-ই বলে থাকুন না কেন, তাঁর উত্তরাধিকারীরা ধর্মকে ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে না দেখে রাষ্ট্রীয় জীবনের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে চাইলেন। শেখ মুজিব প্রথমাবধি চাইলেন ধর্ম ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্র পৃথক রাখতে। ১৯৫৫ সালে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নাম থেকে মুসলিম কথাটা বিলোপ করতে তিনি যেমন সক্রিয় ছিলেন, পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র-রচনার সময়ে গণপরিষদে তেমনি তিনি স্পষ্ট করেই পাকিস্তানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণার বিরোধিতা করেন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিধান রাখার ওপরে জোর দেন এবং পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের নাম পূর্ব বাংলা রাখার দাবি জানান।
তত দিনে মুজিব একজন নেতা বলে পরিগণিত হয়েছেন—১৯৫৩ সালেই তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক—যদিও তাঁর মাথার ওপরে মাওলানা ভাসানী ও সোহ্রাওয়ার্দীর মতো নেতা আছেন। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন এবং ১৯৬৩ সালে সোহ্রাওয়ার্দীর মৃত্যু হয়। তখন মুজিব তাঁর দলে সর্বেসর্বা। ১৯৬০ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠন করেন বলে এবং তাঁর সম্মতি ও সমর্থনে আরো কয়েকজন ছাত্রনেতা স্বাধীন ও সমাজতান্ত্রিক পূর্ববাংলা গঠনের লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা করে ‘নিউক্লিয়াস’ নামে একটি গোপন সংস্থা গঠন করেন বলেও দাবি করা হয়েছে।
তবে, আমরা জানি, প্রকাশ্যে শেখ মুজিব ছয় দফা-কর্মসূচি উপস্থাপন করেন ১৯৬৬ সালে। সেই থেকে এই ছয় দফা আদায়ই হয় তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মূল লক্ষ্য। বারবার তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করে, এমনকি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় এক নম্বর আসামি করেও ক্ষমতাশীনেরা তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। তিনি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত ছিলেন। দেশের মানুষ তা উপলব্ধি করেছিল বলেই আরো প্রবীণ রাজনীতিবিদ থাকা সত্ত্বেও শেখ মুজিবই হয়ে উঠেছিলেন তাদের অবিসংবাদিত নেতা—বঙ্গবন্ধু। তাই ১৯৭০-এর নির্বাচনে মানুষ অমন করে দাঁড়িয়েছিল তাঁর সমর্থনে, তাই তাঁর অঙ্গুলিহেলনে ১৯৭১-এর মার্চে অমন একটা শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হতে পেরেছিল। বস্তুত মার্টিন লুথার কিং ও নেলসন ম্যান্ডেলার পরে বঙ্গবন্ধুই পৃথিবীর একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি অসহযোগ আন্দোলনকে সার্থকভাবে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করেছিলেন।
তারপর তাঁর ৭ মার্চের বক্তৃতা—মানুষের ইতিহাসে এক স্মরণীয় বক্তৃতা। এই ভাষণের যত রকম ব্যাখ্যাই হোক না কেন, এর মর্মকথা প্রকাশ পেয়েছিল হৃদয়-নিংড়ানো দুটি বাক্যে: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ শত্রুমিত্র কেউই এর তাৎপর্য বুঝতে ভুল করেনি। সময় যখন এসেছিল, দেশের মানুষ সর্বস্ব পণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। দৃশ্যপটে বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিত, তবু তাঁর নামেই যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। নয়নসমুখে তিনি ছিলেন না, তবু প্রতি মুহূর্তে আমরা তাঁর অস্তিত্ব উপলব্ধি করেছি। তাঁর উপস্থিতি অনুভব করেছি।
তারপর তিনি এলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন হলো, এক বছরের মধ্যে একটা গণতান্ত্রিক সংবিধান উপহার দিলেন, ষোলো মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগদান, বাংলাদেশের জন্যে অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের স্বীকৃতি আদায়, ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সদস্যপদ লাভ, জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ এবং সেখানে বাংলায় ভাষণ দান—এসবই তাঁর অর্জন।
তবে মুক্তিযুদ্ধ দেশটাকে বদলে দিয়েছিল। অস্ত্রশস্ত্র ছড়িয়ে গিয়েছিল, ১৯৭১-এর আত্মত্যাগ সাধনে প্রস্তুত মানুষের বেশির ভাগই এখন কিছু পাওয়ার জন্যে ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল। জাতীয় রক্ষী বাহিনীর প্রতিষ্ঠা শান্তিশৃঙ্খলা-আনয়নে যতটা সফল হয়েছিল, তার চেয়ে অধিক অসন্তোষের জন্ম দিয়েছিল। ১৯৭৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ জাতির জন্যে কাল হয়ে দাঁড়ায়। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বিচ্ছেদও দেশের জন্য শুভকর হয়নি। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর দ্বারা বাংলাদেশের সংবিধানের মূল কাঠামোও পরিবর্তিত হয়ে যায়।
এই অবস্থার এবং দেশের মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অবিচলিত আস্থার সুযোগ নিয়ে দেশদ্রোহী ঘাতকেরা তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে—তাঁর পরিবারের সকল উপস্থিত সদস্যসহ। শুধু তাঁর হত্যাকাণ্ড নয়, যেভাবে তাঁর দাফন-কাফন হয়, তা-ও ছিল জাতির পক্ষে কলঙ্কজনক।
৭ মার্চের বক্তৃতা—মানুষের ইতিহাসে এক স্মরণীয় বক্তৃতা। এই ভাষণের যত রকম ব্যাখ্যাই হোক না কেন, এর মর্মকথা প্রকাশ পেয়েছিল হৃদয়-নিংড়ানো দুটি বাক্যে: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
কিন্তু সেখানেই বঙ্গবন্ধুর শেষ নয়। টুঙ্গিপাড়ার সমাধি থেকে বেরিয়ে এসে তিনি পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন সারা বাংলাদেশে। যে-বাংলাদেশের তিনি স্থপতি, সে-বাংলাদেশের বস্তুগত অর্জনের প্রশংসা আজ পৃথিবীব্যাপী ধ্বনিত।
তবু আমাদের আরো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। তবেই হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার প্রতিষ্ঠা। এই কাজে তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রাম প্রতিমূহূর্তে আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।
এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম
আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়—তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা সম্পূর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে।
কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের মুমূর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস। নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস।
১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও ক্ষমতায় বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি করে আইয়ুব খান ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রাখল। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেওয়া হলো এবং এরপর এ অপরাধে আমার বহু ভাইকে হত্যা করা হলো।...
বাংলার নিরস্ত্র জনগণের ওপর অস্ত্র ব্যবহার করা হলো। আমাদের হাতে অস্ত্র নেই। কিন্তু আমরা পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনে দিয়েছি বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে, আজ সে অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার নিরীহ মানুষদের হত্যা করার জন্য। আমার দুঃখী জনতার ওপর চলছে গুলি।...
আমার অনুরোধ প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।
এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ৭ মার্চ ১৯৭১
আনিসুজ্জামান: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়