১.আপনার স্থাপত্য দর্শনের মূল কথাটা কী?
স্থাপত্য বিষয়ে সাধারণের ধারণা ভীষণ রকম মূর্ত। অন্যদিকে একজন স্থপতিকে এই মূর্ত ধারণার অভ্যন্তরে এক বিমূর্ত শিল্পবোধ নির্মাণ করতে হয়। এই শিল্পচেতনা, তার উপলব্ধি আর নতুন নতুন সৃজনশীল কাজের তাড়না একজন স্থপতিকে পরিচালিত করে। প্রচলিতভাবে আমরা যেকোনো স্থাপনা, দালানকোঠা, নির্মাণকাঠামো বুঝি, এসবই কিন্তু বাহ্যিক প্রকাশ। এর ভেতরের শিল্প সৃষ্টির প্রক্রিয়াগত যে বিষয়গুলো রয়েছে, সেটি অপ্রকাশিত থাকে। এই অপ্রকাশিত বিষয়টিকেই স্থপতি লুই আই কান বলেছেন ‘ভলিউম জিরো’।
শূন্য থেকে কিছু তৈরি করার যে আনন্দ, সেটি একটি ভিন্ন ধরনের অনুভব। নজরুলের ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাস’ হতে পারে এর কাব্যিক বহিঃপ্রকাশ। আমার স্থাপত্যদর্শন এ আনন্দ থেকেই উৎসারিত, এর বহিঃপ্রকাশ সম্পূর্ণভাবে বিমূর্ত। বাস্তব ও দৃশ্যমান স্থাপনার সঙ্গে প্রকৃতি ও সমাজ তথা মানুষের মিথস্ক্রিয়ায় যে গভীর যোগসূত্র তৈরি হয়, সেটিই আসলে স্থাপত্য। বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য, উপাত্ত ও জটিল অঙ্কের সঙ্গে জীবনের কাব্যময়তাকে সমন্বয় করার অনন্য এ প্রক্রিয়াটিকে স্থাপত্যচর্চা বলে।
২. দেশের সবার জন্য বাসগৃহ নিশ্চিত করার বিষয়ে আপনার ভাবনা কী?
বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ সুষ্ঠু আবাসনসংকটে ভুগছে। একটি দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য এটি অন্তরায়। একজন স্থপতি কীভাবে সবার জন্য বাসগৃহ অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারেন, তা অনেকগুলো পরিপ্রেক্ষিতনির্ভর। বিচ্ছিন্নভাবে অনেক স্থপতি ব্যক্তি উদ্যোগে বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গবেষণা ও নিরীক্ষামূলক সামাজিক গৃহায়ণ বা কমিউনিটি হাউজিং পাইলট প্রকল্প করছেন। তা ছাড়া বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যেসব সফল উদাহরণ রয়েছে, সেগুলোও আমাদের পর্যবেক্ষণে আছে। শুধু রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যেই সঠিক নীতিমালা ও সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগে সবার জন্য বাসগৃহ নিশ্চিত করার বিষয়টি আমরা আশা করতে পারি।
বাংলাদেশের সংবিধানে সরকারকে তার নাগরিকদের জন্য যে কয়টি মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে, বাসস্থান তার অন্যতম। সবার জন্য বাসস্থান নিশ্চিত করতে হলে বাসস্থানের পূর্ণ মালিকানার ধারণাটাও খুবই জরুরি। যে দেশে বিপুল মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, সেখানে রাতারাতি এই ধারণার বাস্তবায়ন হয়তো অলীক। তবে প্রগতিশীল ও সঠিক নীতিমালার মাধ্যমে ধীরে ধীরে এর উন্নয়ন সম্ভব।
পৃথিবীতে বেশ কিছু রাষ্ট্র এ ধারণার বাস্তবায়নে অনেক সফল উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমি শুধু একটি দেশের নাম বলব। সেটি সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুর একটি ধনতান্ত্রিক কাঠামোর দেশ। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের অঙ্গীকারের জায়গা থেকে সবার জন্য বাসস্থান নিশ্চিত করতে সমগ্র পৃথিবীতে তারা সবচেয়ে অগ্রসর ও অনুকরণীয় মডেল স্থাপন করেছে। ১৯৬০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে একেবারে শূন্য থেকে ৮০ শতাংশের অধিক নাগরিকের বাসগৃহের পূর্ণ মালিকানা নিশ্চিত করেছে তারা।
আমি বলছি না সিঙ্গাপুর মডেল আমাদের জন্য প্রায়োগিক। তবে অনেকখানি প্রাসঙ্গিক। আমাদের যে ১৯৯৩ ও ১৯৯৯–এর গৃহায়ণনীতি প্রণীত হয়েছে, তা কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য, সে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক হলে স্থপতি তাঁর মেধা, নির্মাণকৌশল ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা দিয়ে কী করে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে বাসগৃহ করা যায়, সে ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারেন এবং রাখবেন অবশ্যই।
৩. আপনার নিজের একটি কাজের নাম বলতে বললে কোনটি সম্পর্কে বলবেন?
কোনো একটি বিশেষ স্থাপত্যের নাম আলাদা করে বলার সময় এখনো হয়ে ওঠেনি বলেই আমি মনে করি। তারপরও বিশেষ কিছু কাজের প্রতি আলাদা অনুরাগ তো থেকেই যায়। এই মূহূর্তে যে কাজটি মনের মধ্যে প্রাধান্য পাচ্ছে, সেটি ‘জিপি হাউস’। স্থাপত্যে বর্তমান সময়কে তুলে ধরতে এ কাজ আমাকে তৃপ্তি দেয়। বলা যায়, দুই যুগের বেশি সময়ের এই পথচলায় জিপি হাউস আমার কাজের ধারার একটি সংক্ষিপ্তসার। নিজস্ব অনেক চিন্তা ও ধারণার সম্মিলন ঘটাতে পেরেছি এ প্রকল্পটিতে, যা আমার স্থাপত্যের মূল দর্শনকে বুঝতে সাহায্য করবে।
এ ভবন তার সুনকশা, পরিবেশ–সংবেদনশীল, টেকসই এবং শক্তিসাশ্রয়ী প্রযুক্তির মিশেলে বাংলাদেশের স্থাপত্যচর্চায় অনেকগুলো নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দেশের স্থপতিসমাজে এটি সমাদৃত হয়েছে গঠনমূলকভাবে। সমাজ ও পরিবেশবান্ধব নকশা প্রণয়নে অনেক স্থপতিকেই এটি অনুপ্রাণিত করছে তাঁদের মতো করে। সামাজিক চেতনাসম্পন্ন নগরায়ণের জন্য ভবনটি তাই একটি মাইলফলক বলব আমি। জিপি হাউসের সাফল্য এত বছর পরও আমাকে অনুপ্রেরণা জোগায়।