পায়ে পায়ে দেশি জুতা

আজ থেকে ২০ বছর আগেও জুতার ব্র্যান্ড বলতে দেশের মানুষ বাটাকেই চিনত। যাঁরা বাটার জুতা কিনতেন না, তাঁদের ভরসা ছিল চীন, ভারত বা থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা জুতা। অবশ্য তখন মানুষ জুতাই কম পরত। আর এক জোড়া কিনলে তা দিয়েই কয়েক বছর চালিয়ে দিত।

দিন বদলে গেছে। আগে যারা খালি পায়ে থাকত, তারা এখন স্যান্ডেল পরছে। যাদের চটি পরে দিন কাটত, তারা এখন জুতা পরছে। বছরে দুই–তিন জোড়া করে জুতা কিনছেন উল্লেখযোগ্য অংশের মানুষ। এতে বড় হচ্ছে বাজার। দেশীয় কোম্পানিগুলো জুতার বাজারে বিনিয়োগ করছে। এতে মোট বাজারে দেশীয় ব্র্যান্ডের হিস্যা বাড়ছে। শুধু দেশের মানুষ নয়, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের মানুষের পায়ে শোভা পাচ্ছে বাংলাদেশে তৈরি জুতা।

বাজার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জুতার বাজারে বৈচিত্র্য আসছে। একসময় মানুষ শুধু চামড়ার জুতা পরত। এখন কৃত্রিম চামড়া ও কাপড়ের জুতাও ব্যাপক জনপ্রিয়। স্থানীয় বাজারে আসা জুতায় বৈচিত্র্য আসছে ডিজাইনেও। দেশীয় উৎপাদকেরা বৈশ্বিক ফ্যাশন ধারার সঙ্গে দেশীয় চাহিদা মাথায় রেখে নানা রং ও ঢঙের জুতা বাজারে আনছেন, যার নকশা করছেন দেশীয় নকশাবিদেরাই।

দেশীয় জুতার বাজারের ধরন এখন দুটি। একটি ব্র্যান্ডের জুতার বাজার, অন্যটি নন–ব্র্যান্ড। উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের জুতার বাজারের আকার এখন প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা, যা বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। অন্যদিকে জুতা রপ্তানি করে বাংলাদেশের আয় হচ্ছে ৮১ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকার সমান। এসব জুতার বেশির ভাগ যায় ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে।

বে ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের আয় যত বাড়ছে, জুতার বাজারও ততটা বাড়ছে। এক জোড়ার জায়গায় মানুষ এখন দুই–তিন জোড়া জুতা কিনছেন। তাই ভবিষ্যতেও এ খাতের সম্ভাবনা বড়।

শুধু টেকসই নয়, জুতার নকশাও এখন গুরুত্ব পাচ্ছে। ছবি: প্রথম আলো

বাজার কার কত
ব্র্যান্ডের জুতার বাজারে শীর্ষে আছে বাটা ও অ্যাপেক্স। এরপরের অবস্থানে অনেক ছোট ছোট ব্র্যান্ড আছে, যারা রপ্তানির পাশাপাশি স্থানীয় বাজারেও বিক্রি করে। তবে দেশীয় বাজারে নজর দিয়েছে বেশ কিছু বড় কোম্পানি। এ খাতে বিনিয়োগ করেছে তারা।

বৈশ্বিক জুতার ব্র্যান্ড বাটা বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে ১৯৬২ সালে। বর্তমানে তাদের দুটি কারখানা রয়েছে। একটি টঙ্গীতে, অন্যটি ধামরাইয়ে। এ দুটি কারখানায় দৈনিক ১ লাখ ৬০ হাজার জোড়া জুতা তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। বাটার বার্ষিক প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৭ সালে তারা স্থানীয় বাজারে ৯০২ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করে। বাজারে এখনো শীর্ষস্থান তাদের। দ্বিতীয় স্থানে থাকা অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার ২০১৭–১৮ অর্থবছরে ১ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে, যার মধ্যে স্থানীয় বাজারে বিক্রির পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৯৫ কোটি টাকা।

১৯৯০ সালে যাত্রা শুরু করা অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ট্যানারি ইউনিট ২০১৫ সালে বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সেরা মান বা গোল্ড কারখানার মর্যাদা পায়। এলডব্লিউজির সনদ না থাকলে বড় ব্র্যান্ডগুলো পণ্য কেনে না। অ্যাপেক্স বিশ্বের ১৩৫টির মতো জুতা ব্র্যান্ডের কাছে পণ্য বিক্রি করে। অ্যাপেক্স স্থানীয় বাজারে প্রবেশ করে ১৯৯৭ সালে। বর্তমানে সারা দেশে তাদের আউটলেট আছে।

দেশীয় জুতার বাজারের ধরন এখন দুটি। একটি ব্র্যান্ডের জুতার বাজার, অন্যটি নন–ব্র্যান্ড। উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের জুতার বাজারের আকার এখন প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা, যা বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে।ইতালীয় ব্র্যান্ড লোটোর বাংলাদেশে ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে ২০১২ সালে যাত্রা শুরু করে লোটো বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে তারা ১৫৮টি আউটলেট খুলেছে। বছরে তাদের বিক্রি বাড়ছে ২০ শতাংশ হারে। জানতে চাইলে লোটোর বিপণন নির্বাহী কামরুল হাসান বলেন, ‘এ দেশে বৈশ্বিক স্পোর্টসওয়্যার ব্র্যান্ডগুলোর কোনো কার্যক্রম নেই। সে হিসেবে আমরা একাই বাজারে আছি। আমাদের সাড়াও খুব ভালো।’

জুতার বাজারে বাটা ও অ্যাপেক্সের পর তৃতীয় ব্র্যান্ডের অবস্থান অনেক পেছনে। জুতা বিক্রিতে এখনো ওই দুই ব্র্যান্ডের ধারেকাছে যেতে পারেনি কেউ। তবে নতুন আসা ব্র্যান্ডগুলোর অনেকেই ভালো করছে।

ওরিয়ন গ্রুপের ওরিয়ন ফুটওয়্যার বাজারে আসে ২০১৫ সালে। ইতিমধ্যে ঢাকা ও বড় শহরে ৩০টির মতো আউটলেট খুলেছে তারা। সম্প্রতি বাজারে এসেছে প্রাণ–আরএফএল গ্রুপের ওয়াকার ব্র্যান্ডের জুতা। ভাইব্রান্ট ব্র্যান্ডের জুতা নিয়ে বাজারে এসেছে ইউএস বাংলা গ্রুপ। লেদারেক্স, জেনিস, ফরচুনা, জিলস, হামকো, স্টেপসহ নানা ব্র্যান্ড জুতা ব্যবসায় রয়েছে। এদিক দিয়ে বে ফুটওয়্যার বেশ পুরোনো। তাদের ৭০টির মতো আউটলেট রয়েছে। অবশ্য বে এখন রপ্তানিতেই বেশি নজর দিচ্ছে।

ব্র্যান্ডের জুতার বাইরেও বড় বাজার আছে, যেখানে ছোট স্থানীয় উৎপাদকেরা পণ্য বিক্রি করে। আবার চীন, থাইল্যান্ড, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে জুতা আমদানি হয়।

জুতার নকশা
জুতার নকশায় দেশে একটি অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার। অন্যরা যখন বিদেশি ক্রেতার নকশা অনুযায়ী জুতা তৈরি করে রপ্তানি করে, তখন নিজেরাই জুতার নকশা করে রপ্তানি করছে অ্যাপেক্স। নকশা করার জন্য অ্যাপেক্সের আছে বড় একটি ডিজাইন সেন্টার, যেটির কার্যালয় আছে ইতালিতে। সব মিলিয়ে তাদের পণ্য উন্নয়ন বিভাগে কাজ করেন প্রায় ২৫০ জন দেশি–বিদেশি নাগরিক।

ইতালির রিভা দেল গারদা শহরে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী হয়, যেখানে নিজেদের নকশা করা জুতা নিয়ে প্রতিবছরই অংশ নেয় অ্যাপেক্স। সংখ্যায় বেশি হওয়ায় মেলায় স্টলের বদলে অ্যাপেক্স হোটেল ভাড়া নেয়। সেই হোটেলের গ্যালারিতে সাজানো থাকে অ্যাপেক্সের জুতা। সেখানে গিয়ে ক্রেতারা জুতা দেখেন।

অ্যাপেক্সের পণ্য উন্নয়ন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক রাজ্য রহিম চৌধুরী বলেন, জুতার নকশা করার জন্য তাঁরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ফ্যাশন ও নকশার প্রবণতা নিয়মিত নজরে রাখেন। আগামী মৌসুমে মানুষ কী ধরনের জুতা পরবেন, সে অনুযায়ী অ্যাপেক্সের জুতার নকশা করা হয়। তিনি বলেন, দেশের মানুষ এখন প্রচুর বিদেশে যান। বিদেশে কী ধরনের জুতা চলছে, সেটা তাঁরা দেখেন। ফলে দেশের নকশাও অনেকটা বিদেশি প্রবণতা অনুযায়ী হয়।

অ্যাপেক্সের পণ্য উন্নয়ন বিভাগের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ মুস্তাফা শহিদুল ইসলাম বলেন, দেশের বাজারে এখন সিনথেটিক সুতায় বুনন করা উপরিভাগের জুতা বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে, যাকে ফ্লাই নিটিং বলা হয়। উপরিভাগ খসখসে চামড়ার জুতাও কয়েক বছর হলো এসেছে, যাকে সুয়েড লেদার বলা হয়। তিনি বলেন, মানুষ এখন বেশি চান হালকা ও আরামদায়ক জুতা। মেয়েদের জুতার বাজারে কাপড়ের জুতার নতুন ট্রেন্ড বা প্রবণতা শুরু হয়েছে।

অ্যাপেক্সের মতো বড় না হলেও দেশের জুতার ব্র্যান্ডগুলোর নকশা করার ছোট–বড় দল রয়েছে।

রপ্তানি বাড়ছে

চামড়া খাতে রপ্তানি আয় কমলেও জুতা রপ্তানি বাড়ছে। ২০১৭–১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশের আয় হয় ১০৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ১২ শতাংশ কম। চামড়া ও অন্যান্য জুতা রপ্তানি করে আয় হয় ৮১ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি।

রপ্তানি আয়ে চামড়াজাত জুতাই বেশি। বিগত অর্থবছরে প্রায় ৫৪ কোটি ডলারের চামড়াজাত জুতা রপ্তানি হয়েছে, যা মোট আয়ের ৬৭ শতাংশ।

রাজীব আহমেদ : প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক