প্রথমত দেশ এবং পরবর্তী সময়ে দশ। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট একটা বিশেষ দিন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘দেশীদশ’। বাংলাদেশের ফ্যাশনশিল্পের এক নতুন ভাবনার উৎসব উদ্যাপিত হয়েছিল সেই দিনে। আজ ২০১৮-এর নভেম্বর মাসে এসে স্মৃতিচারণা ও সম্ভাবনা নিয়ে কিছু কথার অবতারণা করছি, যা আজ আলোকিত ও প্রশংসিত সত্য।
সেই সময়ে যাঁরা দেশীদশ শুরু করেছিলেন, তাঁরা হলেন নিপুণ ক্রাফটের আশরাফুর রহমান, প্রবর্তনার শাহিদ হোসেন শামীম, কে ক্রাফটের খালিদ মাহমুদ খান, অঞ্জনসের শাহীন আহমেদ, রঙের বিপ্লব সাহা ও সৌমিক দাশ, বাংলার মেলার গোলাম মাওলা ও মতিউজ্জামান, সাদাকালোর তাহসিনা শাহিন ও সৈয়দ আজাহারুল হক, বিবিআনার লিপি খন্দকার ও কাজী হাসিবুল আহসান, দেশালের কনক আদিত্য ও সবুজ সিদ্দিকী এবং নগরদোলার আলী আফজাল।
কীভাবে সম্মিলিত হয়ে নতুন বিশ্বাসে একত্র হয়েছিলেন ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো রঙ বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী সৌমিক দাশের স্মৃতি থেকে সেটুকু জানা গেল। ২০০৮ সালে দেশীয় ফ্যাশন অঙ্গনের প্রয়োজনে একটি সংগঠন গঠনের ভাবনায় বেশ কটি ফ্যাশন হাউসের উদ্যোক্তারা মিলিত হচ্ছিলেন প্রায়ই। কে ক্রাফটের উদ্যোক্তা খালিদ মাহমুদ খান ও শাহনাজ খানের আহ্বানে সে রকম একটি মতবিনিময় সভা হয় প্রবর্তনা ক্যাফেতে। সেখানে আগে উল্লেখ করা উদ্যোক্তারা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন প্রয়াত ডিজাইনার শাহরুখ শহীদ, ওজির হাবিব আহমেদ, নিত্য উপহারের বাহার রহমান ও তারামার্কার অভিজিত চৌধুরী। সভার শেষ দিকে বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের সে সময়ের মহাব্যবস্থাপক মেজর (অব.) মেহেদী এসেছিলেন। বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে সহজ শর্তে শাখা খোলার ব্যবস্থার কথা জানান তিনি।
শুরুতে আলাদা আলাদা দোকান করে একটি দেশীয় ফ্যাশন হাউসের জোন করার কথা ভাবা হয়। তবে অন্যরা উৎসাহী না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সে ভাবনা বাতিল হয়। পরে প্রায় ১০ মাস সবার ভাবনা ও প্রচেষ্টার ফলে দেশীদশের নামকরণ, প্রাতিষ্ঠানিক ও আঙ্গিক–কাঠামো প্রস্তুত হয়। ১৮ আগস্ট ২০০৮ দেশীদশের যাত্রা শুরু হয় বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে।
দেশীদশের একটি লক্ষ্য ছিল, যাতে ১০টি প্রতিষ্ঠান একমত পোষণ করেছিল। এগিয়ে যাওয়ার সংকল্প করেছিলেন উদ্যোক্তারা। অঞ্জনসের স্বত্বাধিকারী শাহীন আহমেদ জানালেন, মূলত দেশীয় পোশাক নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরাই এর উদ্যোক্তা। একই ছাদের নিচে এ রকম সমসাময়িক সেরা ১০টি ফ্যাশন ব্র্যান্ড থাকলে ক্রেতারা যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি দেশীদশের প্রতিটি হাউসও উপকৃত হবে।বাজারে প্রতিযোগী ১০টি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করলে সেখানে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সবার মানোন্নয়ন ঘটবে, ক্রেতারা ভালো ডিজাইন ও গুণগত মানের পাশাপাশি দামের দিক দিয়ে সুবিধা পাবেন। এটাই ছিল লক্ষ্য।
১০টি প্রতিষ্ঠানের নিজস্বতাকে অক্ষুণ্ন রেখে পণ্যের নান্দনিক উপস্থাপন ও বিক্রয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকদের সময় ও সিদ্ধান্তের বিষয়ে সহযোগিতাকে কার্যকর করার আর কোনো উদাহরণ সেই সময় আর হয়েছিল কি না, জানা নেই।দেশীদশ সব সময়ই বেশ কিছু প্রশংসিত সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়, যেগুলো অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণার উদাহরণ হয়েছিল।
সৌমিক দাশ জানান, শুরু থেকেই দেশীদশ বিভিন্ন উৎসব–পার্বণ–আয়োজন ও নানান সামাজিক প্রয়োজনে অংশ নিয়ে আসছে। দেশীদশ চত্বরেই একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস, পয়লা ফাল্গুন, ঈদ, পূজাসহ নানান সময়ে প্রদর্শনী, ফ্যাশন শো, মেলার আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক প্রয়োজনেও এগিয়ে এসেছে দেশীদশ। যেমন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণে অর্থ সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা ও সরাসরি অর্থ সাহায্য দিয়ে অংশগ্রহণ।
দেশীদশের একটি লক্ষ্য ছিল, যাতে ১০টি প্রতিষ্ঠান একমত পোষণ করেছিল। এগিয়ে যাওয়ার সংকল্প করেছিলেন উদ্যোক্তারা।শাহীন আহমেদ জানালেন, ২০০৯ সালে বিজয় দিবসকে ঘিরে ‘লাল সবুজের দেশীদশ’ শীর্ষক পোশাক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। সেখানে গায়ক শুভ্রদেবসহ অনেক সংগীতশিল্পী উপস্থিত হয়ে গান পরিবেশন করেন উদ্বোধনী আয়োজনে। ‘লাল সবুজের দেশীদশ’ শীর্ষক পোশাক প্রদর্শনীটি প্রতিবছরই হয়ে থাকে। ২০১০-এ ফেব্রুয়ারি মাসে ২টি আয়োজন হয়। একটি ছিল বসন্ত উদ্যাপন। বসন্তের পোশাক প্রদর্শনীর উদ্বোধনী আয়োজন শুরু হয় বসন্তের গান দিয়ে। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী এসে বৈশাখী আয়োজন উদ্বাধন করেন রংতুলির আঁচড়ে । দেশীদশ নিয়মিত পোশাক নিয়ে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করেছে। যেসব আয়োজনে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা এসে দেশীদশকে উৎসাহিত করেছেন। রামেন্দু মজুমদার, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, সৈয়দ শামসুল হক, রফিকুন নবী, ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শিমুল মুস্তাফা, সামিনা চৌধুরী, ফাহমিদা নবী, আফজাল হোসেন, বিপাশা হায়াতসহ অনেকে এসেছেন দেশীদশের নানা আয়োজনে।
দেশীদশের উদ্যোক্তাদের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ সব সময়ই ছিল, ক্রেতার কাছে নিজস্ব ব্র্যান্ডের স্থানটি যেন সব সময়ই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। আবার অন্যদিকে একটা বড় জায়গায় একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কোনো রকম মানসিক বা প্রাতিষ্ঠানিক বোঝাপড়ার জটিলতা সৃষ্টি না হয়। উদ্যোক্তারা জানান, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের পণ্যের ধারণা (কনসেপ্ট) আলাদা হওয়ায় কোনো দ্বন্দ্ব হয়নি। বরং একটি সুন্দর প্রতিযোগিতার সুযোগ হয়েছে।
সময়ের পরিবর্তনে দেশীদশের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য প্রবর্তনা চলে গেলে সেখানে যোগ দেয় সৃষ্টি। দেশীদশের প্রতিষ্ঠান রঙের মালিকানা ভাগ হয়ে দুভাগ হয়ে গেল রঙ বাংলাদেশ ও বিশ্ব রঙ। রঙ বাংলাদেশ দেশীদশের সঙ্গে থেকে যায়।
দেশীদশ তার নিজস্ব পরিমণ্ডলে কিছু বিষয়কে প্রয়োজনীয় করণীয় সিদ্ধান্ত হিসেবে ভাবতে পারে। যেমন দেশীদশের প্রাঙ্গণে সব ব্র্যান্ডের পোশাকের গ্রেডিং পদ্ধতি একই পরিসংখ্যানগত মাত্রায় তৈরি করা। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, যা বৈশ্বিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোতে আমরা দেখি।
বিদেশে যেমন আবহাওয়াগত বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে ফ্যাশনের ঋতুভিত্তিক ভাবনাকে প্রতিফলিত করে তাদের পণ্যগুলোতে, তেমনি দেশীদশ ইচ্ছা করলে শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত ও বর্ষায় একই রঙের ধারা উপহার দিতে পারে ক্রেতাদের।
দেশীদশের আউটলেটের সংখ্যা বেড়েছে। নিপুণের স্বত্বাধিকারী আশরাফুর রহমান যেভাবে বলেছেন—ছয়টি আউটলেট হয়েছে দেশীদশের। ঢাকায় দুটি, চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া ও নারায়ণগঞ্জে একটি করে। ক্রেতাসাধারণের দোরগোড়ায় দেশীয় পোশাক পৌঁছে দিতে চায় দেশীদশ। তাই সময়ের ব্যবধানে সব বিভাগসহ বড় বড় শহরগুলোতে আউটলেট করার পরিকল্পনা রয়েছে। ব্যবসা প্রসারের ভিন্নমাত্রা আনার পরিকল্পনায় ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো সহব্র্যান্ড চালু করেছে।
বিভিন্ন শহরে দেশীদশের দোকান বাড়ানো ও অনলাইনে পণ্য বিক্রি করা দেশীদশের আগামী পরিকল্পনা। পাশাপাশি প্রচারণামূলক কার্যক্রম বাড়ানো এবং নিজেদের পণ্যের মানোন্নয়ন করে দেশীদশের ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি করা।
একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। দেশীদশের অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণ প্রজ্ঞার প্রয়োগ আগামী সময়কে আরও আলোকিত করে তুলবে, এটা আমাদের সবার বিশ্বাস। পরিবর্তনের ধারায় বাংলাদেশের পোশাকশিল্প যদি কারুশিল্প কিংবা হস্তশিল্পের গুণগত ও ঐতিহ্যগত ধারণার পৃষ্ঠপোষকতা থেকে সরে গিয়ে শিল্পায়নের অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসনের প্রাবল্যে সমর্পিত হয়ে যায়, তবে প্রশ্ন থেকে যাবে যে উদ্দেশ্য ও দর্শনের প্রতিজ্ঞা নিয়ে ২০০৯ সালের ১৮ আগস্ট যার জন্ম হয়েছিল, ২০১৯, ২০২৯, ২০৩৯ সালে তার অবস্থান কোন দিকে অবগাহন করবে। হয়তো সময়ই এর উত্তর দেবে।দেশীদশের প্রতি শুভ কামনা সব সময়।
চন্দ্রশেখর সাহা : লোকজ কারু ও তাঁতশিল্পের গবেষক ও ডিজাইনার