দুনিয়াজুড়ে প্রতিবছর বাঁচাচ্ছে ১০ লাখ জীবন

খাওয়ার স্যালাইনের কারণে ডায়রিয়া ও কলেরাজনিত মৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে
খাওয়ার স্যালাইনের কারণে ডায়রিয়া ও কলেরাজনিত মৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে

২০০৭ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, খাওয়ার স্যালাইন বিশ্বব্যাপী ৫ কোটির বেশি জীবন বাঁচিয়েছে এবং এখনো প্রতিবছর ১০ লাখের বেশি জীবন বাঁচাচ্ছে।
ষাট ও সত্তরের দশকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কলেরা মহামারি আকারে দেখা যেত। এটি একধরনের ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানাজনিত রোগ। এর কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রচুর পরিমাণে পানির মতো পাতলা পায়খানা ও বমি হয়। সময়মতো চিকিৎসা না পেলে শরীরে খুব দ্রুত পানিশূন্যতা দেখা দেয় এবং রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে রোগীর দ্রুত মৃত্যু হয়। প্রতিবছর আমাদের দেশে হাজার হাজার মানুষ মারা যেত। সে সময় এ রোগের অন্যতম চিকিৎসা ছিল আন্তশিরায় প্রদেয় স্যালাইন (ইন্ট্রাভেনাস বা আইভি স্যালাইন)। এই স্যালাইন সহজলভ্য ছিল না, উৎপাদনপদ্ধতিও অনেক জটিল ও ব্যয়বহুল ছিল, রোগীর শিরায় স্যালাইন দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত লোকবলও ছিল না।

কলেরা রোগের উন্নত চিকিৎসা ও প্রতিরোধের লক্ষ্যে ১৯৬০ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে আমেরিকার সহায়তায় সাউথ-ইস্ট এশিয়ান ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সিয়াটো) কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরি (সিআরএল), যার বর্তমান নাম আইসিডিডিআর,বি প্রতিষ্ঠিত হয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে কলেরা চিকিৎসায় আইভি স্যালাইনের কার্যকারিতা উন্নত করে ঢাকা সলিউশন নামে আইভি স্যালাইন উদ্ভাবন করে, যা এখনো মারাত্মক ডায়রিয়া ও কলেরা চিকিৎসায় ব্যবহার করা হচ্ছে।

একই সময়ে সিআরএল ডায়রিয়া ও কলেরা চিকিৎসায় আরও সহজে ব্যবহারযোগ্য পদ্ধতি উদ্ভাবনে গবেষণা চালিয়ে যায়। সিআরএলের বিজ্ঞানী নরবার্ট হার্শহর্ন ও তাঁর সহকর্মীরা এবং কলকাতার দ্য জন্স হপকিন্স সেন্টার ফর মেডিকেল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (জেএইচ-সিএমআরটি) বিজ্ঞানী নেট পিয়ার্স গ্লুকোজের মাধ্যমে রক্তে লবণ পৌঁছে দেওয়ার গবেষণা করে সফল হন। ১৯৬৮ সালের আগস্ট মাসে সিআরএলের গবেষক ডেভিড ন্যালিন, রিচার্ড ক্যাশ, রফিকুল ইসলাম, মজিদ মোল্লা এবং রবার্ট ফিলিপ ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি (ওআরটি) বা পানিশূন্যতা রোধে মুখে খাওয়ার উপযোগী চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে একটি সফল গবেষণা সম্পন্ন করেন, যা চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট-এ প্রকাশিত হয়। তাঁদের উদ্ভাবিত ওআরটি সোডিয়াম ক্লোরাইড বা খাওয়ার লবণ, সোডিয়াম বাইকার্বনেট বা খাওয়ার সোডা, পটাশিয়াম লবণ ও গ্লুকোজ দিয়ে তৈরি।প্রতিটি উপাদানই খুব সস্তা ও সহজপ্রাপ্য। এই নতুন উদ্ভাবিত ওআরটি ঢাকার কলেরা হাসপাতাল (বর্তমান নাম ঢাকা হাসপাতাল) ও চাঁদপুরের মতলব হাসপাতালে প্রয়োগ শুরু হয়।

সিআরএলের মতলব হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার হিসেবে তখন (১৯৬৮ সালে) দেখেছি সে সময় হাসপাতালে আসা ডায়রিয়ার রোগীদের আইভি স্যালাইন দিয়ে স্থিতিশীল করে তারপর ওআরটি দেওয়া হতো।কিন্তু রোগী, রোগীর স্বজনেরা, এমনকি হাসপাতালের কর্মীরাও প্রথম দিকে ওআরটিকে সহজভাবে গ্রহণ করতেন না।১৯৭০–এ মতলবের কিছু গ্রামে ওআরটি প্রয়োগ করে গ্রামবাসীর কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়। একই বছর তৎকালীন গাইবান্ধা সাব–ডিভিশনের সুন্দরগঞ্জ ও আশপাশের এলাকায় ডায়রিয়ার মহামারি দেখা দেয়। তখন সিআরএলের পক্ষ থেকে কেনেথ বার্টসহ আমরা আরও কয়েকজন ডায়রিয়ার কারণ উদ্​ঘাটন ও চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য সেখানে যাই। প্রায় আড়াই মাস ধরে আমরা সেখানে থেকে ডায়রিয়ার সফল চিকিৎসা করি।

১৯৭১–এর গ্রীষ্মে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁওয়ের শরণার্থীশিবিরে কলেরার মহামারি শুরু হয়। কলকাতার জেএইচ-সিএমআরটি কলেরা চিকিৎসায় এগিয়ে আসে। ডা. দিলীপ মহলানবীশ এবং তাঁর সহকর্মীরা এই কাজে নিয়োজিত ছিলেন।চিকিৎসাকেন্দ্রে ৩ হাজার ৭০০ রোগীকে ওআরটি দেওয়া হয়, যার মধ্যে ৯৬ শতাংশ রোগীই সেরে ওঠে। ডা. দিলীপ মহলানবীশ এই গবেষণালব্ধ ফলাফল ১৯৭৩ সালে দ্য জন্স হপকিন্স মেডিকেল জার্নালে প্রকাশ করেন।

১৯৭৫-এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ ওআরটির ওপর গবেষণালব্ধ ফলাফল এবং এর ব্যবহার বৃদ্ধিকল্পে একটি সর্বজনীন ফর্মুলা নির্ধারণ করে। এই সর্বজনীন ফর্মুলাই ওরাল রিহাইড্রেশন সল্টস বা সলিউশন (ওআরএস) নামে অভিহিত হয়, আমাদের দেশে এটি এখন ওআরএস বা খাওয়ার স্যালাইন হিসেবে জনপ্রিয়।

১৯৭৮ সালে প্রথম খাওয়ার স্যালাইনের বড় ধরনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয় মতলবে। গ্লুকোজের পরিবর্তে সুক্রোজ বা খাওয়ার চিনির ব্যবহার সাধারণ মানুষের জন্য আশার আলো দেখায়। এতে ডায়রিয়া রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার ২৯ শতাংশ কমে। এই ফলাফল ১৯৮০ সালে জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন–এ প্রকাশিত হয়। একই বছর ডা. রফিকুল ইসলাম ও সহকর্মীরা মিলে ঢাকার কলেরা হাসপাতালে লবণ-গুড় ব্যবহার করে খাওয়ার স্যালাইনের একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করেন। এই গবেষণায় দেখা যায়, এটিও কার্যকর।এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯-৮০ সালে মতলবে প্রায় দুই লাখ মানুষের মধ্যে লবণ-গুড় দিয়ে তৈরি স্যালাইনের সঙ্গে গ্লুকোজ স্যালাইনের তুলনা করে নিশ্চিত হওয়া যায়, এটিও কার্যকর। আমি এই গবেষণার প্রধান গবেষক ছিলাম। লবণ-গুড়ের স্যালাইন ব্যবহারেও হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার ৩০ শতাংশ কমে। ১৯৮২ সালে এই গবেষণালব্ধ ফলাফল ট্রানজেকশন অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন ও হাইজিন-এ প্রকাশিত হয়। ১৯৮০ সাল থেকে সরকারের সহায়তায় ব্র্যাকের মাঠকর্মীরা সমগ্র বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষদের লবণ-গুড় দিয়ে খাওয়ার স্যালাইন তৈরি ও এর ব্যবহার শিখিয়েছেন।

খাওয়ার স্যালাইনকে চিকিৎসাক্ষেত্রে এ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে িববেচনা করা হয়

১৯৭৮ সালে কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)। ১৯৭৮ সালেই দ্য ল্যানসেট খাওয়ার স্যালাইনকে চিকিৎসা ক্ষেত্রে শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে আখ্যায়িত করে। একই বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ডায়রিয়ার চিকিৎসায় ওআরএসের ব্যবহারের ওপর প্রথম বৈশ্বিক নীতি জারি করে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাওয়ার স্যালাইন ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগও এই সময় শুরু হয়।ফলে ১৯৮০ সালের মধ্যেই প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশে ডায়রিয়া ব্যবস্থাপনায় নিজস্ব জাতীয় প্রোগ্রাম চালু হয়।১৯৮৪ সাল থেকে ইউএসএইডের সহায়তায় সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি (এসএমসি) দেশজুড়ে প্যাকেটজাত খাওয়ার স্যালাইন বাজারজাত করছে। ফলে ডায়রিয়া ও কলেরাজনিত মৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।

নব্বইয়ের দশকে আইসিডিডিআর,বিসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রচলিত খাওয়ার স্যালাইনকে আরও উন্নত ও কার্যকর করার জন্য গবেষণা পরিচালনা করে। এসবের ওপর ভিত্তি করে ২০০১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ লবণ ও গ্লুকোজের পরিমাণ পুনর্নির্ধারণ করে সর্বজনীন ব্যবহারের উপযোগী নতুন ফর্মুলা গ্রহণ করে, যা সব ধরনের ডায়রিয়ার চিকিৎসার ক্ষেত্রে কার্যকর।

১৯৭৫ সালে বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের ডায়রিয়াজনিত মৃত্যু ছিল ৪৬ লাখ, যা ২০১৫ সালে কমে ৫ লাখে এসে দাঁড়িয়েছে। এখনো ডায়রিয়ায় প্রতি দুই মিনিটে একটি শিশু মারা যায়। ১৯৮০ সালে বিশ্বব্যাপী খাওয়ার স্যালাইনের কাভারেজ ছিল শূন্যের কোটায়, যা ২০১৫ সালে এসে দাঁড়ায় প্রায় ৪৪ শতাংশে, বাংলাদেশে যা প্রায় ৮০ শতাংশ। তারপরও ডায়রিয়ার কারণে প্রতিবছর এ দেশে ৪৫ হাজারের মতো পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মারা যায়।

২০০৭ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, খাওয়ার স্যালাইন বিশ্বব্যাপী ৫ কোটির বেশি জীবন বাঁচিয়েছে এবং এখনো প্রতিবছর ১০ লাখের বেশি জীবন বাঁচাচ্ছে।

ডা. মোহাম্মদ ইউনুস আইসিডিডিআর,বি’–এর ইমেরিটাস িবজ্ঞানী