ছাদে সবুজ বিপ্লবের স্বপ্ন

নগরের ফয়’স লেক এলাকায় নিজের বাড়ির ছাদে গড়ে তোলা বাগানের গাছে পানি ছিটাচ্ছেন ব্যবসায়ী হাবিবুর বহমান। তিনি ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন চট্টগ্রাম বাগান পরিবারের সদস্য। জুয়েল শীল
নগরের ফয়’স লেক এলাকায় নিজের বাড়ির ছাদে গড়ে তোলা বাগানের গাছে পানি ছিটাচ্ছেন ব্যবসায়ী হাবিবুর বহমান। তিনি ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন চট্টগ্রাম বাগান পরিবারের সদস্য।  জুয়েল শীল

চল্লিশ লাখ মানুষের শহর চট্টগ্রামের দরদালানের ছাদগুলো একসময় সবুজে ভরে উঠবে। ছাদবাগানে ফলবে লাউ, কুমড়া, টমেটো, শাক, শিমসহ নিত্যদিনের আহার্য সব সবজি। গোলাপ, টগর, জুঁই, চামেলিরা ছড়াবে সৌরভ। আম, পেয়ারা, মাল্টাসহ হরেক রকমের বিষমুক্ত ফল হাত বাড়ালেই মিলবে ছাদের বাগানে—এমন স্বপ্ন থেকেই শুরু হয়েছিল ছাদবাগানিদের ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন ‘চট্টগ্রাম বাগান পরিবারের’ পথ চলা।

রাজধানীর শৌখিন বাগানিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রথম এমন সংগঠন গড়ে তোলেন। এতে যোগ দেন চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন বাগানি। সেখানে পরিচয়ের সূত্র ধরে এখানকার বাগানিরা অনলাইনে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। ২০১৭ সালের ৩ মার্চ তাঁরা মিলে শুরু করেন ফেসবুকভিত্তিক নতুন সংগঠন চট্টগ্রাম বাগান পরিবার।

বাগান-সংক্রান্ত নানা পরামর্শের জন্য দ্রুতই চট্টগ্রামের ছাদবাগানিরা এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। শুরুর পর ছয় মাসের মাথায় সংগঠনের সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় ৫০০তে। আর দুই বছর পর বর্তমানে সংগঠনের সদস্যসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ হাজারে। ছাদবাগানিদের নিয়ে বৃক্ষমেলা, গাছের চারা বিনিময় ও গাছ–সংক্রান্ত নানা পরামর্শ বিতরণ করে বাগান পরিবার।

কথা হয় সংগঠনটির অন্যতম অ্যাডমিন জিয়াউল বারীর সঙ্গে। পেশায় ব্যবসায়ী জিয়াউল নিজেও বাগান করেন। শহরের ঈদগাঁ বউবাজারে তাঁর ছাদের বাগানে রয়েছে হরেক রকমের দেশি-বিদেশি সবজি, ফল ও ফুল।   

জিয়াউল বারী জানালেন, তিনিসহ বর্তমানে সংগঠনের অ্যাডমিন ও মডারেটর আছেন ১৪ জন। তৌহিদা তামান্না, এ আর টি রাহী, সি এম হাসান লাকি, নাসরিন ইকবাল, জামশেদ ইকবালসহ একঝাঁক উদ্যমী বাগানি সংগঠনকে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।

কেন এমন একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হলেন, জানতে চাইলে জিয়াউল বারী বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রামে যাঁরা বাগান করি, তাঁদের একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার ছিল। যেখানে অভিজ্ঞতা বিনিময় আর পরস্পর থেকে শেখার সুযোগ আছে।’

প্রতিবছর তিন থেকে চারটি অনুষ্ঠানের (ইভেন্ট) আয়োজন করে বাগান পরিবার। ইভেন্টগুলোতে সংগঠনের সদস্যরা এক হন। এসব অনুষ্ঠান আসলে একধরনের মিলনমেলা। সেখানে গাছ বিনিময়, চারা ও সার বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া বাগান নিয়ে আলোচনা সভা, সেমিনার তো আছেই। এসবের পাশাপাশি বাগান বিলাস নামের পত্রিকাও প্রকাশ করছেন তাঁরা। এখন পর্যন্ত এর দুটি সংখ্যা বের হয়েছে।

চট্টগ্রাম বাগান পরিবার খুব জমজমাট একটি ফেসবুক গ্রুপ। এর সদস্যদের নিয়ে নিয়মিত মাসব্যাপী প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় বলে জানালেন জিয়াউল।

>সবুজ চট্টগ্রামের স্বপ্ন নিয়ে ২০১৭ সালের ৩ মার্চ যাত্রা করে ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন চট্টগ্রাম বাগান পরিবার। ছাদবাগানিরা এর সদস্য।

প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া সদস্যরা প্রতিদিন ন্যূনতম বাগানের তিনটি ফুল-ফলের ছবি দেন গ্রুপে। এভাবে সর্বোচ্চ ছবি দেওয়া বাগানিরা সেরার তালিকায় উঠে আসেন। এসব প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে সদস্যরা একে অপরের বাগানের দৈনন্দিন চিত্র জেনে যান। এর ফলে বাগানিদের মধ্যে বাগান নিয়ে উৎসাহটা বাড়ে।

চট্টগ্রামে ছাদবাগান বা ছাদকৃষি সম্পর্কে কৃষি বিভাগের কোনো হালনাগাদ তথ্য নেই। তবে চট্টগ্রাম বাগান পরিবার এখন নিজেরাই এসব তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা করছে। সংগঠনের ২২ হাজার সদস্যের মধ্যে ৫ হাজার সদস্য নিজের ছাদে বাগান করেছেন। এই পাঁচ হাজার ছাদবাগানির সবজি ও ফলের বড় একটা চাহিদা মেটান নিজের বাগান থেকে।

ছাদবাগান থেকে একটি পরিবার ঠিক কতটুকু খাবারের জোগান পেতে পারে, জানতে চাইলে জিয়াউল বারী বলেন, মোটামুটি ছোট আকারের একটি ছাদবাগান থেকেও প্রতিদিনকার খাওয়ার মতো শাকসবজি পাওয়া যায়। এ ছাড়া মৌসুমে পাওয়া যায় নানা ধরনের ফল। সারা বছরই ছাদবাগান থেকে কিছু না কিছু প্রাপ্তিযোগ হয় বলে তিনি জানান। জানা গেল, শাকসবজি একেবারেই বাজার থেকে কিনতে হয় না, চট্টগ্রাম বাগান পরিবারে এমন বাগানির সংখ্যা কম করে হলেও ২০০।

ছাদবাগান করতে কত বড় ছাদ প্রয়োজন, কীভাবেই–বা শুরু করতে পারেন নতুন বাগানিরা? জানতে চাইলে জিয়াউল বারী বলেন, মোটামুটি রোদ পড়ে এমন ৮০০ থেকে ৯০০ বর্গফুটের ছাদ হলেও ভালো বাগান করা সম্ভব।

সরকারের নানা সংস্থা আয়োজিত বৃক্ষমেলায়ও অংশ নেয় চট্টগ্রাম বাগান পরিবার। ২০১৮ ও চলতি ২০১৯ সালে মোট তিনটি বড় মেলায় অংশ নিয়েছে বাগান পরিবার। এসব মেলায় গ্রুপের সদস্যদের হাতে তারা উন্নত জাতের ফল ও ফুলের চারা তুলে দিতে চেষ্টা করেছে। অব্যাহত প্রচারণা ও উৎসাহ দেওয়ার ফলে গ্রুপের সদস্যরা বাগানের পরিসর বাড়াচ্ছেন। সংগ্রহে যোগ করছেন নতুন নতুন প্রজাতির ফল, ফুল ও সবজি।

জিয়াউলের কাছ থেকে জানা গেল, একসময় প্যাশন, ড্রাগন, পারসিমন, পিচ, কমলা, আপেল বা আঙুর ছাদবাগানে দেখা যেত না। এসব বিদেশি ফল এখন দেশি ফলের সঙ্গে ভালোভাবেই ছাদবাগানে ফলছে।

কী ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় বাগানিদের? জিয়াউল বারী বলেন, চট্টগ্রামে মাতৃগাছের বাগান বা নার্সারি নেই বললেই চলে। এ কারণে ভালো জাতের চারা পাওয়া যায় না। অবশ্য কৃষি বিভাগ আজকাল টবে হয় ও ছাদে চাষের উপযোগী এমন সবজি ও ফলের জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে। 

কথা হয় চট্টগ্রাম বাগান পরিবারের সদস্য গৃহিণী আয়শা আক্তারের (৬০) সঙ্গে, দশ বছর ধরে ছাদবাগান করছেন তিনি। নগরের ফয়’স লেকের লেকভ্যালী আবাসিক এলাকায় প্রায় সাড়ে চার গন্ডা জায়গার ওপর করা একতলা বাড়ির ছাদে গড়ে তুলেছেন ফুল, ফল ও সবজির বাগান। আয়শা বলেন, তাঁর দিনের শুরু হয় বাগান পরিচর্যার মধ্য দিয়ে। সকাল–বিকেলে দুই বেলা ছাদে গিয়ে গাছের সঙ্গে সময় না কাটালে ভালো লাগে না তাঁর। গাছে নতুন ফুল বা ফল এলে ছবি তুলে তিনি বাগান পরিবারের ফেসবুক পেজে পোস্ট করেন। 

আয়শা আক্তার বলেন, এই বয়সে অনেকে রোগে–শোকে কাতর থাকেন। কিন্তু বাগানের পেছনে সময় দেওয়ায় তাঁর শরীর অনেকটাই ভালো। 

সম্মিলনে বাগান পরিবারের সদস্যরা। সংগৃহীত

আয়শা আক্তারের বাড়ির পঞ্চাশ গজের মধ্যেই ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান ও আসমা হাবীব ফেরিন দম্পতির চারতলা বাড়ি। দুজনেই বাগান পরিবারের সদস্য। ২০ বছর ধরে তাঁরা বাগান করছেন। আর ছাদবাগানে ফল ও সবজির চাষ অর্থাৎ ছাদকৃষি করছেন পাঁচ বছর ধরে। ছাদবাগানে বেশির ভাগ সময় দেন আসমা হাবীব। মূলত বাগানটি তাঁর নিজের হাতে গড়া। সম্প্রতি তাঁদের ছাদবাগানে গিয়ে দেখা গেল, লাউ, টমেটো, শাকসহ হরেক রকমের সবজির ছড়াছড়ি। গোলাপ, টগর, স্থল পদ্মসহ জানা–অজানা ফুলের সংখ্যাও কম নয়। আছে মাল্টা, কমলা, পেয়ারা, কলাসহ দেশি–বিদেশি নানা জাতের ফল।

হাবিবুর রহমান জানালেন, প্রায় ২০০ প্রজাতির গাছ রয়েছে তাঁদের ছাদবাগানে। প্রতিদিনের সবজির চাহিদার একটা বড় অংশ আসে নিজেদের বাগান থেকে।