হাসপাতালে প্রয়োজন ৩৬ জন ক্লিনার, কাজ করেন ৬ জন। আয়া, ওয়ার্ডবয়, গার্ড, গার্ডেনার, ট্রলিম্যান ও ইলেকট্রিশিয়ানের কোনো পদই নেই। এসবের দায়িত্ব পালন করেন ধার করা লোকজন। তাঁদের কোনো সম্মানী নেই, মাস শেষে কর্তৃপক্ষ ৩০০ থেকে ৪০০ করে টাকা হাতে ধরিয়ে দেয়।
তাঁদের আয়রোজগারের পথ ছিল রোগীদের ওপর জোরজুলুম করে টাকা নেওয়া। টাকা না দিলে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটিকে তার মাকে দেখতে দেওয়া হতো না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ না মেনে তাঁরা চলতেন খেয়ালখুশিমতো। এ কারণে রোগীদের সঙ্গে প্রায়ই তাঁদের বিবাদ বাধত। তাঁদের অনেকে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার কাজে ক্লিনিকের দালালিও করতেন। জনবলের অভাবে হাসপাতাল ছিল অপরিচ্ছন্ন-দুর্গন্ধময়। রোগীরা সরকারি হাসপাতাল থেকে মুখ ফিরিয়ে ছুটছিলেন বেসরকারি ক্লিনিকগুলোয়। এভাবেই চলছিল ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল।
২০১২ সালে এই হাসপাতালে যোগ দেন ডা. মো. ইমদাদুল হক। হাসপাতালের এই পরিস্থিতি দেখে তিনি এ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে শুরু করেন। এর আগে যশোরের চৌগাছা হাসপাতালে তিনি স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ফল পেয়েছিলেন। এখানেও চৌগাছার আদলে হাসপাতালে স্থানীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেন। শুরু করেন একের পর এক বৈঠক। শিক্ষক, চিকিৎসক, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, এনজিও কর্মীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে করেন মতবিনিময়।
মাত্র তিন বছরেই পাল্টে যায় ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের চিত্র। স্থানীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়া কর্মীরা কাজ করতে থাকেন। যাঁরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থেকে শুরু করে জরুরি বিভাগেও দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের বেতন দেন স্থানীয় লোকজনই। এখন আর চিকিৎসা নিতে এসে কাউকে পয়সা দিতে হয় না। গোটা হাসপাতাল এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তা বেড়েছে। বার্ষিক রাজস্ব বেড়েছে। বহির্বিভাগের পাশাপাশি ভর্তি রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে দ্বিগুণ। আর প্রসূতি ভর্তির হার বেড়েছে কয়েক গুণ।
১৯৫৯ সালের ৪ এপ্রিল যশোরের পরানপুর গ্রামে কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ডা. মো. ইমদাদুল হক। বরিশাল মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ১৯৮৫ সালে যশোরের চৌগাছা হাসপাতালে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে চলে যান লোহাগড়ায়। ১৯৯৫ সালে আবার ফিরে আসেন চৌগাছায়। এখানে দীর্ঘদিন চাকরির সুবাদে শুরু তিনি হাসপাতালের সঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে চিকিৎসাসেবার পরিবর্তন ঘটান। কার্যকর ও সফল এই উদ্যোগের জন্য তিনি উপজেলা পর্যায়ে প্রসূতিসেবায় ১৪ বার পুরস্কৃত হন। দেশের সেরা হাসপাতালের পুরস্কার পায় চৌগাছা। এরপর সিনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনি) পদোন্নতি নিয়ে ২০১২ সালের ১০ মে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে যোগ দেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বর্তমানে তিনি যশোর আদ্দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। আর সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চৌগাছা-ঝিনাইদহ মডেল বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটির পরামর্শক হিসেবে সপ্তাহে দুই দিন দায়িত্ব পালন করেন।
ডা. ইমদাদুল হক জানান, আয়া, ক্লিনার, ওয়ার্ডবয় ও নার্সের অভাবে হাসপাতালে রোগীদের সেবা দেওয়া যাচ্ছে না—এটা ভাবা যায় না। বাইরে নোংরা পরিবেশ দেখে রোগী আসতে চায় না। রোগীর লোকজনের কাছ থেকে জোর করে টাকা নেওয়া হবে, এটা হতে পারে না। এসব দেখে তিনি পরিবর্তনে কাজ করেছেন। স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতাল পরিবর্তনে কাজ করেন। সবার সহযোগিতা নিয়ে ২০১২ সালের মে মাসেই নেমে পড়েন কাজে।
ইমদাদুল হক জানান, প্রসূতি ওয়ার্ডে বেড ছিল মাত্র ৫টি। সরকারি আয়া ছিল একজন। বেসরকারি আয়া আর ক্লিনার কাজ করতেন ৫ জন। এই ওয়ার্ডে মাসে ডেলিভারি হতো ১৮০ থেকে ১৯০ জনের। সিজার করা হতো ৪০ থেকে ৪৫টি। এসব দেখে ওয়ার্ডে পড়ে থাকা ভাঙাচোরা বেডগুলো মেরামত করান। আর ৫ জন আয়া-ক্লিনার চুক্তিতে নিয়োগ দেন, যাঁদের বেতন নিজেই দিতেন। এতে অল্প দিনেই পরিবর্তন দেখা যায়। বন্ধ হয় রোগীদের কাছ থেকে টাকা আদায়। আয়া-ক্লিনার থাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ফিরে আসে। এরপর শিশু ওয়ার্ডে হাত দেন। হাসপাতালের ভাঙা সীমানাপ্রাচীর মেরামত করান। ভেতরে গরু-ছাগল আসা বন্ধ হয়। তাঁর এসব কাজে পৌরসভার মেয়র সাইদুল করিম, শিল্পপতি নাসের শাহরিয়ার জাহেদী ওরফে মহুল, সাংসদ তাহজীব আলম সিদ্দিকী, ডাক্তার আবদুর রহমান, সাবেক মেয়র আনিচুর রহমানসহ অনেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। বর্তমানে স্থানীয় লোকজনের দেওয়া সম্মানীতে ৫৪ জন কর্মী কাজ করছেন।
হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানান, জোড়াতালি দিয়ে চলছিল হাসপাতালটি। হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোয় এখন ময়লা থাকে না, খোলা জায়গার শোভাবর্ধনে বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানো হয়েছে। সাইকেলঘর মেরামত হয়েছে। গোলচত্বরে ফুলের বাগান আর ভেষজ বাগান পরিষ্কার করা হয়েছে। হাসপাতালে অভ্যন্তরে সারাক্ষণ পরিষ্কার করার কাজে ব্যস্ত রয়েছেন কর্মীরা। হাসপাতালের পরিবেশ ফিরে আসায় বহির্বিভাগে এর আগে প্রতিদিন ৬০০ রোগী আসত, বর্তমানে ১ হাজার ৫০০ আসছে। প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৬০ জন রোগী ভর্তি থাকত, বর্তমানে ২৩০ থেকে ২৫০ জন থাকে। এ ছাড়া হাসপাতালে মাসিক রাজস্ব বেড়েছে। প্রসূতি বিভাগে এর আগে অন্তঃসত্ত্বা মা আসতেন মাসে গড়ে ১৩০ জন, সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩০০ জন।
ঝিনাইদহ পৌরসভার মেয়র সাইদুল করিম জানান, ডা. ইমদাদুল হকের ভালো কাজ করার আমন্ত্রণ তিনি গ্রহণ করেছিলেন। বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজও করেছেন। তবে ইমদাদুল হক এখান থেকে চলে গেলেও তাঁর দেখানো পথে এখনো হাসপাতালটি ভালো চলছে। আর এই কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন স্থানীয় লোকজন।
ডাক্তার ইমদাদুল হক বলেন, তিনি হাসপাতালের বাইরে কোনো রোগীর অস্ত্রোপচার করেন না। প্যাথলজি থেকে কমিশন নেওয়াকে অপরাধ মনে করেন। হাসপাতালে বসে রোগীর কাছ থেকে টাকা নেন না। তিনি মনে করেন, চিকিৎসকদের উন্নত মূল্যবোধ লালন করা অপরিহার্য। জনগণের অংশগ্রহণে স্বাস্থ্যসেবার মান কীভাবে ভালো করা যায়, সেই লক্ষ্যে কাজ করছেন। সফলতাও পাচ্ছেন। যেমনটি করেছিলেন যশোরের চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এরপর ঝিনাইদহ। বর্তমানে দেশের ২২টি হাসপাতালে এই মডেল চালু হয়েছে। এ কাজ অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
আজাদ রহমান: (সাংবাদিক)