>জঙ্গি হামলা ১৯৯৯–২০১৬: নিহত ২৭৬, আহত ১৬৭৭
তৃতীয় পর্যায়ের
জঙ্গি সংগঠন
হিযবুত তাহ্রীরএ দেশে আত্মপ্রকাশ: ২০০১
নিষিদ্ধ ঘোষণা: ২০০৯
সদস্য/কর্মী: কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
আনসার আল ইসলাম
জন্ম: ২০০৮। শুরুতে নাম ছিল আনসারুল্লাহ বাংলা টিম
সদস্য/কর্মী: কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
‘নব্য’ জেএমবি
সংগঠিত হওয়ার প্রথম আলামত: ২০১৩
সদস্য/কর্মী: কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছাত্র
গত সাড়ে তিন বছরে ৬২টি হামলার ঘটনায় নিহত
৯৪জন
সাত বছর বিরতির পর আবার হামলা ও হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে দেশে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে দুটি জঙ্গিগোষ্ঠী। আগের দুটি সংগঠনের ভেতর থেকে জন্ম নেওয়া এ দুই সংগঠন গত সাড়ে তিন বছরে ৬২টি হামলায় জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছে ৯৪ জন। এর মধ্যে সর্বশেষ গুলশানে হামলার মধ্য দিয়ে চরম নৃশংসতা নিয়ে হাজির হয়েছে আইএস মতাদর্শ অনুসরণকারী গোষ্ঠীটি। এ হামলার পর বাংলাদেশের নাম সন্ত্রাসবাদী হামলার বৈশ্বিক মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
২০১৩ সাল থেকে মাঠে নামা দুই জঙ্গি সংগঠনের একটি হলো আল-কায়েদার অনুসারী আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (বর্তমান নাম আনসার আল ইসলাম) এবং অপরটি সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী ‘নব্য জেএমবি’, যারা নিজেদের আইএস দাবি করে। লক্ষ্যবস্তু বা টার্গেট এখন পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন হলেও দুটি সংগঠনই সালাফি বা আহলে হাদিস মতাদর্শী। দুই গোষ্ঠীরই সদস্যদের বড় অংশ তরুণ এবং ইংরেজিমাধ্যম স্কুল ও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করা সচ্ছল পরিবারের সদস্য।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইংরেজিমাধ্যমে পড়ুয়া ও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে এ দেশে ধর্মভিত্তিক উগ্র গোষ্ঠীর তৎপরতা শুরু হয়েছে অন্তত দেড় দশক আগে। আর এর শুরুটা করেছে ধর্মভিত্তিক আরেক সংগঠন বর্তমানে নিষিদ্ধ হিযবুত তাহ্রীর। এর পরপর যুক্ত হয় জামাআতুল মুসলেমিন নামে আরেক সালাফিবাদী সংগঠন, যার গর্ভ থেকে জন্ম নেয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম।
সূচনায় হিযবুত তাহ্রীর: খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন দেশে সক্রিয় আন্তর্জাতিক সংগঠন হিযবুত তাহ্রীর বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশ করে ২০০১ সালে। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়া কিছু ব্যক্তির মাধ্যমে যুক্তরাজ্য থেকে হিযবুত তাহ্রীর মতাদর্শ এ দেশে আসে।
সম্পূর্ণ নগরকেন্দ্রিক এই সংগঠন শুরু থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের লক্ষ্যবস্তু করে কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৩ সাল থেকে হিযবুতের কার্যক্রম দৃশ্যমান হতে শুরু করে। শুরুর দিকে মূলত ঢাকার বিভিন্ন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মিলনায়তনে ঘরোয়া সভা-সেমিনার করত তারা। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা ভঙ্গ করে ঢাকায় মিছিল-সমাবেশ করে সংগঠনটি প্রথম দেশের গণমাধ্যমের দৃষ্টি কাড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) কয়েকজন শিক্ষকের নেতৃত্বে দেশে হিযবুত তাহ্রীরের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে সংগঠনটি ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিস্তার লাভ করে। এর মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য।
হিযবুত তাহ্রীর মনে করে, গণতন্ত্র একটি ‘কুফরি’ মতবাদ। তাই গণতন্ত্র ‘অবশ্য পরিত্যাজ্য’। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংগঠনটির পোস্টার, পুস্তিকা, প্রচারপত্রেও একই রকম কথা বলা হয়।
সংগঠনটি নিষিদ্ধ হওয়ার আগে বিভিন্ন সময়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে হিযবুতের শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতার কথা হয়। তাঁরা দাবি করেন, তাঁরা অন্য জঙ্গি সংগঠনের মতো নাশকতা বা সশস্ত্র পন্থায় লক্ষ্য অর্জনে বিশ্বাসী নন। তাঁরা মনে করেন, মুসলিমপ্রধান দেশে সরকারি বাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এ জন্য সরকারি বাহিনী ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের সন্তানদের প্রতি সংগঠনটির বাড়তি আগ্রহ রয়েছে। নিষিদ্ধ হওয়ার আগে-পরে সরকারি বাহিনীর উদ্দেশে পোস্টার, প্রচারপত্রও প্রকাশ করে হিযবুত তাহ্রীর।
২০০৮ সালে সংগঠনটির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেছিলেন, তখন পর্যন্ত তাঁদের সদস্যসংখ্যা ১০ হাজারের অধিক। যাঁদের অধিকাংশই রাজধানীকেন্দ্রিক। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট ও কুমিল্লায় সংগঠনটির কার্যক্রম আছে, সদস্যসংখ্যা খুব বেশি নয়।
সরকার ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর ‘জননিরাপত্তার স্বার্থে’ হিযবুত তাহ্রীরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর সংগঠনটির বেশ কিছু সদস্য গ্রেপ্তার হন। তবে তাঁদের কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। শুরুর দিকে সদস্যদের অনেকে লেখাপড়া শেষ করে বিভিন্ন ইংরেজিমাধ্যম স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি নিয়েছেন। এঁরা সদস্য সংগ্রহে একটা বড় ভূমিকা রাখেন বলে অভিযোগ আছে।
জামাআতুল মুসলেমিন: হিযবুত তাহ্রীরের অনেকটা কাছাকাছি সময়ে জামাআতুল মুসলেমিন নামে আরেক কট্টরপন্থী সংগঠন গোপন সাংগঠনিক কার্যক্রম চালালেও তারা খুব একটা আলোচনায় আসেনি। সংগঠনটি আল-কায়েদার আরব উপদ্বীপের নেতা ইয়েমেনের আনওয়ার আওলাকির অনুসারী। এ সংগঠনটিও ইংরেজিমাধ্যমে পড়া এবং সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের লক্ষ্যবস্তু করে সদস্য সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করে। তবে গ্রামের, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের দরিদ্র পরিবারের সন্তান এবং মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছে এমন সদস্যও এই দলে ছিল।
জামাআতুল মুসলেমিনের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানও ছিল, যার কার্যক্রম এখন বন্ধ। নাম রিসার্চ সেন্টার ফর ইউনিটি ডেভেলপমেন্ট (আরসিইউডি)। ২০০৫ সাল পর্যন্ত রাজধানীর ধানমন্ডিতে এর কার্যালয় ছিল। এটি দেশি-বিদেশি জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের কাজ করত বলে অভিযোগ ছিল। এ নিয়ে ২০১১ সালের ২ মার্চ প্রথম আলোয় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তার আগে ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. আবদুর রশিদ চৌধুরী এ প্রতিবেদককে বলেছিলেন, আরসিইউডির মূল উদ্যোক্তা রেজাউল রাজ্জাক, যিনি ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক লস্করের ছেলে।
২০১৩ সালের জুনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জঙ্গি প্রতিরোধ ও প্রতিকার কমিটিতে উত্থাপিত এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জামাআতুল মুসলেমিনের আমির হিসেবে রেজাউল রাজ্জাকের নাম উল্লেখ করা হয়। সংগঠনটি সম্পর্কে আর কোনো তথ্য ওই নথিতে নেই।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেজাউল রাজ্জাক যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে ঢাকার বনানীতে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০১৪ সালে প্রথম আলোকে জানিয়েছিল, রেজাউল রাজ্জাক ২০১০ সালের জুন থেকে তাদের সঙ্গে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা রেজাউল রাজ্জাকের নথিতে তাঁর স্থানীয় ঠিকানা ছিল না। আমেরিকার একটি ঠিকানা দেওয়া ছিল। রেজাউল বর্তমানে মালয়েশিয়ায় আছেন বলে পুলিশের একটি সূত্র জানায়।
আরসিইউডি ও জামাআতুল মুসলেমিনের কেউ কেউ ইয়েমেনে গিয়ে আল-কায়েদার নেতা আনোয়ার আওলাকির (পরে নিহত) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। জানা গেছে, জামাআতুল মুসলেমিন বিলুপ্ত হওয়ার আগে শেষ আমির ছিলেন ইজাজ হোসেন ওরফে কারগিল। তাঁর বাসা ছিল রাজধানীর কলাবাগানে। তিনি ২০০৮ সালে পাকিস্তানে চলে যান।
আনসার আল ইসলাম: জামাআতুল মুসলেমিন থেকেই ২০০৭ সালের শেষ দিকে বা ২০০৮ সালের শুরুতে জন্ম নেয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলাম। জন্মসূত্রে সংগঠনটি সালাফি মতাদর্শী এবং আল-কায়েদার নেতা আনওয়ার আওলাকির অনুসারী। আনসারুল্লাহর সদস্যদের বেশির ভাগই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, বিত্তবানের সন্তানও রয়েছে। তবে অল্প শিক্ষিত ও মাদ্রাসাপড়ুয়াও রয়েছে, যারা সংখ্যায় বেশ কম। শুরুতে এদের ইন্টারনেটকেন্দ্রিক তৎপরতা ও প্রচারণা ছিল ব্যাপক।
ইউটিউবে থাকা আনসারুল্লাহর প্রধান তাত্ত্বিক নেতা মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানীর বিভিন্ন বক্তৃতা ও খুতবা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ সংগঠনটির সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য সশস্ত্র লড়াই। তবে তার আগে সদস্য সংগ্রহ ও আর্থিক সামর্থ্য অর্জনকে জরুরি মনে করে এরা। রাহমানী সর্বশেষ রাজধানীর বসিলায় একটি মসজিদের খতিব ছিলেন।
২০১৩ সালে আনসারুল্লাহর প্রধান মুফতি জসিমউদ্দীনসহ আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তখন ঢাকার ডিবির একাধিক সূত্র জানিয়েছিল, জামাআতুল মুসলেমিনের ইজাজ হোসেন আনসারুল্লাহর অন্যতম প্রধান। তিনি পাকিস্তানে বসে ইন্টারনেট যোগাযোগের মাধ্যমে সংগঠনের কর্মীদের সক্রিয় রাখছেন।
২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যার পর এই সংগঠনের কথা প্রথম জানাজানি হয়। ওই ঘটনায় সরাসরি জড়িত সবাই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই মামলার বিচার শেষে রায়ে দুজনের ফাঁসি এবং মুফতি রাহমানীসহ বাকি পাঁচজনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়।
গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টির পর থেকেই তাদের ভাষায় ‘নাস্তিক, ধর্মের অবমাননাকারী ব্লগার’দের হত্যার বিষয়ে আনসারুল্লাহর প্রধান জসিমউদ্দীন রাহমানী ফতোয়া দিচ্ছিলেন এবং খুতবায় বয়ান করে আসছিলেন। এসব তাঁরা তাঁদের ওয়েব পেজে প্রচারও করেছেন।
২০১৩ সালে রাজীব হত্যার পর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ২০১৫ সালে আবার হত্যাকাণ্ড শুরু করে আনসারুল্লাহ। তার আগে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আল-কায়েদার নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি এক ভিডিও বার্তার মধ্য দিয়ে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা (একিউআইএস) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এর পরপরই বাংলাদেশের আনসারুল্লাহ একিউআইএসের অধিভুক্ত হয় বলে তখন ঢাকায় জঙ্গিবাদ দমনে যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ একাধিক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেছিলেন। এরপর আনসারুল্লাহ নাম পাল্টিয়ে আনসার আল ইসলাম নাম ধারণ করে এবং নিজেদের একিউআইএসের বাংলাদেশ শাখা দাবি করে। আনসারুল্লাহ বা আনসার আল ইসলাম এ পর্যন্ত ১৩ জনকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। এঁদের বেশির ভাগই ব্লগার। এর বাইরে রয়েছেন প্রকাশক, শিক্ষক ও সমকামীদের অধিকারকর্মী।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, জসিমউদ্দীন রাহমানী গ্রেপ্তার হওয়ার পর আনসারুল্লাহর প্রধান হন পাকিস্তানপ্রবাসী ইজাজ হোসেন ওরফে সাজ্জাদ ওরফে কারগিল। এর আগ পর্যন্ত তিনি আনসারুল্লাহর অপারেশনাল প্রধান ছিলেন। ইজাজ গত বছর করাচিতে এক বন্দুকযুদ্ধে আল-কায়েদার আরও কয়েকজনের সঙ্গে নিহত হন। (সূত্র: পাকিস্তানের ডন পত্রিকা, ১০ জানুয়ারি ২০১৫)। এরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত ও পলাতক মেজর জিয়াউল হককে আনসারুল্লাহর সামরিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে খবর বের হয়। দিন কয়েক আগে এই জিয়াকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ।
আনসারুল্লাহর কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মেজর জিয়া দায়িত্ব নেওয়ার পর সংগঠনটির হত্যাযজ্ঞের সংখ্যা বেশ বেড়ে যায়। মূলত চাপাতি ব্যবহার করলেও শেষ দিকে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারও করেছেন তাঁরা।
এখন পর্যন্ত নাশকতা বা বিস্ফোরক ব্যবহার না করলেও গত ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকায় সংগঠনটির তিনটি আস্তানা থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধারের দাবি করেছে পুলিশ। তাদের আস্তানায় তখন গাড়িবোমা তৈরির আলামত মিলেছিল বলেও পরে খবর বের হয়।
নব্য জেএমবি: গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে দেশে ভিন্ন মাত্রার সন্ত্রাসবাদী হামলা ও সিরিয়া-ইরাকভিত্তিক আইএসের নামে দায় স্বীকার করে ব্যাপক আলোচনায় আসে এই জঙ্গিগোষ্ঠীটি। তবে সরকার ও পুলিশ বলছে, এরা ‘নব্য জেএমবি’। পুরোনো জেএমবির একটি অংশ বেরিয়ে এসে নতুন নেতৃত্বে সক্রিয় হয়েছে।
অবশ্য এই ‘নব্য জেএমবি’ নিজেদের আইএস দাবি করে। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে পুরোনো জেএমবির অনেক তফাত। নব্য জেএমবির সদস্যদের একটা বড় অংশ আধুনিক, বিত্তবান পরিবারের সন্তান, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আইএস যাদের শত্রু মনে করে, এরাও তাদের শত্রু মনে করে। এরাই এ দেশে প্রথম শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করেছে। এ ছাড়া একের পর এক পুরোহিত, সেবায়েত, বৌদ্ধভিক্ষু, খ্রিষ্টানধর্মের মানুষ ও বিদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে। এসব হত্যার পর নিহতদের ‘ক্রুসেডার’ আখ্যা দিয়ে আইএসের নামে দায় স্বীকার করা হয়।
বিভিন্ন সময়ে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আইএস অনুসারী এই জঙ্গিগোষ্ঠী সংগঠিত হচ্ছিল বছর তিনেক ধরে; যার প্রথম প্রকাশ সম্ভবত ২০১৩ সালের ৮ আগস্ট খুলনার খালিশপুরে উম্মুল মোমেনিন দাবিদার কথিত ধর্মীয় নেতা তৈয়বুর রহমান ও তাঁর কিশোর ছেলেকে জবাই করে হত্যার ঘটনা। এর চার মাস পর ২১ ডিসেম্বর ঢাকার গোপীবাগে ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি দাবিদার লুৎফর রহমানসহ ছয়জনকে একই কায়দায় হত্যা করা হয়।
এরপর গত বছরের ২১ এপ্রিল আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতির আগ পর্যন্ত এই গোষ্ঠীর হত্যাযজ্ঞের খবর পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, এই দেড় বছর ছিল তাদের প্রস্তুতির পর্ব। এই নব্য জেএমবিতেও যে শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের সন্তান, ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভিড়ছে, তা অনেক আগেই আঁচ করা যাচ্ছিল। ২০১৪ সালে একটি বহুজাতিক কোম্পানির আইটি শাখার প্রধান আমিনুল বেগ এবং একাধিক সামরিক-বেসামরিক পদস্থ কর্মকর্তার ছেলে ও লন্ডনপ্রবাসী গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
গুলশানে হামলায় নিহত এবং পরে কল্যাণপুরে পুলিশের অভিযানে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে, এঁদের আচরণে পরিবর্তন দেখা গেছে বছর তিনেক আগে থেকে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলা এবং ৩ অক্টোবর রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে হত্যার পর আইএস দায় স্বীকার করলে সরকার তা জোরের সঙ্গে নাকচ করে দেয়। তবে আইএস আছে বা নেই—এই বিতর্কে হত্যাকাণ্ড থেমে থাকেনি। এই গোষ্ঠী সারা দেশে গত ১০ মাসে ৪২টি হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি ঘটনায় আইএস দায় স্বীকার করেছে। সর্বশেষ দায় স্বীকার করে গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার। কেবল তা-ই নয়, ১২ ঘণ্টার জিম্মি সংকট চলাকালে ভেতরের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কয়েক দফা আপডেট ও নিহত ব্যক্তিদের ছবি প্রকাশ করেছে এই গোষ্ঠী।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স অ্যান্ড টেররিজমের (আইসিপিভিটি) প্রধান রোহান গুনারত্ন রয়টার্সকে বলেছেন, তিনি গবেষণায় পেয়েছেন যে, বাংলাদেশের জঙ্গিরা আইএসের কাছ থেকে আর্থিকসহ সাংগঠনিক নির্দেশনা ও অন্যান্য সহায়তা পেয়েছে। ৩ আগস্ট রয়টার্সের এ-বিষয়ক এক প্রতিবেদনে রোহান গুনারত্নের এই বক্তব্য উল্লেখ করা হয়। এর আগে গত ২১ মে থেকে রোহান গুনারত্নের নেতৃত্বে আইসিপিভিটি ঢাকায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের সদস্যদের পাঁচ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ দিয়েছিল।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন এসব জঙ্গি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। গত কয়েক বছরে বেশ কিছু জঙ্গি গ্রেপ্তার হলেও পরিস্থিতি যে এত ভয়ংকর পর্যায়ে যাচ্ছে, তা অনুধাবনের ক্ষেত্রে সরকারের বাহিনীগুলোর ঘাটতি ছিল। তবে গুলশান হামলার পর সরকার জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। গত ২৬ জুলাই ভোরে ঢাকার কল্যাণপুরে পুলিশের অভিযান এবং নয় জঙ্গি নিহত হওয়ার ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, গুলশান হামলার মতো আরেকটি ভয়ংকর হামলা থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে।
তবে এখনো মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়ে গেছে। একই সঙ্গে দেশের সব মহলে জঙ্গিবাদবিরোধী একটা মতৈক্য তৈরি হয়েছে।
সিরিয়ায়ও গেছেন কেউ কেউ: গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে গুলশান ও রংপুরে দুই বিদেশি হত্যার আগ পর্যন্ত পুলিশ অনেকগুলো সংবাদ ব্রিফিংয়ে, মামলায় আইএসের সমন্বয়কারী, ‘রিক্রুটার’ বা সিরিয়ায় যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের কথা বলেছে। এর মধ্যে আইএস সন্দেহে ২০১৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা দেশে আইএসের মতাদর্শ প্রচারে জড়িত ছিলেন এবং সিরিয়ায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে পুলিশ তখন বলেছিল। আইএস অনুসারী এই গোষ্ঠী দেশি-বিদেশি জঙ্গিনেতাদের বক্তব্য, পুস্তিকা এবং বোমা তৈরি ও জঙ্গি প্রশিক্ষণের নির্দেশিকা বাংলায় অনুবাদ করে ইন্টারনেটে নিজস্ব ওয়েব পেজে ও অনলাইনে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করছিল।
২০১৫ সালের ২৪ মে আমিনুল বেগ ও সাকিব বিন কামাল নামে দুজনকে গ্রেপ্তারের পর ডিবি কর্মকর্তারা বলেছিলেন, দেশের কিছু যুবক আইএসের পক্ষে লড়াই করতে সিরিয়া বা ইরাকে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আমিনুল বেগ এমন একটি দলের নেতা। কয়েকজন আইএসে যোগ দিতে সিরিয়ায় চলে গেছেন। আরও ২০-২২ জন যাওয়ার চেষ্টায় আছেন। এমন কিছু ব্যক্তিকে পরবর্তী সময়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বলে তখন পুলিশের পক্ষ থেকে বলাও হয়েছিল। আমিনুল বেগ ও সাকিব এখন কারাগারে আছেন।
বাংলাদেশ থেকে কেউ সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছে কি না, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে এ পর্যন্ত ১৫ জন বাংলাদেশির নাম এসেছে, যাঁরা সিরিয়া গেছেন বলে মনে করা হয়। এঁদের মধ্যে দুজন সেখানে মারাও গেছেন। একজন বিডিআর বিদ্রোহে নিহত এক সেনা কর্মকর্তার ছেলে আশিকুর রহমান এবং অপরজন সাইফুল হক, যনি ২০১৪ সালের আগস্টে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সিরিয়ায় যান। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর আইএসের কথিত রাজধানী সিরিয়ার রাকায় বিমান হামলায় নিহত হন সাইফুল। ২৯ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এ খবর প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, সাইফুল আইএসের শীর্ষস্থানীয় ১০ জনের একজন ছিলেন। তিনি আইএসের হয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের পরিকল্পনাকারী, হ্যাকিং কর্মকাণ্ড, নজরদারি প্রতিরোধ প্রযুক্তি ও অস্ত্র উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
দ্য ফিসক্যাল টাইমস নামে মার্কিন সাময়িকীর গত বৃহস্পতিবারের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস দ্রুত ভূমি হারাচ্ছে। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করছেন, এটা নতুন এক উদ্বেগের জন্ম দিতে পারে। এটা শুধু পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হবে না। মার্কিন প্যাসিফিক কমান্ডের কমান্ডার অ্যাডমিরাল হ্যারি হ্যারিস সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমার বিশ্বাস, ভারত-এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করছে আইএস।’ সাময়িকীটি বলেছে, মার্কিন সেনা কর্মকর্তার এই বক্তব্য এমন এক সময় এলো, যখন বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনের মতো এশিয়ার দেশগুলোয় একের পর এক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটছে।
জঙ্গিবাদ বিষয়ক গবেষক, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজের মতে, এখন যে পরিস্থিতি, তাতে আল-কায়েদা না আনসারুল্লাহ, আইএস না জেএমবি বলব; এ বিতর্কের সময় পেরিয়ে গেছে।
আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, বৈশ্বিকভাবে জঙ্গিবাদ উত্থানের একটা পরিবেশ তৈরি রয়েছে। এখন দেশের অভ্যন্তরেও অনুকূল পরিবেশ থাকলে তা দ্রুত বন্ধ করতে হবে। কেবল সামরিকভাবে পদক্ষেপ নিয়ে বা জঙ্গিদের মেরে দমন করা যাবে না। একটা রাজনৈতিক কৌশল থাকতে হবে, যাতে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে যুক্ত করা যায়। (শেষ)
আরও পড়ুন :