১৯৮৫–৮৬ সালের কথা। বাবার চাকরির সূত্রে আমরা তখন চট্টগ্রাম থাকি। আমার বয়স ১১–১২ বছর। প্রতিদিন স্কুল শেষ করেই বাড়ি ফিরে গোসল–খাওয়াদাওয়ার পর বিকেলে খেলতে বেরিয়ে যাই, মাগরিবের আজানের আগেই বাড়ি ফিরি—নইলে বাবার বকা খাওয়ার ভীষণ ভয়। আসলে ফিরতে দেরি হলে বাবা কী করবেন—সেটি জানা ছিল না, কিন্তু মা ওই বকার এমন একটা চিত্র আমাদের মনে এঁকে দিয়েছিলেন যে মাগরিবের আজানের আওয়াজ শোনামাত্র একছুটে বাড়ি ফিরে আসতাম। বেশির ভাগ দিন বাবা ফেরার আগেই বাড়ি পৌঁছাতাম। পৌঁছেই বাবার জিপের আওয়াজের অপেক্ষায় থাকতাম। গাড়ির আওয়াজ শোনামাত্র ভীষণ মনোযোগী ভাব করে দুই ভাইবোন পড়ালেখার ভান করতাম।
যেদিন বাবা আহ্লাদি গলায় পূর্বাকে (আমার একমাত্র ছোট বোন) ‘মামণি’ বলে ডাক দিতেন, আমরা বুঝে যেতাম, আজ বাবার মুড ভালো। ব্যস, একদৌড়ে মা-বাবার ঘরে। বাবার হাতে কিছু না কিছু থাকতই আমাদের জন্য। আধা সরকারি আটপৌরে চাকুরির ওই কটা টাকাতেও সুখের ছড়াছড়ি ছিল বাড়িতে। আর সপ্তাহের শেষে কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাওয়া। তেমনই এক সপ্তাহান্তে সন্ধ্যায় এসে বাবা ঘোষণা করলেন, ‘কাল আমরা চায়নিজ খেতে যাব, “তুং ফং” বলে এক চীনা রেস্তোরাঁয়।’ সে কী উত্তেজনা আমাদের! রাতে তো ঘুমই আসতে চাইল না! আমার ও পূর্বার কত কী যে আলাপ আর কল্পনা সেই তুং ফংকে ঘিরে! সকালে স্কুলে পৌঁছে বন্ধুদের বলতেই বন্ধুরাও ভীষণ অবাক—বাইরের রেস্তোরাঁয় খেতে যাচ্ছি, তা–ও আবার চায়নিজ, সে এক বিশাল ঘটনা!
সন্ধ্যাবেলায় বেশ সেজেগুজে আমরা তুং ফংয়ের সামনে গিয়ে নামলাম। গাড়ি থেকে নামতেই চীনামতো দেখতে এক ফরসা, সুদর্শন ভদ্রলোক বাবাকে উদ্দেশ করে ‘জিন্নাহ ভাই, কেমন আছেন?’ বলে এগিয়ে এসে আমাদের রিসিভ করলেন। আমি আর পূর্বা তখনো বুঝতে পারছি না যে এই চীনা ভদ্রলোক এমন সুন্দর বাংলা বলছেন কীভাবে? ভদ্রলোক মিষ্টি হেসে আমাদের অনেক আদর করে ভেতরে নিয়ে গেলেন (পরে জানতে পারি, উনি আসলে বাংলাদেশি, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাড়ি, সাদি মামার বন্ধু)।
সেই চীনা রেস্তোরাঁর ভেতরে ঢুকে তো আমাদের বিস্ময়ের শেষ নেই! বেশ একটা লাল লাল আলো–আঁধারি। জীবনে প্রথম পায়ের ওপর ন্যাপকিন পেতে ছুরি–কাঁটা চামচ দিয়ে খাওয়া। তুং ফংয়ে খাওয়া সেই চিকেন কর্ন স্যুপ আর উনথুনের স্বাদ এবং বিস্ময় আমার আজও কাটেনি। এই গল্প যদি আজ আমার মেয়ে রাজর্ষি ও অন্নপূর্ণাকে বলি, ওরা বিশ্বাসই করবে না। হেসে কুটি কুটি হবে আর বলবে, ‘ইউ আর সো ওল্ড!’
মা–বাবার আদরের ছেলে, একদমই মাছ খেতে চায় না, শুধু চিকেন, সেই ছেলে দিব্যি জাপানি রেস্টুরেন্টে বসে সুশি খেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে। যাক বাবা, বাঁচা গেল, তাহলে আজও মাছে-ভাতে বাঙালি বলা যাবে!আজকের ঢাকার যা অবস্থা, তাতে আমাদের গল্প প্রাগৈতিহাসিকই মনে হওয়ার কথা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দশ কদম হাঁটলেই দেখি ঝাঁ–চকচকে ক্যাফে। অর্ডার দিতে গিয়ে আরেক ঝামেলা—দশ রকমের কফি; কোনটা অর্ডার দিই! আচ্ছা ঠিক আছে, কফি বাদ দিলাম, চায়ের দিকে এগোই। ওরে বাবা, এখানে তো ১২ রকমের চা! তা–ও যা বুকে বল নিয়ে চা–কফি কিছু একটা অর্ডার করা গেল, কিন্তু স্ন্যাকের কী করি? আস্তে করে ক্যাশ কাউন্টারে জিজ্ঞাসা করতে যাব, অমনি পাশ থেকে এক জোড়া আধুনিক ছেলেমেয়ে ফরফর করে দুটো ক্যারামেল মাকিয়াতো, একটা বিফ কিশ আর একটা স্মোকড চিকেন স্যান্ডউইচ উইথ ব্রাউন ব্রেড অর্ডার করে চলে যেতেই আমি বললাম, ‘আমিও তা–ই।’ সেটি শুনে ক্যাশ কাউন্টারের ছেলেটা মৃদু হেসে বলে, ‘তাহলে আগেরটা?’ আমি বলি, ‘ওটা আউট, এইটা ইন।
ঢাকায় রোজ গজাতে থাকা রেস্তোরাঁগুলো দেখি আর ভাবি, ‘এত রেস্তোরাঁয় খাবে কে?’ আবার এরই কোনো একটায় যদি সপ্তাহের মাঝখানেও হঠাৎ যাওয়া পড়ে, তখন ম্যানেজার জিজ্ঞাসা করেন, ‘স্যার কি রিজার্ভেশন করেছিলেন?’ আমি কোনো রকমে মুখ কাঁচুমাচু করে ‘না’ বলতেই ম্যানেজার মেকি হাসি দিয়ে বলেন, ‘স্যার, ভেরি সরি, উই আর ফুললি বুকড।’
মা–বাবার আদরের ছেলে, একদমই মাছ খেতে চায় না, শুধু চিকেন, সেই ছেলে দিব্যি জাপানি রেস্টুরেন্টে বসে সুশি খেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে। যাক বাবা, বাঁচা গেল, তাহলে আজও মাছে-ভাতে বাঙালি বলা যাবে! বন্ধুরা মিলে কোথাও খেতে যাবেন, জিজ্ঞাসা করলেই এক বন্ধু বলে উঠবে, ‘নারে, ওই থাই, চায়নিজ, স্টেকে আর পোষাচ্ছে না, নতুন কোথাও যাই।’ পাশ থেকে আরেকজন বলবে, ‘বনানীতে খুব ভালো একটা বাংলা ফুডের রেস্তোরাঁ হয়েছে, রিভিউ খুব ভালো, ওখানে চল।’ বেশ উৎসাহ নিয়ে গেলেন, কিছু তৃপ্তি, কিছু অতৃপ্তি নিয়ে খেয়ে বাড়ি ফিরতেই মা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিরে, কী খাইলি আজ?’ খাবারের নাম বলতেই মা বললেন, ‘এর পরেরবার খাইতে মন চাইলে টাকাগুলা আমারে দিস, এর চেয়ে ভালো রান্ন করে খাওয়ামুনে। বাসায় তো কলার মোচা আর পাবদা মাছ রানলে খাইতে চাস না।’
এই বিশ্বায়নের যুগে আজকের এই আধুনিক, তরুণ বাঙালির যে কখন, কোথায়, কী খেতে মন চায়, বোঝা মুশকিল। তবে আমরা এখন অনেক কিছুই যেমন নতুন করে খেতে শিখেছি, তেমনি পুরোনো, ঐতিহ্যবাহী খাবারের চাহিদাও কিন্তু মোটেই কমেনি। ভিড় ঠেলে পুরান ঢাকার নাজিরা বাজার অথবা চকবাজারে গিয়ে মাটন গ্লাসি কিংবা বিরিয়ানি খাওয়ার আগ্রহ কিন্তু আজও পুরোদস্তুর বিদ্যমান।
অনেকের আবার এটুকুতে হচ্ছে না। ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে শহরের বাইরে গিয়ে অথবা শহরের মধ্যেই অদ্ভুত কোনো জায়গায় নতুন নতুন সব খাবারের দোকান খুঁজে বের করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে সেসব খবর ছড়িয়ে দিচ্ছে আরও লাখো ব্যক্তি। মিরপুরের কোন চিপায় কোয়েল পাখির ডিম ভাজা পাওয়া যায় কিংবা মিরপুর সাড়ে এগোরোর কোথায় গেলে খুশবুদার কাবাব পাওয়া যায়, তা কিন্তু এখন ফেসবুকের কল্যাণে সবার মুখে মুখে।
এখন কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে বাইরে খাওয়ার এই সংস্কৃতি হঠাৎ এমন বেড়ে গেল কেন? তাহলে কি বাড়ির মা-বউদের রান্না হঠাৎই খারাপ হয়ে গেল? নাকি মা-বউরা রান্নায় হরতাল ডেকেছে? এটা ঠিক যে শহুরে জীবনব্যবস্থায় মেয়েরাও আজকাল বেশ কাজ করছে এবং এর ফলে বাড়িতে রান্নাবান্নার যে বেশ একটা বিশদ ব্যবস্থা ছিল প্রতিদিন, তাতে একটুখানি ছেদ পড়েছে বৈকি। তবে আমার মনে হয় না, সেটাই একমাত্র কারণ। আসলে আজকের তারুণ্যনির্ভর জনগোষ্ঠী এই বিশ্বায়নের যুগে নানান কিছু চেখে দেখতে চায়, নানান দেশের খাবারের স্বাদ নিতে চায়। সেসব দিক বিবেচনা করে ব্যবসায়ীরাও সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে। বিদেশ থেকে শেফ আসছে, নতুন নতুন রেস্তোরাঁ খুলছে। অন্যদিকে সর্বোপরি পকেটের অবস্থাটাও আগের চেয়ে ভালো, তাই খরচাপাতি করার সক্ষমতাও বেড়েছে। আমার ধারণা, শুধু বাইরে খাওয়া কেন, ঠিকমতো ভাবতে পারলে এবং নতুন নতুন আইডিয়া করতে পারলে বিনোদনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও আমরা একই রকমের হইচই দেখতে পাব, যেটা আমরা একটু একটু করে দেখতে পাচ্ছি অনলাইন বিনোদনের ক্ষেত্রে।
সৈয়দ গাউসুল আলম শাওন : গ্রে অ্যাডভাটাইজিং বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক