গড় আয়ু বৃদ্ধির পেছনে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে নবজাতক মৃত্যুর হার হ্রাস। একটা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কেমন, সেটি নবজাতক মৃত্যুর হার থেকে অনুমান করা যায়।
অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন হলে মানুষের গড় আয়ু বাড়ে, নাকি গড় আয়ু বাড়লে অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত হয়—প্রশ্নটা অনেকটা ডিম আগে না মুরগি আগের মতো। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে গড় আয়ুর ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে।
বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস ৩০ বছর ধরে দেশের মানুষের গড় আয়ুর হিসাব রাখছে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে নারীদের গড় আয়ু ছিল ৫৫ দশমিক ৩ বছর। পুরুষদের ৫৪ দশমিক ৫ বছর। ২০১৭ সালে এসে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে এমন—নারীদের গড় আয়ু ৭৩ দশমিক ৫, পুরুষের ৭০ দশমিক ৬ বছর। শুরুতেই যা বলছিলাম, এই যে গত ৩৭ বছরে মানুষের গড় আয়ু ১৫-১৯ বছর বাড়ল, একে নিশ্চয়ই আমরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটা সূচক হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।
গড় আয়ু বৃদ্ধির পেছনে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে নবজাতক মৃত্যুর হার হ্রাস। একটা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কেমন, সেটি নবজাতক মৃত্যুর হার থেকে অনুমান করা যায়। বিদেশ থেকে কেউ যখন আসে, আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চায়, প্রশ্ন করে, তোমাদের এখানে নবজাতক মৃত্যুর হার কত? এ ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন খুব বড় না হলেও সংখ্যাটা কিছুটা কমেছে। শিশুমৃত্যুর হার কমলেই দেশের মানুষের গড় আয়ু অনেকটা বাড়ে।
‘নবজাতকের মৃত্যু’ বলতে আমরা বুঝি জন্মের পর ১ বছরের মধ্যে মৃত্যু। আমাদের দেশে অবশ্য ২৮ দিনের মধ্যে মৃত্যুর হার এখনো বেশি। সরকারের জন্য আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা হলো স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ক্লিনিক বা হাসপাতালে প্রসবের সংখ্যা বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে আমরা এখনো অনেক নিচে আছি। বাড়িতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রীকে দিয়ে প্রসব করানোর মাধ্যমে নবজাতক মৃত্যুর হার কিছুটা কমেছে, এটা ভালো দিক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের আরও উন্নতি করার সুযোগ আছে।
সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার সুযোগ বেড়েছে। সহজে পৌঁছানো যায় না, বাংলাদেশে এখন এমন জায়গা কম। স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু যা–ই হোক না কেন, মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। গড় আয়ু বাড়ার পেছনে প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত জায়গা থেকে একটা অবদান আছে। প্রত্যেকে নিজের উন্নয়নের চেষ্টা করছে, সাধ্যের মধ্যে সেরা স্বাস্থ্যসেবাটা পেতে চেষ্টা করছে, ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। দেখবেন এখন অনেকেই স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার জন্য বিদেশে যায়, ই–মেইলে চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, রিপোর্ট পাঠিয়ে দেয়। যোগাযোগ সহজ হওয়ার কারণে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ বেড়েছে।
গড় আয়ু বাড়লে সেটা একটা দেশের স্বাস্থ্যসেবার ওপর নতুন স্বাস্থ্য চাহিদার প্রভাব ফেলে। এই নতুন চাহিদার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আমরা কতটুকু প্রস্তুত, সেটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ। কী কী প্রভাব পড়ে? যেমন ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত রোগ, ক্যানসারের মতো অসংক্রামক রোগ বাড়তে থাকে। কারণ, এই অসুখগুলো বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে। অতএব, গড় আয়ু বাড়লেই হবে না, বয়স্কদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশে দেখবেন, বয়স্করা যখন বাস থেকে নামেন, বাসটা নিচু হয়ে যায়। ফুটপাত বরাবর আসে। আমরা যদি বয়স্কবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে না পারি, তাহলে অন্যদিক দিয়ে ঝুঁকি বাড়বে। এমনকি হাসপাতালে যখন রোগী যাবে, রোগী যেন হুইলচেয়ারে উঠতে পারে, সেই ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
অসংক্রামক রোগের সেবা দেওয়ার জন্য সুযোগ–সুবিধার পাশাপাশি যে লোকবল দরকার, সেটাই–বা আমাদের কতটুকু আছে? যেমন ফিজিওথেরাপির কথা ধরুন। কিংবা কোমর প্রতিস্থাপন, হাঁটু প্রতিস্থাপন। বেসরকারিভাবে কোনো কোনো হাসপাতালে এই সুযোগ আছে, সরকারি সুযোগ এখনো অনেক কম। চোখের ছানি অপারেশনের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। সেটাও বেশ ব্যয়বহুল। এটাকে আরও সাধ্যের মধ্যে আনতে হবে। ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ—এসব যে শুধু ধনীদের হচ্ছে, তা তো নয়।
যেহেতু বয়স্ক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, চিকিৎসকদের পাঠ্যক্রমেও অসংক্রামক রোগগুলোকে আরও বেশি প্রাধান্য দেওয়া দরকার। যেন আমরা সঠিক চিকিৎসাসেবা দিতে পারি।
বয়স্কদের জন্য আরও যা প্রয়োজন তা হলো সঠিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা । এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের চিত্র দেখা যায়। একদল ছেলেমেয়ে বিদেশে চলে যায়, দেশে মা–বাবার দেখাশোনা করার মতো তেমন কেউ থাকে না। আবার আরেক ধরন আছে, যারা সামর্থ্য নেই বলে মা–বাবাকে গ্রামে রাখে। শহর বা গ্রামে যেখানেই হোক, বয়স্কদের সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। সেবা বলতে আমি শুধু স্বাস্থ্যসেবার কথা বলছি না। এমন আরও অনেক কিছু আছে, যা পরোক্ষভাবে স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, যুদ্ধবিগ্রহের সঙ্গেও গড় আয়ুর সম্পর্ক আছে। দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে বাংলাদেশে বিপুল মানুষ মারা যায়। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আমরা আরও সুফল পাব। শুধু বয়স বাড়লেই হবে না, যদি মানুষ সুস্থ থেকে বেশি দিন বাঁচতে পারে, তাহলে নিশ্চয়ই সে দেশকে আরও বেশি দেওয়ার সুযোগ পাবে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘ডাই উইথ ডিগনিটি’। জন্ম হলে মৃত্যু তো হবেই। কিন্তু অবহেলায় যেন কারও মৃত্যু না হয়। মানুষ যেন মর্যাদার সঙ্গে মরতে পারে।
মাহমুদুর রহমান, সাবেক পরিচালক, রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। পরামর্শক, আইসিডিডিআরবি