সারা পৃথিবীতেই নগরায়ণ খুব দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে। অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশও এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গ্রামে কাজের অভাব, জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা আর অন্যদিকে শহরে নানামুখী কাজের সুযোগের কারণে মানুষ সেখানে পাড়ি দেয়। স্বাধীনতার পরপর দেশের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ নগরে বাস করত, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশে। নগরায়ণের হার এখন বছরে ৩ শতাংশের কিছু বেশি আর এই হারে যদি নগরায়ণ হয়, তাহলে ২০৪০ সালের মধ্যে এ দেশের জনগোষ্ঠী অর্ধেকই শহরে বসবাস করবে। শহরের দরিদ্র এলাকা, যাকে আমরা সাধারণত ‘বস্তি এলাকা’ বলে থাকি, সেখানে নগরায়ণের হার দ্বিগুণের বেশি (বছরে ৭ শতাংশ)। অর্থাৎ অন্য কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হলে একটা সময়ে দেশের বড় শহরগুলোতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর বড় অংশটি কিন্তু বস্তিতে বাস করবে।
গ্রাম ও নগরের স্বাস্থ্যের সূচকগুলো বিবেচনায় নিলে গড়ে দেখা যাবে শহরগুলোর অবস্থা ভালো। কিন্তু আমরা যদি শহরের দরিদ্র এলাকাগুলোর সঙ্গে অন্যান্য এলাকা আর গ্রামের তুলনা করি, তাহলে দেখব শহরের দরিদ্র এলাকাগুলোর পরিস্থিতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। যেমন গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরের দরিদ্র এলাকায় শিশুমৃত্যু ও শিশু অপুষ্টির হার অনেক বেশি। কিশোরী ও মাতৃস্বাস্থ্য, প্রজননসেবাসহ স্বাস্থ্যক্ষেত্রের অন্যান্য সূচকেও একই চিত্র মিলবে।
বিশ্বায়ন আর নগরায়ণের হাত ধরে বাংলাদেশ একটা রোগতাত্ত্বিক রূপান্তরের (এপিডিমিওলজিক্যাল ট্রানজিশনের) মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অসংক্রামক রোগ, যেমন হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস বা ক্যানসার—একসময় যে রোগগুলোকে প্রাচুর্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে ধারণা করা হতো, সেগুলো এখন মৃত্যুর প্রধান কারণ এবং সাধারণ আয়ের পরিবারগুলোতে, এমনকি হতদরিদ্র পরিবারেও এই রোগগুলো দেখা যাচ্ছে। অপুষ্টি আর সংক্রামক রোগ বাংলাদেশের জন্য এখনো অনেক বড় স্বাস্থ্য সমস্যা, একই সঙ্গে অতিপুষ্টি আর অসংক্রামক রোগ, বিশেষ করে শহর এলাকায় এখন বেশি দেখা দিচ্ছে। শহরে এখন একই এলাকায়, এমনকি একই পরিবারের মধ্যে এই ‘দ্বৈত চাপ’ (ডাবল বারডেন) দেখা যায়। দেশের নগর স্বাস্থ্যব্যবস্থা এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করার বা এই চাপ নেওয়ার জন্য তৈরি কি না, সেদিকে আমাদের নজর দেওয়া খুব প্রয়োজন।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখব, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় (সেকেন্ডারি) ও তা থেকে তৃতীয় মাত্রার (টারশিয়ারি) স্বাস্থ্যসেবা রেফারেল পদ্ধতির মাধ্যমে ধাপে ধাপে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যদিকে শহরগুলোতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় মাত্রার সেবার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে হলেও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া আছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের হাতে। এই সেবা দেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দাতা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে কিছু নির্বাচিত এনজিওকে নিয়োগ দিয়ে থাকে। দেশের অনেক পৌর এলাকায় আবার এ ধরনের কোনো কার্যক্রম বা প্রকল্পও নেই। বড় শহরগুলোতে অনেক এনজিওর কিছু কার্যক্রম রয়েছে। তবে এনজিওদের মাধ্যমে যে সেবা প্রদান করা হয়, তা সাধারণত মা ও শিশুকেন্দ্রিক। সব বয়সের ও সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা তাতে তেমন থাকে না। বিশেষ করে অসংক্রামক রোগ বিষয়ে কার্যক্রম নেই বললেই চলে।
সন্ধ্যায় বা ছুটির দিনে এসব সেবাকেন্দ্র অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বন্ধ থাকে। ফলে খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ সেসব সেবা নিতে পারেন না। আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের দরিদ্র মানুষের একটি বড় অংশ বেসরকারি সেবাকেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্যসেবা নেন, আর ছোটখাটো স্বাস্থ্যসেবার জন্য কাছাকাছি ফার্মেসিই তাঁদের প্রথম পছন্দ। মূলত স্বাস্থ্যসংক্রান্ত খরচ নগরবাসী নিজেরাই বহন করেন, যাকে ‘আউট অব পকেট’ বা নিজের পকেট থেকে স্বাস্থ্য খরচ বলা হয়। বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয়ের শতকরা ৬৭ ভাগ অর্থ ব্যক্তির নিজস্ব খাত থেকে খরচ হয়। অন্যান্য অনেক দেশের সঙ্গে তুলনা করলে এটা অনেক বেশি।
জনসংখ্যার তুলনায় শহর এলাকাগুলোতে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল হওয়ায় বিশাল আকারে বেসরকারি খাত গড়ে উঠেছে। চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত এই বেসরকারি খাত অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় রয়েছে। এই খাতকে যেমন নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা জরুরি, তেমনি সরকারের দায়িত্ব যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বেসরকারি খাতকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করা।
অসংক্রামক রোগ নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বেশি আর্থিক চাপে ফেলে। অসংক্রামক রোগের কারণে পরিবারের কর্মক্ষম সদস্যটির অকালমৃত্যু হলে বা তিনি অক্ষম হয়ে পড়লে অথবা সারা জীবনের জন্য অসুখগুলোর চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে হলে অনেক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে অথবা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসা তাদের পক্ষে অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। পরিবারগুলো অনেক ক্ষেত্রেই দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আটকা পড়ে যায়। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে এটি একটি বড় বাধা। নগর স্বাস্থ্যের উন্নতি তাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কার্যকর প্রভাব ফেলতে পারে।
নগর স্বাস্থ্যের মূল সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রয়োজনীয় সেবা ও দক্ষ জনবলের অভাব, তথ্য–উপাত্তের ঘাটতি, প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ না থাকা, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও সমন্বয়ের অভাব ইত্যাদি। কিছুদিন আগের ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে নগর স্বাস্থ্যের দুর্বল চিত্রটি আমাদের সামনে অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
দেশের বর্তমান সময়ের স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে নতুন কোনো সংক্রামক বা অসংক্রামক রোগ বা পুরোনো কোনো রোগের নতুন করে ফিরে আসা অথবা ভবিষ্যতে বড় কোনো দুর্যোগ এলে আমরা কীভাবে তা সামাল দেব, তা নিয়ে আমাদের পূর্বনির্ধারিত নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে। আমাদের শহরগুলোর জনঘনত্ব যেহেতু খুবই বেশি, তাই যেকোনো দুর্ঘটনা অনেক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে বা অনেক জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। দুর্ঘটনায় সারা জীবনে জন্য পঙ্গু হয়ে যাওয়া এবং এর মানসিক ধাক্কা বয়ে বেড়ানোর আশঙ্কাও থাকে যথেষ্ট।
আমাদের আরও মনে রাখতে হবে যে ‘স্বাস্থ্য’ আর ‘স্বাস্থ্যসেবা’ দুটি ভিন্ন ভাবনা। সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য অন্য সব মন্ত্রণালয়েরও স্বাস্থ্যবান্ধব নীতি থাকতে হবে, না হলে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বেড়েই চলবে। অবকাঠামো বানানোর সময় বা মিল-কারখানায় যদি যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকে এবং সে কারণে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, আগুন লাগে বা সড়কনিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ার কারণে যদি দুর্ঘটনা ঘটে, তবে এর ধাক্কাটি এসে পড়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর। রানা প্লাজা, তাজরীন বা এ ধরনের নানা দুর্ঘটনাগুলোর দায় কোনোভাবেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়, কিন্তু এর প্রাথমিক ও প্রবল চাপটি সামলাতে হয় স্বাস্থ্য বিভাগকে। আর নাগরিকের হাঁটার সুযোগ নিশ্চিত করা, শিশু-কিশোরদের খেলার জায়গা ও পার্কের ব্যবস্থা করা, নিরাপদ খাদ্য, বিশুদ্ধ বাতাস, সুপেয় পানি আর পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো করতে পারে, তবে জনস্বাস্থ্যের ওপর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ভার এতে লাঘব হবে। এগুলো সবই নগর স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত।
স্বাস্থ্য অধিকারের ব্যাপারে নাগরিকের যেমন সোচ্চার হওয়ার প্রয়োজন, তেমনি নিজেদের ও পরিবারের স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন হওয়ার দায়িত্বও নাগরিকদের রয়েছে। সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে ও বিশেষ করে নগরের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের সচেতন করতে সংবাদমাধ্যমগুলো বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে, দেশের সব এলাকার, সব বয়সের ও সব মানুষের জন্য মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করা। স্বাস্থ্যবিমার সম্প্রসারণ ও অন্যান্য উপায়ে আকস্মিক স্বাস্থ্য খরচ থেকে সাধারণ জনগণকে রক্ষা করা। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নগরের জনগণ, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী যদি পিছিয়ে থাকে, তবে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল দিকটিই উপেক্ষিত থেকে যাবে। নগর স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে নানা গবেষণা হয়েছে। এসব গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য ও উপাত্ত নিয়ে জনবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সুশাসন ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
স্বাস্থ্যবিষয়ক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সূচকগুলোর জন্য শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কেই জবাবদিহি করতে হয়। তাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেই উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যেতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, স্বাস্থ্যকে শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয় হিসেবে না দেখে সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে, নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী যেন পিছিয়ে না পড়ে।
ড. সোহানা শফিক: (সহকারী বিজ্ঞানী ও উপপ্রকল্প সমন্বয়কারী, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি, আইসিডিডিআরবি।