ক্রীড়াঙ্গন: মনে রাখার মতো যত ঘটনা

২০২১ সালটা কী অসাধারণই না ছিল ক্রীড়াঙ্গনের জন্য। করোনা বাধা হয়েছে বারবার, তবে সেই বাধা টপকে কত স্মরণীয় মুহূর্ত উপহার দিয়েছে খেলাধুলা। রূপকথার মতো গল্প, প্রতিবাদ, সাফল্যের চূড়ায় ওঠা, বন্ধুত্বের গল্প—কী ছিল না ২০২১ সালে! লিখেছেন মোহাম্মদ সোলায়মান

অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পর বাংলাদেশের মেয়েদের বাঁধভাঙা উল্লাস
ছবি: প্রথম আলো

টাইগার উডসের দুর্ঘটনা

২৩ ফেব্রুয়ারি দুঃসংবাদ এল লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে। সর্বকালের অন্যতম সেরা গলফার টাইগার উডস সড়ক দুর্ঘটনায় আহত। নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন মার্কিন তারকা, তবে নির্ধারিত সীমার প্রায় দ্বিগুণ গতিতে। একটি বাঁক ঘোরার সময় উল্টে গিয়ে রাস্তার পাশে ঝোপজঙ্গলে পড়ে দুমড়েমুচড়ে যায় উডসের গাড়ি। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও ভেঙে যাওয়া ডান পায়ে অস্ত্রোপচার করাতে হয়। পা কেটে ফেলার শঙ্কাও ছিল। তবে বছর শেষে সেই উডস ফিরেছেন গলফ কোর্সে। ছেলের সঙ্গে বিশেষ এক টুর্নামেন্টও খেলেছেন ১৫ বারের মেজর চ্যাম্পিয়ন।

মারিয়াদের সাফ জয়

ছেলেদের ফুটবলের ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়াই বাংলাদেশের নিয়তি। তবে বিজয়ের মাসে দেশকে আনন্দে ভাসিয়েছেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ ফুটবল দলের মেয়েরা। অনূর্ধ্ব-১৯ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী দল। ঢাকার বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে ফাইনালে প্রতিবেশীদের ১-০ গোলে হারায় মারিয়া মান্দার দল। এর আগে লিগ পর্বেও দুর্দান্ত খেলে ফাইনালে ওঠার পথে চার ম্যাচে ১৯ গোল করেন বাংলাদেশের মেয়েরা।

বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতীক হয়ে থাকবে সাকিবের উইকেটে লাথি মারার এই ছবি

সাকিবের লাথি

২০২১ সালটা ক্রিকেট মাঠে বাংলাদেশের তেমন একটা ভালো কাটেনি। মাঠে যেমন, মাঠের বাইরের ঘটনাতেও লেজেগোবরে হয়েছে দেশের ক্রিকেটাঙ্গন। টানা ১০ হারে বছর শেষ করা বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতলেও তাতে র​্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি ছাড়া আর কোনো লাভ খুঁজে পাওয়া ভার। এমন একটা বছরে দেশের ক্রিকেটের কথা ভাবলেই সবার আগে মনে ভাসে সাকিব আল হাসানের উইকেটে লাথি মারার সেই ছবি। গত জুনে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে সাকিব যেন লাথি মেরেছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটের সব নোংরামির বিরুদ্ধেই।

মেসির হাতে আর্জেন্টিনার ট্রফি

বার্সেলোনা ছাড়া অন্য কোনো ক্লাবে খেলছেন লিওনেল মেসি—২০২১ সালে এসে দেখতে হয়েছে অবিশ্বাস্য সেই দৃশ্যও। তবে বার্সেলোনা ছেড়ে প্যারিসে পাড়ি জমানোর আগে ক্যারিয়ারের বড় এক অপূর্ণতাও দূর করেছেন আর্জেন্টাইন মহাতারকা। ২৮ বছর পর তাঁর নেতৃত্বেই কোনো শিরোপা জিতেছে আর্জেন্টিনা। ১০ জুলাই ব্রাজিলের বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামে কোপা আমেরিকার ফাইনালে স্বাগতিক ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় মেসির আর্জেন্টিনা। দলকে শিরোপা জেতাতে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন মেসি। ৪ গোল করে কলম্বিয়ার লুইস দিয়াজের সঙ্গে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়া মেসিই জিতেছেন সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার।

ইতালির অজেয় যাত্রা

২০১৮ সালে রাশিয়ার বিশ্বকাপের টিকিট কাটতে পারেনি যে দল, সেই ইতালিই কিনা তিন বছর পর হলো ইউরোপ-সেরা। ১১ জুলাই ফুটবল তীর্থ ওয়েম্বলিতে ইউরোর ফাইনালে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে টাইব্রেকারে হারিয়ে ৫৩ বছরের অপেক্ষার পর আবার ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালি। রবার্তো মানচিনির দল অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতারই পুরস্কার পেয়েছে। ইউরো জয়ের পর ব্রাজিলকে পেছনে ফেলে আন্তর্জাতিক ফুটবলে টানা সবচেয়ে বেশি ম্যাচে অপরাজিত থাকার রেকর্ডও গড়েছে ইতালি। অক্টোবরে উয়েফা নেশনস লিগে স্পেনের কাছে হারের আগে তিন বছরে টানা ৩৭ ম্যাচে অপরাজিত ছিল চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা।

ফেদেরার-নাদালের পাশে জোকোভিচ

গ্র্যান্ড স্লাম একক শিরোপা জয়ের রেকর্ডে রজার ফেদেরার ও রাফায়েল নাদালের পাশে বসতে তিনটি গ্র্যান্ড স্লাম জিততে হতো নোভাক জোকোভিচকে। সার্বিয়ান তারকা অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ও ফ্রেঞ্চ ওপেন জিতে ব্যবধান কমিয়ে খেলতে গেলেন উইম্বলডনে। অল ইংল্যান্ড ক্লাবে ১১ জুলাই এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতায় ম্যাচের পর ম্যাচ জেতা জোকোভিচ ইতিহাস গড়ার ভারেই কি না ফাইনালের প্রথম সেটে হেরে গেলেন ইতালির মাত্তেও বেরেত্তিনির কাছে। এরপর কী দুর্দান্তভাবেই না ফিরে এলেন ‘জোকার’! পরের তিনটি সেট জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বসে গেলেন ফেদেরার-নাদালের পাশে। দুজনকে ছাড়িয়ে এ বছর অবশ্য রেকর্ড ‘২১’ ছুঁতে পারেননি জোকোভিচ।

সোনার পদক ভাগাভাগি

পেশাদারি এই যুগে প্রতিপক্ষকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার অবকাশ কোথায়। সাফল্যের ইঁদুর দৌড়ের যুগে তবু উদাহরণ হলেন জানমার্কো তাম্বেরি ও মুতাজ বারশিম। তাম্বেরির বাড়ি ইতালি, বারশিমের কাতার। ব্যক্তিগত জীবনের দুই বন্ধু টোকিও অলিম্পিকে লড়েছেন একই ইভেন্ট হাই জাম্পে। ১ আগস্ট টোকিও অলিম্পিক স্টেডিয়ামে অবিশ্বাস্য দৃশ্যের জন্ম দিলেন দুজন। আড়াই ঘণ্টার লড়াই শেষেও যখন সমান উচ্চতা লাফিয়ে সমতায় দুজন, সবাই ভাবছিলেন আরও দু–একটি লাফ হয়তো আলাদা করবে দুজনকে। কিন্তু জয়ী হলো বন্ধুত্বই। কাতারি বারশিম ম্যাচ অফিশিয়ালদের অনুরোধ করলেন দুজনকেই সোনার পদক দেওয়া যায় কি না। হ্যাঁ সূচক উত্তর আসতেই বন্ধুকে আলিঙ্গনে বাঁধলেন বারশিম।

বিস্ময়ের নাম মার্চেল ইয়াকবস

কে এই মার্চেল ইয়াকবস—১ আগস্ট টোকিও অলিম্পিকের দ্রুততম মানবের নাম জানার পরই উঠেছে এই প্রশ্ন। ২৬ বছর বয়সী ইতালিয়ান ইয়াকবসের পেছনে থেকে রুপা জেতা ফ্রেড কার্লিই যেন সবার হয়ে উত্তর দিয়ে দিলেন। দৌড় শেষে মার্কিন স্প্রিন্টারে সরল স্বীকারোক্তি, ‘আমি সত্যিই ওর সম্পর্কে কিছুই জানি না। সে অসাধারণ কাজ করেছে।’ ‘অখ্যাত’ সেই ইয়াকবসই ইতালিকে প্রথম অলিম্পিকের দ্রুততম মানব উপহার দিলেন। মার্কিন সৈনিক বাবা ও ইতালিয়ান মায়ের সন্তান ইয়াকবস সেমিফাইনাল থেকে সরাসরি ফাইনালে যেতে পারেননি। নিজের সেমিফাইনালে তৃতীয় হওয়া ইয়াকবস টাইমিংয়ের জোরে সুযোগ পেয়েছিলেন ফাইনালে।

গোলের চূড়ায় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো

ইউরোর গ্রুপ পর্বে ফ্রান্সের বিপক্ষে জোড়া গোল করেই আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডে আলী দাইয়ির পাশে বসেছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। এরপর থেকেই ফুটবল বিশ্ব অপেক্ষা করেছে পর্তুগিজ তারকার রেকর্ডের জন্য। কিন্তু ইউরোতে হয়নি। সেই অপেক্ষা ফুরিয়েছে ১ সেপ্টেম্বর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ঘরের মাঠে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ৮৯তম মিনিটের গোলে। পর্তুগালের জার্সিতে ১১০তম গোলটি করেই ইরানের দাইয়িকে ছাড়িয়েছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার রোনালদো। ম্যাচের শুরুর দিকেই রেকর্ড ভাঙার সুযোগ পেনাল্টি মিস করে হারানো রোনালদো বছর শেষে সংখ্যাটাকে নিয়ে গেছেন ১১৫-তে।

এমা রাদুকানু

রাদুকানুর রূপকথা

ঠিক যেন হান্স ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসন কিংবা ঠাকুরমার ঝুলির গল্প। যে গল্পের নায়িকা এমা রাদুকানু। ব্রিটেনের অষ্টাদশী মেয়ে রূপকথার গল্প লিখেই যে জিতে নিয়েছেন এ বছরের ইউএস ওপেনের একক শিরোপা। বাছাইপর্ব পেরোতে পারবেন কি না, সেটি নিয়ে সংশয় নিয়েই এবারের ইউএস ওপেনে এসেছিলেন চায়নিজ মা ও রোমানিয়ান বাবার মেয়ে রাদুকানু। সেই রাদুকানু ফিরছেন ইউএস ওপেনের নারী এককের ট্রফি ও একগাদা ইতিহাস সঙ্গী করে। ফাইনালে কানাডার লেইলা ফার্নান্দেজকে ৬-৪, ৬-৩ গেমে হারিয়ে টেনিস ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বাছাইপর্ব পেরিয়ে এসে জিতলেন গ্র্যান্ড স্লাম একক শিরোপা।

অস্ট্রেলিয়ার টি-টোয়েন্টি জয়

১১ নভেম্বর ২০২০। দুবাই। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠতে শেষ দুই ওভারে ২২ রান দরকার অস্ট্রেলিয়ার। প্রতিপক্ষের নাম পাকিস্তান, যারা কিনা টুর্নামেন্টজুড়েই দুর্দান্ত খেলে উঠেছে সেমিফাইনালে। শাহিন শাহ আফ্রিদির করা ১৯তম ওভারের তৃতীয় বলটাই বদলে দিল সব। ক্যাচ উঠিয়েও হাসান আলীর সৌজন্যে বেঁচে গেলেন ম্যাথু ওয়েড। সমীকরণ তখন ৯ বলে ১৮ রানের। পড়ে পাওয়া জীবন টানা তিন ছক্কা মেরেই সার্থক করলেন ওয়েড। এক ওভার হাতে রেখেই ম্যাচ জিতে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া। ফাইনালে প্রতিবেশী নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় অস্ট্রেলিয়া।